আবুল খায়ের: আমাদের তিনি যা দিয়েছেন, তার সিকিভাগও কি তিনি ফেরত পেয়েছেন?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তীতুল্য, ৭ই মার্চের ভাষণ সংরক্ষনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তবু আজও তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হলো না! এটা তো আমাদেরই ব্যর্থতা...
৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল। ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ইতিহাস রচিত হয়েছিল। সেদিন আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৮ মিনিট ব্যাপ্তি এ ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিলেন আপামর বাঙালি জাতি।
বঙ্গবন্ধু সেদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বক্তব্য রাখতে পারেন, এই আশায় রেসকোর্সের ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। ঢাকা বেতার থেকে এ ভাষণ প্রচার করার কথা ছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে সেদিন রেডিওতে তা প্রচার করা যায়নি।
তবে সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশন (ঢাকা রেকর্ড) এর চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের এমএনএ ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সময় টেকনিশিয়ানরা ভাষণটির অডিও ধারণ করেন, অন্যদিকে এম এ মোবিন, এম এ রউফ, এস এম তোহিদ বাবু ও আমজাদ আলী খন্দকার সহ চারজন ক্যামেরাম্যান চিত্রধারণ করেন।
অন্যদিকে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বেতার কর্মীরা সরাসরি ভাষণটি প্রচার করতে না পারলেও; রেকর্ডটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন, যেটা পরদিন বাঙালি বেতারকর্মী ও আপামর জনতার দাবির প্রেক্ষিতে বেতারে প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শুধুমাত্র এর ধারণকৃত অডিও তাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল, তখন সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের পরিচালক ছিলেন আবুল খায়ের, তিনি ছিলেন প্রযোজক।
আজকের দিনে এসে ৭ই মার্চের যে ভাষণ দেখতে পাই তার অনেকখানি অবদান আছে উনার, যার জন্য রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। তবে দর্শকদের কাছে উনার সফল পরিচিতি একজন অভিনেতা হিসেবে, হ্যাঁ সেইদিনেই সেই প্রযোজক আবুল খায়ের ই আমাদের সবার প্রিয় অভিনেতা কিংবদন্তি 'আবুল খায়ের'।
'আবুল খায়ের', চলচ্চিত্র ও নাটকপ্রেমীদের কাছে খুব ই শ্রদ্ধাভাজন নাম। বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ'- এও ছিলেন অন্যতম অভিনেতা, জহির রায়হানের কাচের দেয়াল, সঙ্গমের মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাকে এফডিসির মহাপরিচালক বানিয়েছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম থেকে দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর শিমুল পারুল সব ছবিতেই ছিল সরব উপস্থিতি।
'দহন' সিনেমায় উনার অসামান্য অভিনয় যে কেউ প্রশংসা করতে বাধ্য, এই ছবিতেই পান প্রথম জাতীয় পুরস্কার, এরপর একে একে রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, অন্য জীবন, দুখাই দিয়ে মোট চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। রাজ্জাকের 'জিনের বাদশা'য় করেছিলেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয়। দীপু নাম্বার টু- তে ছিলেন স্কুল শিক্ষক,বিখ্যাত ছবি পদ্মা নদীর মাঝিতে হয়েছিলেন পীতম মাঝি। মূলধারার বেশকিছু ছবিতেই উনাকে দেখা গিয়েছিল।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ছিল উনার অপূর্ব রসায়ন। আগে থেকেই ছিলেন সফল অভিনেতা তবে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। বিশেষ করে নব্বই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি এই কাজগুলোর জন্যই বেশি স্মরনীয়। এই জুটির সূচনাটা হয়েছিল 'এইসব দিনরাত্রি'র মধ্য দিয়ে। একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের চরিত্রে, যিনি সুখী নীলগঞ্জ করার প্রচেষ্টায় ছিলেন। অনেক বাধা বিঘ্ন এসেছে তবে সেটা কাটিয়ে গড়ে তুলতে ছিলেন বদ্ধ পরিকর।
এর ঠিক পরের ধারাবাহিক 'বহুব্রীহি'তে পেলেন পুরো ভিন্ন চরিত্র। গ্রাম থেকে আসা এক দাদার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অয়োময়তে চিকিৎসক, তবে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন কোথাও কেউ নেই তে বাকের ভাইয়ের বিপক্ষে উকিলের চরিত্রে অভিনয় করে। যার কুবুদ্ধিতে বদি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়। নক্ষত্রের রাতে অত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র না পেলেও আজ রবিবারে ছিলেন বাড়ির প্রধান কর্তা হিসেবে, তিতলী-কঙ্কার দাদার চরিত্রে। একক নাটকের মধ্যে জননী, মাটির পিঞ্জিরার মাঝে, নিমফুল, অচিনবৃক্ষ রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের 'শ্রাবণ মেঘের দিন- এও ছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য। এর বাইরে 'শেকড়' নাটকটাও বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
'আমি এখন ঔষধ বানামু কি দিয়া'- নতুন শতকের শুরুর দিকে ঔষধি গাছের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জন সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বানানো হয়েছিল, এতে তিনি কবিরাজের চরিত্রে অভিনয় করে বেশ আলোচিত হন। আমাদের শৈশবের এই বিজ্ঞাপন এখনো অনেকে মনে রেখেছে। এর কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান, বিটিভিতে এরপরেও বেশ কিছু বছর বিজ্ঞাপনটি প্রচারিত হয়েছিল। ১৯২৯ সালের ৪ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করা এই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ২০০১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। গতকাল তার ২০ তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল, রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
আফসোসের বিষয় এই যে, অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তীর আসনে প্রতিষ্ঠিত, ৭ই মার্চের ভাষণ সংরক্ষনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তবুও আজ পর্যন্ত উনাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হল না! এখনো যদি কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে উদ্যেগ না নেন তা হবে হতাশাজনক। দর্শকদের কাছে তিনি উনার কর্মের মধ্য দিয়ে থেকে যাবেন চির অম্লান।