কোথাও কেউ নেই নাটকে তার মিথ্যা সাক্ষ্যেই বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছিল। শেষ পর্ব প্রচারের আগে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল আব্দুল কাদেরকে। আবার নক্ষত্রের রাত নাটকে তিনি হাজির হয়েছেন দুলাভাই হয়ে, যে চরিত্রটাকে ভালো না বেসে থাকা সম্ভব নয়...

আগাগোড়া কর্পোরেট চাকুরীজীবী ছিলেন তিনি। 'বাটা'র মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন ছিলেন, জীবনের ৩৫টি বছর তিনি কাটিয়েছেন সেই কোম্পানীতে। কিন্ত নয়টা-পাঁচটার চাকরি কিংবা লাভ-লোকসানের জটিল হিসেবের বাইরে অভিনয়টা ছিল তার কাছে অক্সিজেনের মতো। ক্যামেরার সামনে, বা মঞ্চে সংলাপ দিতে দাঁড়ালে তিনি খুঁজে পেতেন মুক্তির আনন্দ। জীবনধারণের জন্য তিনি চাকরি করেছেন, আর নিজের জন্য করেছেন অভিনয়।

তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন, সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ছোট্ট নাটিকায় অভিনয় করে মানুষকে ভালো থাকার, সৎ পথে চলার উপদেশ দিয়েছেন বারবার। তার অভিনীত চরিত্রকে লোকে কখনও ভালোবেসেছে, কখনও তীব্রভাবে ঘৃণা করেছে- সেই চরিত্রগুলোকে তিনি এতটাই বাস্তব করে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। বাংলা নাটকের অজস্র পরিবর্তনের সাক্ষী অভিনেতা আবদুল কাদের যখন শীতের সকালটাকে বিষণ্ণ করে দিয়ে অন্য ভূবনের পথে পাড়ি জমালেন, তখন পেছনে রেখে গেলেন অসামান্য কিছু কীর্তি, কখনও ভুলতে না পারার মতো অজস্র স্মৃতি আর অভিনয়ের প্রতি তীব্র ভালোবাসার অসাধারণ এক গল্প।

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে জন্ম আব্দুল কাদেরের, সাল ১৯৫১। স্কুলজীবন থেকেই অভিনয়ের প্রতি ভালোলাগার শুরু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নাটকে অভিনয়ের হাতেখড়ি। এই কাজটাকে যে এত বেশি ভালোবেসে ফেলবেন, সেটা জানতেন না তখনও। মেধাবী ছাত্র ছিলেন, ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর ভর্তির সুযোগ পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা তখন স্বাধীনতার দাবীতে উত্তাল, পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেসবের আঁচ এসে লাগলো আব্দুল কাদেরের গায়েও, জড়িয়ে গেলেন নাটকের সঙ্গে।

১৯৭২-১৯৭৪ পর্যন্ত টানা তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহসিন হল ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে আন্তঃ হল নাট্য প্রতিযোগিতায় মহসিন হলের ছাত্ররা পারফর্ম করলো সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্দেশিত নাটক ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, সেই নাটকটা সেরা নাটক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল বিচারকদের রায়ে। সেখানে অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিলেন আব্দুল কাদের। বিটিভির সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে পুরস্কার পাওয়া আবদুল কাদের ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ডাকসু নাট্যচক্রের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে থিয়েটার নাট্যদলেও যোগ দিয়েছিলেন, রেডিও এবং টিভি নাটকেও তার অভিষেক হয়ে গেছে তখন।

আব্দুল কাদের

এসো গল্পের দেশে নামের একটা ধারাবাহিক নাটক দিয়ে বিটিভিতে আব্দুল কাদেরের যাত্রা শুরু। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দুই হাজারের বেশি টিভি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন, তবে বিটিভির দর্শকেরা আব্দুল কাদেরকে বিশেষভাবে মনে রাখবেন দুটো নাটকের জন্য। একটা হচ্ছে কোথাও কেউ নেই, বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় দখল করে আছে যে নাটক। বদি চরিত্রে মনে রাখার মতো অভিনয় করেছিলেন আব্দুল কাদের, আদালতে তার মিথ্যা সাক্ষ্যতেই বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছিল। একটা নাটক বা সিনেমায় অভিনয় করে আর কেউ বোধহয় এতটা ঘৃণা কুড়াতে পারেননি, আব্দুল কাদের যতটা কুড়িয়েছিলেন। তার বাসায় হামলা করেছিল উত্তেজিত জনতা, শেষ পর্ব প্রচারের আগে তিনি এবং নাটকের চিত্রনাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। কোথাও কেউ নেই ইতিহাস রচনা করেছিল, আর সেই ইতিহাসের অংশ ছিলেন আব্দুল কাদের।

