স্ক্রিপ্টের বাইরে থেকে এসে 'মাস্টারপিস' হয়েছে সিনেমার যেসব দৃশ্য!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

গডফাদার, নায়ক, ইন্ডিয়ানা জোনস, টাইটানিক, দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে সহ বিখ্যাত সব সিনেমার এমন কিছু দৃশ্য আছে, যেগুলোর জন্ম স্ক্রিপ্ট থেকে নয়, বরং দুর্ঘটনা থেকে...
সত্যজিৎ রায় এর বিখ্যাত 'নায়ক' সিনেমার এক দৃশ্যে ছিলো-পকেট থেকে কলম বের করে লিখবেন অরিন্দম (উত্তম কুমার)। কিন্তু শটটা নেয়ার সময়ে বিপত্তি ঘটে। লিখতে গিয়ে উত্তম কুমার টের পান, কলমের কালি শুকিয়ে গিয়েছে। এদিকে ক্যামেরা চলছে। ক্যামেরার পেছনে সত্যজিৎ রায়। এখন কী করা যায়? উত্তম কুমার তখন স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে এক কাণ্ড করলেন। টেবিলে থাকা গ্লাসের পানিতে কলম চুবিয়ে এরপর লেখা শুরু করলেন। উত্তম কুমারের এই ইম্প্রোভাইজড ট্যাকটিক্সে বেশ খুশি হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই সিনটিকেও রাখা হয়েছিলো সিনেমার সাথে৷

'টাইটানিক' সিনেমার সেই আইকনিক দৃশ্যের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, যেখানে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও টাইটানিকের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে সোল্লাসে চিৎকার করছে-
আই অ্যাম দ্য কিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড
এই কালজয়ী সিনের মূল আইডিয়া ছিলো লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও'র। যেটা পরে পরিচালক অনুমোদন দেন৷ বাকিটা হয়ে যায় ইতিহাস।

বিখ্যাত ইন্ডিয়ানা জোনস সিরিজের 'রাইডার্স অব দ্য লস্ট আর্ক' সিনেমার স্ক্রিপ্টে ছিলো, ইন্ডিয়ানা জোনস ভিলেনের সাথে তলোয়ার-যুদ্ধে নামবে৷ কিন্তু শুটিং এর আগের রাতে ফুড পয়জনিং হয় নায়ক হ্যারিসন ফোর্ডের৷ ফলে, পরেরদিন দীর্ঘ শটের তলোয়ার-যুদ্ধ'র বদলে ইন্ডিয়ানা জোনস পিস্তল নিয়ে নামেন এবং শত্রুকে ঘায়েল করেন চোখের নিমেষে। এই মারাত্মক সিনটা সিনেমাপ্রেমীদের চোখে 'মাস্টারপিস' হিসেবে থেকে গিয়েছে। অথচ এক দূর্ঘটনা থেকেই দৃশ্যটির জন্ম।

'দ্য গডফাদার' সিনেমায় একটা ডায়লগ আমরা সবাই শুনেছি ও দেখেছি-
Leave the gun, take the cannoli.
এই ডায়লগের দ্বিতীয় অংশটা স্ক্রিপ্টে ছিলো না। যার মুখ থেকে আমরা এই ডায়লগ শুনি, অর্থাৎ রিচার্ড এস ক্যাস্টেলানো, তিনি মূল ডায়লগ দেয়ার সময়ে হুট করেই বলে ফেলেন- Leave the gun, take the cannoli. দ্বিতীয় অংশ যুক্ত করার ফলেই পুরো বিষয়টি সারকাস্টিক হিউমারের এক দারুণ উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়৷ ফলশ্রুতিতে সিনটাও হয়ে যায় কালজয়ী। 'গডফাদার' নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই এই ডায়লগটি চলে আসে আলোচনার টেবিলে।

বিখ্যাত 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে' সিনেমায় একটি দৃশ্য আছে যেখানে শাহরুখ খান এবং অমরেশ পুরী কবুতরদের খাওয়াচ্ছিলেন৷ এই সিন দর্শকদের বেশ পছন্দও হয়েছিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনাটি মূল স্ক্রিপ্টে ছিলো না। সিনেমার সেট এ প্রচুর কবুতর আসতো। একদিন তাই শাহরুখ এবং অমরেশ পুরী মিলে এই কবুতরদের খাওয়ানো শুরু করেন। শুটিং ইউনিটের সবাই এই দৃশ্য বেশ পছন্দ করেছিলো। ফলে হুবহু সেই সিনটাই ঢুকে যায় সিনেমাতে। অদ্ভুত না!

'কন্ট্রাক্ট' ওয়েব সিরিজে চঞ্চল চৌধুরী ওরফে ব্ল্যাক রঞ্জুর পারফরম্যান্স তো সবাই দেখেছি আমরা। সেই ওয়েব সিরিজের এক দৃশ্যে সিআইডি'র সাথে এনকাউন্টারের পরে 'বাঘের বাচ্চা' বলে দানবীয় এক হাসি দিয়েছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। যে হাসি ভাইরাল হয় নেটদুনিয়ায়। মজার ব্যাপার হলো, এই হাসি কিন্তু স্ক্রিপ্টে ছিলো না। চঞ্চল চৌধুরী নিজে থেকেই এই হাসিকে অ্যাড করেছিলেন অভিনয়ে। ফলাফল, তা পর্দাতেই দেখেছি সবাই৷
'মরীচিকা' নামে এক ওয়েব সিরিজের ট্রেলারের কয়টি বিশেষ দৃশ্য নিয়ে সম্প্রতি প্রচুর আলোচনা দেখলাম চারপাশে। যার মধ্যে 'মিস মিস' ডায়লগটা নিয়ে কথাবার্তা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ট্রেলারের এক দৃশ্যে দেখা যায়, নিশোর গায়ে গুলি করছে সিয়াম। কিন্তু একটা গুলিও লাগছে না নিশোর গায়ে। নিশো যে এই বিষয়টায় মজা পাচ্ছে, তা বোঝানোর জন্যে পরিচালক শিহাব শাহীন তাকে কিছু করতে বলেন। নিশো তখন 'মিস মিস' ডায়লগটা অ্যাড করে দেয় স্ক্রিপ্টের সাথে। বাকিটা হয়ে দাঁড়ায় দারুণ এক ইম্প্রোভাইজেশন।

এই বিষয়গুলোর অবতারণা করলাম, একটা বিষয় বোঝানোর জন্যে। অনেক পরিচালকই আছেন, যারা মনে করেন, স্ক্রিপ্টে যা আছে, এটুকুই সংবিধান। অভিনেতাকে করতে হবে হুবহু এই অংশটুকুই৷ এর বাইরে আর কিছু করার অধিকার নেই তাদের! সমস্যা সেখানেই হয়। ভালো অভিনয় আর আসেনা। পোশাকি নাটুকেপনা হয় সেখানে। আর যেখানে পরিচালক ও অভিনেতাদের মধ্যে একটা সুস্থ মিথস্ক্রিয়া হয়, পারস্পরিক মতামতের এক সম্মানজনক আদানপ্রদান হয়, সেখানে ঘটনা-দূর্ঘটনা'বশত এরকম আইকনিক শটগুলোর জন্ম হয়। সিনেমাপ্রেমীরাও পায় কড়চার একেকটা শক্তপোক্ত খোরাক।
আশার ব্যাপার হচ্ছে, আজকালকার পরিচালকেরা আগেকার সেই সংস্কারপন্থী মনোভাব ভাঙ্গছেন। কুশীলবদের মতামত নেয়া হচ্ছে নির্মাণের বিভিন্ন চলকে। আখেরে তাতে লাভ হচ্ছে নাটক, সিনেমা, সিরিজেরই। নির্মাণগুলোর সাম্যাবস্থাও বজায় থাকছে সে সাথে।
আশা করা যায়, এই স্বাস্থ্যকর সংস্কৃতির নিয়মিত প্রয়োগই দেখাবেন সংশ্লিষ্ট মানুষজন। সেটাই প্রত্যাশা।