অ্যা হিরো: আসগর ফরহাদির সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আসগর ফারহাদির 'অ্যা হিরো' দেখা উচিত বিশেষ কিছু কারণে। প্রথমত- আপাতদৃষ্টে সাদামাটা এক গল্পকে কিভাবে রূপান্তরিত করা যায় অদ্ভুত সুন্দর এক মেটাফোরে, তা জানার জন্যে। দ্বিতীয়ত- এই যে আধুনিক সভ্যতা আমাদের, এই সভ্যতার নানা প্রকোষ্ঠে যে কতসব সর্পিল গলিঘুঁজি, কপটতা, সর্পিল অসভ্যতা... তা বোঝার জন্যে। তৃতীয়ত- গল্প কিভাবে দাপটের সাথে বলতে হয়, তা উপলব্ধির জন্যে।
আসগর ফরহাদি'র সিনেমায় যেভাবে তিনি শুরু থেকেই খুব যত্ন নিয়ে টেনশন বিল্ডআপ করেন, এবং যেভাবে তিনি দর্শকের মনস্তত্ব নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করেন, তা বরাবরই অন্যরকম এক তৃপ্তি দেয়। অ্যাবাউট ইলি, আ সেপারেশন কিংবা আ সেলসম্যান... এই তিনটি ছবির একটিও যদি কারো দেখা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে পারার কথা- টেনশন কিংবা সাসপেন্সকে তিনি কতটা ভালো বোঝেন এবং কতটা সিদ্ধহস্তভাবে ব্যবহার করতে পারেন নির্মাণে। শেক্সপিয়ারিয়ান ট্রাজেডিতে যেমন আমরা দেখি, খুব ছোট জায়গা থেকে শুরু হওয়া গল্প বড়সড় এক পরিণতির দিকে চলে যাচ্ছে, সেরকমটাই যেন বরাবর লক্ষ্য করি আসগর ফরহাদি'র একেকটি 'সিনেমা' নামক শিল্পকর্মে। এবং পাশাপাশি এই টেনশনের আখ্যানে যেভাবে গভীরভাবে মিশে থাকে জীবনবোধের সূক্ষ্ম সুক্ষ্ম দর্শন... এই কম্বিনেশন অন্য কোনো নির্মাতার নির্মাণে খুব বেশি দেখেছি বলেও মনে পড়েনা।
আসগর ফরহাদির নবতম নির্মাণ 'আ হিরো'তেও এই দৃষ্টান্তের ব্যত্যয় হলোনা মোটেও। কমলো না মুগ্ধতাও। বরং বলা ভালো, মুগ্ধতা আরো প্রগাঢ়ই হলো যেন। জমাটি এক গল্পের সাথে পলিটিক্যাল মেটাফোর আর সোশ্যাল মিডিয়ার গিমিক মিশিয়ে যে অনবদ্য এক মিশ্রণ তৈরী করলেন তিনি, তা একহাত নিলো সমাজ, সংস্কার, রাজনীতি, ধর্মনীতি সহ বহুকিছুকেই। 'আ হিরো'তে তাই বহু উপাদান থাকা সত্বেও দিনশেষে হিরো হলো এই দুর্দান্ত রূপক গল্পই!
গল্পের শুরুতেই যেমন জানা যায়- এক কয়েদী অল্প কয়েকদিনের জন্যে ছাড়া পেয়েছে কয়েদখানা থেকে। বাইরে এসে ঘটনাচক্রে সে পেয়েছে একটি ব্যাগ, যে ব্যাগে অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা। এই স্বর্ণমুদ্রা সে নিজের কাজে ব্যবহার না করে ফিরিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। একজন জেলখাটা কয়েদীর এমন সততা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ সবাই৷ খবর পেয়েছে মিডিয়াও। তারা এসে কাভার স্টোরি, লিড নিউজ করছে এই কয়েদীকে নিয়ে। বিশেষ এই ঘটনা রাতারাতি তাকে বানিয়েছে 'টক অব দ্য টাউন।' তাকে বানিয়েছে নায়ক। অথবা- আ হিরো।
যদি কেউ ভেবে থাকেন গল্প এটুকুই, তাহলে ধরে নিতেই হবে, আপনি আসগর ফারহাদির সিনেমা নিয়ে সেরকম স্বচ্ছ ধারণা রাখেন না। যতটুকু লেখা হলো উপরে, বলা যেতে পারে, এটুকু গল্পের প্রোলোগ। এই প্রোলোগের জের ধরে ফরহাদি এরপর গল্পকে শাখা-প্রশাখায় যেভাবে পাঠালেন একের পর এক প্রহসন-কক্ষে, মিডিয়া ট্রায়াল থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ার প্যারাডক্সে যেভাবে ঘুরপাক খাওয়ালেন গল্পের কাদামাটিকে, তা ক্ষণেক্ষণে মনে করালো সেই আদি ও অকৃত্রিম ফরহাদিকেই। ' আ হিরো'র সংজ্ঞা ও ন্যারেটিভ যেভাবে পাল্টালো ক্ষণেক্ষণে, গল্পের সুতা যেভাবে রইলো টানটান... এক নিঃশ্বাসে এ সিনেমা শেষ করে তাই মনে হলো, এ গল্পের নায়ক স্বয়ং 'গল্প' নিজে ছাড়া আর কেউ হতেই পারেনা!
গত বছরের শেষদিকে মুক্তি পাওয়া 'ডোন্ট লুক আপ' এ যেভাবে উঠে এসেছিলো সামাজিক মাধ্যমের ধোঁকাবাজির অদ্ভুত সমীকরণ, 'আ হিরো'তেও সেই সমীকরণ আরেকটু পাকাপোক্ত হওয়াতে বেশ তৃপ্তি পেয়েছি। সামাজিক মাধ্যম যেভাবে 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' হয়ে গিলে নিচ্ছে সব, প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু, আবেগ যেভাবে হয়ে উঠছে ব্যবসার প্রতীক... 'আ হিরো' ঠাস গল্পের বুনোটে সেসব সমসাময়িক অসারতাকে গুরুত্ব দিয়েছে দেখেও চমৎকৃত হয়েছি যারপরনাই।
ফিরি অন্য প্রসঙ্গে। 'আ হিরো'র যে গল্প, এরকম জমাটি এক গল্পকে ঠিকঠাক সঙ্গত দেয়ার জন্যে দারুণ অভিনয়ই দরকার ছিলো যেন। এবং হুবহু ঠিক সেরকম অভিনয়ই এলো গল্পের প্রোটাগনিস্ট আমির জাদিদি'র কাছ থেকে। অসহায়ত্ব, আক্রোশ কিংবা বিষাদ... চরিত্রের সিচুয়েশন বুঝে যেভাবে তিনি করলেন অভিনয়, যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ হলাম। এটা তো ধ্রুবসত্যি, নির্মাণের পুরো আখ্যান কতটুকু জ্যান্ত হয়ে উঠবে, তার অনেকটুকুই নির্ভর করে কুশীলবদের সক্ষমতার উপর। এবং আমির জাদিদিই বলি কিংবা সাহার গোলদাস্ত, সারিনা ফারহাদি... সক্ষমতার ক্ষমতা বিধানে সবাই যে সিদ্ধহস্ত, তুখোড় অভিনয়েই হলো তার একপ্রস্থ প্রমাণ। ইরানি সিনেমার কুশীলবদের অভিনয়শৈলী নিয়ে এমনিতেও আলাদা করে কিছু বলার থাকেনা। সেটাই যেন প্রমানিত হলো আরেকবার।
এসবকিছুর মিলিত বিবেচনায় বলাই যায়- আসগর ফারহাদির 'আ হিরো' দেখা উচিত সবার। এবং দেখা উচিত বিশেষ অনেকগুলো কারণে। প্রথমত- আপাতদৃষ্টে সাদামাটা এক গল্পকে কিভাবে বানানো যায় অদ্ভুত সুন্দর এক মেটাফোরে, তা দেখার জন্যে। দ্বিতীয়ত- এই যে আধুনিক সভ্যতা আমাদের, এই সভ্যতার নানা প্রকোষ্ঠে যে কতসব সর্পিল গলিঘুঁজি, কপটতা, সর্পিল অসভ্যতা... তা বোঝার জন্যে। তৃতীয়ত- গল্প কিভাবে দাপটের সাথে বলতে হয়, তা জানার জন্যে। এবং শেষবেলায় এসে এটুকু বলেই সমাপ্তিবিন্দু টানা যায়, নিছক সিনেমা হিসেবেই 'আ হিরো' সফল নয়, বোধের প্রাচীরে বড়সড় ধাক্কা খাওয়ার এক যথাযথ উপাদান হিসেবেও বিস্তর প্রাসঙ্গিক এ নির্মাণ। এবং মাস্টার ডিরেক্টর আসগর ফরহাদির কাছ থেকে এরকম নির্মাণই প্রত্যাশা থাকে আমাদের। বরাবর।