'এইটি-থ্রি' একদম অনাড়ম্বর, ক্রিকেট যাদের ধ্যান জ্ঞান তাদের কাছে প্রচণ্ড পছন্দ হবার মতো একটি সিনেমা। এই সিনেমা কোন মাস এন্টারটেইনার না, সে হতেও চায়নি। সে ১৯৮৩ সালের গল্পে রং-চং লাগিয়ে দেশপ্রেমকে স্পুনফিড করে খাওয়াতে চায়নি। এইট্টি থ্রি কেবল কিছু মানুষের গল্প বলে গেছে, যাদের মধ্যমণি ছিল সাদামাটা এক কাপ্তান কপিল দেব। যিনি কীনা বিশ্বকাপের পরে আর কখনোই সাদামাটা জীবন যাপন করতে পারেননি...

বাংলা চলচ্চিত্রের নামী পরিচালক গৌতম ঘোষের সাথে সিনেম্যাটোগ্রাফার হিসেবে ডিসকভারি চ্যানেলের ডকুমেন্টারি সিরিজ “বেয়ন্ড দ্য হিমালায়াস” দিয়ে কাজ করা শুরু হয়েছিল কবির খানের, সেই ১৯৯৬ সালে। ফিল্ম স্কুল থেকে পড়াশুনা করে আসা কবির খানের মাথায় অবশ্য তখন থেকেই ডকুমেন্টারি ফিল্মের পোকা। ড্রিম প্রজেক্ট সুভাষ চন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে নিয়ে করা “দ্য ফরগটেন আর্মি” দিয়ে তার প্রবেশ পরিচালনায়। এরপর আফগানিস্তানে নাইন/ইলেভেনের পর ডকুমেন্টারির কাজে যাওয়াটা তার জীবনের বাঁক বদলে দেয়। আফগানিস্তান, কাবুলের সেই অভিজ্ঞতাকে কবির খান সিনেমায় রূপান্তরিত করার তাগিদ অনুভব করেন। একইসাথে প্রকৃতির সবুজ ও যুদ্ধের লাল রঙ দেখার অভিজ্ঞতা তিনি বলতে চান যেন সিনেমা দিয়ে। প্রথম চলচ্চিত্র ‘কাবুল এক্সপ্রেস’ থেকে যার যাত্রা শুরু। 

এরপর কবির খানের সিনেমায় যুদ্ধ আর ভালোবাসার কথা বারবার এসেছে। একের পর এক সফলতা এসে কবির খানের কাছে ধরা দিয়েছে। কিন্তু সেই অনুসন্ধিৎসু ডকুমেন্টারি নির্মাতা কোথায় যেন হারিয়ে যায় সিনেমা নির্মাতার কাছে এসে। সিনেমা নির্মাতা হিসেবে কবির খান টাইগার, বাজরাঙ্গি ভাইজানের পর সাফল্যের চূড়া যেমন দেখেন তেমনি টিউবলাইট, ফরগটেন আর্মি টিভি সিরিজ দিয়ে ব্যর্থতার স্বাদও চেখেছেন। তবে কমার্শিয়ালি কবির খানের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়তো এইট্টি থ্রি। আর এটাই আমার কাছে নির্মাতা কবির খানের সবচেয়ে বড় 'সাফল্য'।

ভারত ক্রিকেট পাগল একটা জাতি। ধর্মের বাইরে সিনেমা আর ক্রিকেটকেই তারা পূজা করে যেন। কিন্তু এই সিনেমা আর ক্রিকেট যখনই একসাথে হয়েছে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার গল্পই বেশি লিখেছে। সুশান্ত সিং রাজপুতের হাত ধরেই মনে হয় ক্রিকেট আর সিনেমার সবচেয়ে সফল দুটো সিনেমা এসেছে। সেই ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে অবিস্মরণীয় গল্প নিয়ে একইসাথে যদি সিনেমা, ক্রিকেট আর দেশপ্রেম সার্ভ করা যায়, এটার চেয়ে শিওরশট কিছু বোধহয় আর হতে পারে না। 