হুমায়ূন আহমেদেরই নক্ষত্রের রাত নাটকে তিনি অভিনয় করেছিলেন দুলাভাই চরিত্রে। পাগলাটে, খেয়ালি এক মজার চরিত্র, ক্ষণে ক্ষণে সেখানে দর্শককে তিনি হাসিয়েছেন, মন ভালো করে দিয়েছেন। নক্ষত্রের রাত নাটকে আব্দুল কাদেরের চরিত্রটা অসম্ভব মায়ায় ঘেরা, কিন্ত সেই মায়া বা ভালোবাসাটা তিনি ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। স্ত্রী-সন্তানকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন মানুষটা, কিন্ত স্ত্রীর সঙ্গে সারাক্ষণ ঝগড়া লেগে থাকে, বাচ্চাদের অযথা ধমক দেন। তার সেই ঝগড়া বা ধমকগুলো দেখতেও ভালো লাগতো, এই নাটক সম্প্রচারের পর বাইরে বের হলে লোকে নাকি তাকে আদর করে 'কাদের ভাই' না ডেকে 'দুলাভাই' ডাকতো!

রং নাম্বার নামের একটা সিনেমায় অভিনয় করেছেন, নানা সময়ে তাকে দেখা গেছে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনেও। ইত্যাদির জনপ্রিয় নাটিকা সিরিজ 'মামা-ভাগ্নে'-তে তিনি অভিনয় করতেন মামার চরিত্রে। বিদেশ ফেরত এই ভদ্রলোকের কাজ ছিল ভাগ্নের নানা আজগুবি এবং লোক ঠকানো ব্যবসা বন্ধ করা এবং তাকে সঠিক পথ দেখানো। এই চরিত্রটাও অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

কোথাও কেউ নেই নাটকের তারা তিনজন

এর বাইরে মঞ্চনাটকে নিয়মিত অভিনয় করেছেন একটা সময়ে, থিয়েটারের প্রায় ৩০টি প্রযোজনার এক হাজারের বেশি প্রদর্শনীতে দেখা গেছে আব্দুল কাদেরকে। তার উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক ছিল- ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘স্পর্ধা’, ‘দুই বোন’,‘মেরাজ ফকিরের মা’। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে বাংলাদেশের নাটক থিয়েটারের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’- এ অভিনয় করেন তিনি, দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছিল তার সেই অভিনয়। দেশের বাইরে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, দিল্লি, দুবাই এবং দেশের প্রায় সব কটি জেলায় আমন্ত্রিত হয়ে অভিনয় করেছেন, যেখানে অভিনয়ের ডাক পেয়েছেন, ছুটে গেছেন, অভিনয়টা তার কাছে নেশা ছিল সবসময়।

তবে নেশাটাকে পেশা বানাননি কখনও, টাকার জন্য অভিনয় করেননি, সেটার দরকারও হয়নি। বাটা বাংলাদেশে উঁচু পদে চাকর করতেন, কর্মজীবনের ৩৫টি বছর কাটিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে। এর আগে শিক্ষকতা করেছেন, নিজের জেলা মুন্সীগঞ্জের সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে অর্থনীতি পড়াতেন। বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি করেছেন। ১৯৭৯ সালে বাটায় যোগ দিয়েছিলেন, ২০১৪ সালে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেই প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত ছিলেন তিনি।

দুই হাজারের বেশি টিভি নাটকে অভিনয় করাটা চাট্টেখানি কথা নয়। সেইসঙ্গে মঞ্চে এক হাজারের বেশি প্রদর্শনী- তবুও কিংবদন্তীর কাতারে তার নাম হয়তো লেখা থাকবে না, কিন্ত নিজের অভিনয় দিয়ে মানুষের মনে ভালোবাসা বা ঘৃণার সঞ্চার করাটা সব অভিনেতার পক্ষে সম্ভব হয় না। আব্দুল কাদের দুটোই করে দেখিয়েছিলেন। 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের বদিকে যেমন লোকে ঘৃণা করেছে, তেমনই ভালোবেসেছে নক্ষত্রের রাতের দুলাভাইকে। অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার তাকে কেড়ে নিয়েছে আচমকা, মানুষটা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আরও ছয়টা মাস বাঁচতে চেয়েছিলেন, নিয়তি তাকে সেই সুযোগটা দিলো না। কিন্ত আমাদের হৃদয়ে তার প্রতি ভালোবাসা তো অটুট থাকবে, তিনিও বদি দুলাভাই কিংবা মামা হিসেবে চিরদিন অমলিন হয়ে রইবেন আমাদের মনে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা