
শম্পা রেজাকে দিয়ে শুরু হওয়া বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হচ্ছিলাম ক্রমশ। যদি এভাবেই শেষ হতো এই নির্মাণ, চাপানউতোর থাকতো না হয়তো। কিন্তু বিজ্ঞাপনের একেবারে শেষে আচমকাই আবির্ভূত হলো দুর্দান্ত এক ইউটার্ন। প্রয়াত শেন ওয়ার্নের মায়াবী স্পেলের মতই যেন এক টুইস্ট। চমকে উঠলাম। বিজ্ঞাপনকে শুরুতে যা ভেবেছিলাম, তা থেকে একেবারেই সরে আসা ক্লাইম্যাক্স যেন এটাও বোঝালো, মলাট দেখেই বোঝা যায় না বইয়ের সারাংশ!
নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন- সামাজিক কোনো বার্তা জনতার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হলে, সিনেমাই সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। কথাটা সত্যিও। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষেত্রবিশেষে এও মনে হয়, সামাজিক বার্তা সম্প্রচারের জন্যে সিনেমার চেয়েও কার্যকরী মাধ্যম বোধহয় এ সময়ের বিজ্ঞাপন। নাতিদীর্ঘের একেকটা বিজ্ঞাপনে যেরকম গভীর ভাবের আবহ আজকাল পাই, তাতে এ বিশ্বাসই দৃঢ়মূল হচ্ছে ক্রমশ- সহজ কথায় এভাবে মানুষকে আলোড়িত করা হয়তো শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের পক্ষেই সম্ভব। সম্প্রতি নারী দিবসকে উপজীব্য করে বানানো এক বিজ্ঞাপন দেখে এ বিশেষ ধারণাই বদ্ধমূল হলো আবার।
পরিপাটি রেস্তোরাঁ। অফিশিয়াল ফাংশন। এক কলিগকে বিদায় দিতে সমবেত হয়েছেন অফিসের বাকি সবাই। মৃদু গুঞ্জন, খাওয়াদাওয়া চলছে। এরইমধ্যে অফিসের বস উঠে দাঁড়ালেন। বিদায়ী কলিগকে উদ্দেশ্যে করে শুরু করলেন স্মৃতিচারণ। আহামরি কিছু না। গৎবাঁধা কথাবার্তা। কিন্তু সেই কথাটুকুও শুনতে ভালো লাগলো শুধুমাত্র শম্পা রেজার কারণে। প্রিয় অভিনেত্রীকে অনেকদিন পরে কোনো বিজ্ঞাপনে দেখে এমনিতেও তড়পাচ্ছিলাম। তাছাড়া কথাও বলছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, গুছিয়ে। বলাই বাহুল্য, বেশ ভালোভাবে হুক হয়ে গিয়েছিলাম বিজ্ঞাপনের সাথে। এবং এ বিজ্ঞাপন যদি এভাবেই শেষ হতো, চাপানউতোর থাকতো না হয়তো। কিন্তু বিজ্ঞাপনের একেবারে শেষে আচমকাই আবির্ভূত হলো দুর্দান্ত এক ইউটার্ন। প্রয়াত শেন ওয়ার্নের মায়াবী স্পেলের মতই যেন এক টুইস্ট। চমকে উঠলাম। বিজ্ঞাপনকে শুরুতে যা ভেবেছিলাম, তা থেকে একেবারেই সরে আসা ক্লাইম্যাক্স যেন এটাও বোঝালো-
Don't Judge a Book by It's Cover.
কি ছিলো সে টুইস্ট, সেটা এখনই খোলাসা করবো না। তাহলে বিজ্ঞাপনের শেষটুকু দেখে মুগ্ধ হওয়ার উপলক্ষ্যটুকু উবে যাবে অনেকটাই। তবে এটুকু হিন্ট দেয়া যায়- কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রমিজিং ক্যারিয়ার এবং সন্তান জন্মের পরে সে ক্যারিয়ার ছেড়ে তাদের স্বেচ্ছা-অবসরে যাওয়ার যে বিড়ম্বনা, সেটাকে ফোকাসে রেখেই বানানো হয়েছে এ বিজ্ঞাপন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটাই, এই বিজ্ঞাপনে অতিরঞ্জিত এবং অতি-আবেগের লেশমাত্রও নেই। যা আছে, তা প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা। এবং নির্মাণের মুন্সিয়ানা। আমাদের এই উপমহাদেশে, লিঙ্গ-বৈষম্যের যে বিষাক্ত বিষবাষ্প, সে বিষবাষ্পকেই যেন আলগোছে উপেক্ষা করতে চাইলো এ বিজ্ঞাপন। ভালো লাগলো।

বিজ্ঞাপন শেষে কমেন্টবক্সে পাবলিক রেসপন্স দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম, অনেকেই বিজ্ঞাপনের এ আপ্তবাক্য ঠিক হজম করতে পারেননি। এবং ঠিক এখানে এসেই যেন পুরোপুরি পাশমার্ক পেয়ে গেলো বিশেষ এ বিজ্ঞাপন। কারণ, অতলের যে বদ্ধমূল জায়গাটিতে ধাক্কা দিয়েছে এ নির্মাণ, তা অনেকেরই ঠিক ভালো লাগবে না। প্রাচীন ধ্যানধারণার মূলোৎপাটনের চেষ্টা করা হলে কারই বা আর ভালো লাগে? এবং এ বিজ্ঞাপন ঠিক এখানে এসে রূপান্তরিত হলো এক লিটমাস টেস্টেও। চিন্তাচেতনায় কে কতটা উন্নত, সেটাই যেন ক্রমশ উন্মোচিত হলো এ লিটমাসের নানা রঙের চলকে।

ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম, নারী দিবস উপলক্ষ্যে 'ACI' ব্রাণ্ডের জন্যে 'Think Pure' টাইটেলে এ বিজ্ঞাপন বানিয়েছেন মাহাথির স্পন্দন। এর আগেও এই নির্মাতা 'পাওয়ার ড্রিংক' নিয়ে একটা স্যাটায়ার বিজ্ঞাপন বানিয়েছিলেন। মুগ্ধ হয়েছিলাম। 'জয়া স্যানিটারী ন্যাপকিন' নিয়েও তার একটা বিজ্ঞাপন আছে। সেটাও ভালো। নির্মাতা মাহাথিরের বিজ্ঞাপনগুলোতে একটা বিষয় বেশ দ্রষ্টব্য, প্রতিটি নির্মাণের কালারটোন, ক্যামেরা এবং চরিত্র-বন্টনে তিনি যেমন ছিমছাম সাম্যাবস্থা রাখেন, তেমনি, গল্পেও রাখেন দারুণ কিছু টার্ন। যে কারণে শেষে এসে নির্মাণগুলো গড়পড়তা না থেকে বরং হয়ে যায় দারুণ অর্থবহও। ফলশ্রুতিতে চমক বাড়ে। বাড়ে মুগ্ধতাও।
প্রসঙ্গত জানাই, বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনে 'সামাজিক বার্তা' দেয়ার যে চল শুরু হয়েছে, এ চলটা খুবই সময়োপযোগী, পাশাপাশি ইতিবাচকও। মাত্র দুই-তিন মিনিটের একেকটা নির্মাণ, অথচ, সেসব নির্মাণেই 'বিন্দুতে সিন্ধু ধারণ' করার যে দারুণ মুন্সিয়ানা... সেসব বিবেচনায় এ সময়ের বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতাদের খানিকটা ধন্যবাদ না দিলে যেন বিস্তর অন্যায়ও হয়ে যায়। যদিও এসব বিজ্ঞাপন এবং অন্তরালে থাকা অর্থবহ বার্তাসমূহ জনতার নিরেট খুলিতে আঁচড় ফেলবে কি না, জানা নেই কারো। তবুও ভালো কিছুর আশা করতে দোষ নেই মোটেও। দোষ নেই চেষ্টা করতেও। যে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন নির্মাতারা। এবং ঠিক যে কারণেই আশা করি, এভাবেই ক্রমাগত চেষ্টার ফলাফলে একসময় পাল্টাবে চিন্তা। সময়। সমাজ। তাহলেই কল্যাণ।
#ThinkPure