প্রডিউসার রাজি বিগ ইনভেস্টমেন্ট করার জন্য, অভিনেতারা সবাই নিশ্চিত নিজেদের ক্যারিয়ারসেরা কাজ এখানেই আসবে, দর্শকও একটা দেশপ্রেমে মোড়া চেস্ট থাম্পিং মাস এন্টারটেইনার এক্সপেক্ট করেছিল। কিন্তু কবির খানে ভাবছিলেন ভিন্ন কিছু। তিনি আবার শেকড়ে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন নিজের হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে এই সিনেমার মাধ্যমে আবার জাগ্রত করতে। 

পোস্টারে ৮৩

'83' কোন মাস এন্টারটেইনার না, সে হতেও চায় নি। সে ১৯৮৩ সালের গল্পে রং-চং লাগিয়ে দেশপ্রেমকে স্পুনফিড করে খাওয়াতে চায় নি। এইট্টি থ্রি কেবল কিছু মানুষের গল্প বলে গেছে, যাদের মধ্যমণি ছিল সাদামাটা এক কাপ্তান কপিল দেব। যিনি কীনা বিশ্বকাপের পরে আর কখনোই সাদামাটা জীবন যাপন করতে পারেননি। 

এইট্টি থ্রি একদম অনাড়ম্বর, ক্রিকেট যাদের ধ্যান জ্ঞান তাদের কাছে প্রচণ্ড পছন্দ হবার মতো একটি সিনেমা। কবির পুরো সিনেমাই ডকু স্টাইলে বানিয়েছেন। কোন ব্যাকস্টোরি, সাবপ্লটের ধার ধারেন নি। কেবল ঐ বিশ্বকাপের গল্প বলতে চেয়েছেন। আগে ইন্ডিয়ার, বিসিসিআইয়ের কী অবস্থা ছিল শুধু হালকা আঁচ দিয়েছেন; আলাদা কোন এম্ফাসাইজ করেন নি। দর্শকের মনে আলাদা করে আন্ডারডগদের জন্য সিম্প্যাথি তৈরি করার চেষ্টা করেন নি। ক্রাইসিস দেখিয়েছেন, সবগুলোই ক্রিকেট বিষয়ক। যেটা আসল ক্রাইসিস ছিল। কপিল, সুনীল, শ্রীকান্তের মাথায় বাউন্সার থেকে বাঁচা ছাড়া আর কিছুই ঘোরে নি সেসময়। এজ ইট ইজ কবির সেরকমটাই দেখিয়েছেন। 

রনভীর, পঙ্কজ, ভিনিত, জিভা, তাহির, সাকিবের মতো দারুণ অভিনেতারা নিজেদের জাত চিনিয়েছেন মেথড এক্টিং এর সুযোগ পেয়ে। নিজেদের আমূল বদলে ফেলেছেন প্রতিটি অভিনেতা শুধুমাত্র মহানায়কদের প্রতিরূপ হবার জন্য। কবির খান ফিরে গেছেন যেন বিশ-পঁচিশ বছর আগে। ইচ্ছেমতো কেটেছেন, জুড়েছেন, লাইটিং করেছেন, রিক্রিয়েট করেছেন, এডিট করেছেন তার চিরচেনা স্টাইলে।

কবির খান মূলত ৮৩ এর সে সময়টাকে রিলিভ করিয়েছেন। যেন ৮৩ তে বিশ্বকাপ দেখে আবেগি হওয়া কোন যুবক বার্ধক্যে এসে আবার অশ্রুসজল হতে পারে। এখনকার কোন কিশোরও যেন বর্তমান ভারতীয় দলের অবস্থা দেখে অতি আত্মবিশ্বাসি না হয়ে নিজের খেলাতে ফোকাস করে, মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে কাজ করে। ক্রিকেটকে ধ্যান জ্ঞান মানা দেশ সিনেমাতে এখনও এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না, তাই হয়তো ব্যবসায়িক দিক থেকে এইট্টি থ্রি অসফল। কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। 

সিনেমা আর ক্রিকেট এমনই, কেবল একটা ম্যাচ, একটা ইনিংস, একটা সিন-আপনাকে অমর করে দিতে পারে। একদিন বাংলাদেশের ক্রিকেটও এমন রূপকথার সাক্ষী হবে, নিজেরা অসাধ্য সাধন করবে এটাই কামনা। বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে সেটা বেশি কেউ ডিজার্ভ করে না, সত্যি। সেই রূপকথা একদিন রুপালী পর্দায় দেখবো, এটাই আশা।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা