এই মিউজিক্যাল ফিল্মের নির্মাতা যে কাজটি করেছেন, অর্ণবের গান এবং স্মৃতিচারণের মাঝখানে বেশ সুন্দর এক ভারসাম্য রেখেছেন। ফলে গান বা মেমোরি-লেনে হাঁটাহাঁটি, কোনোটাই অতিরিক্ত নয়। বেশ সুন্দর এক সামঞ্জস্যে শুরু থেকে সমাপ্ত হয় পুরো জার্নি। সত্তর মিনিটের এই টাইমলাইনের কোনো মুহুর্তই তাই অযাচিত মনে হয় না, অবান্তর মনে হয় না...

বাংলাদেশে 'ছাপাখানার ভূত' নামে এক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে। যাদের প্রকাশিত বেশকিছু বই আমার বেশ পছন্দের। অন্যতম পছন্দ- অঞ্জনযাত্রা। যে বইকে অঞ্জন দত্তের আত্মজীবনী বলা যেতে পারে, আত্মকথন বলা যেতে পারে কিংবা সাক্ষাৎকারও বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের সাংবাদিক সাজ্জাদ হুসাইন এ বই লেখার জন্যে অঞ্জন দত্তের সাথে চলে গিয়েছিলেন দার্জিলিং। অঞ্জন দত্তের বেড়ে ওঠা যেহেতু দার্জিলিং এ, তাই স্মৃতিরোমন্থনের জন্যে বেছে নেয়া হয়েছিলো এ জায়গাকেই। সেখানের কুচক্রি কুয়াশামাখা বাতাসে বসে অঞ্জন দত্ত খুলে দিয়েছিলেন অতীতের কথার ঝাঁপি। আর সেই কথাগুলোকেই দারুনভাবে বইয়ে তুলে এনেছিলেন সাজ্জাদ হুসাইন। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছিলাম বইটি। 

গতকাল চরকি'তে আসা 'আধখানা ভালো ছেলে আধা মস্তান' অনেকটা 'অঞ্জনযাত্রা' বইয়ের মত করেই উপভোগ করলাম। যেকোনো মানুষের আত্মজীবনী বা জীবনস্মৃতি আমাকে বেশ টানে। কোনো বইয়ের দোকানে গেলে প্রথমেই তাই চলে যাই 'আত্মজীবনী'মূলক বইগুলোর র‍্যাকে। সিনেমা দেখতে গেলেও একই জঁরার সিনেমা রাখি প্রথমে। যেসব মানুষকে দূর থেকে দেখি, তাদের নির্মাণের সাথে ওঠাবসা করি, সেই মানুষদেরই দুয়েকটা ব্যক্তিগত তথ্য যখন আচমকা চলে আসে সামনে, ভালো লাগে। অজানাকে জানার আনন্দ হয়।  অর্ণবকে নিয়ে মিউজিক্যাল ফিল্মটাও সে কারণেই ভালো লাগা।

এই মিউজিক্যাল ফিল্ম প্রথমেই ভালো লেগেছে এর বিন্যাসের কারণে। অর্ণবের গাওয়া বারোখানা গান যেমন আছে এখানে, তেমনি আছে গানের পেছনের ব্যক্তি অর্নবের গল্পও। স্টেজে আমরা যে মানুষকে দেখি, গানের অন্তরালে তারও যে কিছু বিষাদ আছে, সে বিষাদের নিদর্শন খানিকটা হলেও প্রকট হয় এখানে। যেটার কৃতিত্ব অবশ্যই নির্মাতা ও তার পুরো টীম পাবেন। স্ক্রিপ্টিং, এডিটিং, সিনেম্যাটোগ্রাফী...সব বিভাগই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করেছে। 

এই মিউজিক্যাল ফিল্মের নির্মাতা আবরার আতহার যে কাজটি করেছেন, অর্ণবের গান এবং স্মৃতিচারণ এর মাঝখানে বেশ সুন্দর এক ভারসাম্য রেখেছেন। ফলে গান বা মেমোরি-লেনে হাঁটাহাঁটি, কোনোটাই অতিরিক্ত না। বেশ সুন্দর এক সামঞ্জস্যে শুরু থেকে সমাপ্ত হয় পুরো জার্নি। সত্তর মিনিটের এই টাইমলাইনের কোনো মুহুর্তই তাই অযাচিত মনে হয় না, অবান্তর মনে হয় না। 

ব্যক্তি অর্ণবের গানের আমি ভক্ত। আমার জেনারেশনের যারা আছেন, তাদেরও অর্ণবের গান প্রিয় বলেই বিশ্বাস। এই শিল্পীর গান প্রথাগত চেনা সড়কে না হেঁটে মাঝেমধ্যেই উলটো রাস্তা ধরে। এবং এই উল্টোরাস্তা ধরার জন্যেই হয়তো গানগুলো হয়ে যায় স্বকীয়। আবার, গানগুলোর মতন অর্ণবের জীবনগল্পও স্বকীয়। তার জীবন-গল্পে হিন্দু বাবা, মুসলিম মা আছে। বাবা-মা'র ছাড়াছাড়ি আছে। শান্তিনিকেতনে সংগীতের মাঝখানে ডুবে যাওয়া আছে। সেখান থেকে ফিরে জনপ্রিয় হওয়া আছে। ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে গিয়ে আবার অদৃশ্য হওয়া আছে। শুকনো পাতায় আগুন জ্বেলে ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়া আছে।

হারিয়ে গিয়েছি এই তো জরুরি খবর! 

এসব টুকরো টুকরো গল্প ছেঁড়া মেঘের মত ভাসতে থাকে এই মিউজিক্যাল ফিল্মে। গান, এক বা একাধিক ঘটনার রোমন্থন, এরপরে আবার একটা গান, খানিকটা ব্যাকস্টোরি। কিছু স্বগতোক্তি। কিছু অভিযোগ। কিছু অপরাধ-স্বীকার। এভাবেই এগোনো। আমরা জানি, 'অর্ণব' শব্দের অর্থ সমুদ্র। আবার আমাদের অভিমান হলে কিংবা নিজের দোষ স্বীকার করতে হলে, আমরা প্রায়শ সমুদ্রেই যাই। এই মিউজিক্যাল ফিল্মেরও দৃশ্যায়ন করা হলো সমুদ্রতটে। সুদূরে অর্ণবের চাপা গর্জন, তারই সামনে ভেজা বালুতে দাঁড়িয়ে আরেক অর্ণব স্বীকারোক্তি জানালেন- 

আই হ্যাভ মেসড আপ মাই লাইফ।

একটা দৃশ্য এরকম- অর্ণব, সমুদ্রের সামনে একটা টুলে বসা। গিটারের টুংটাং, সাথে 'হারিয়ে গিয়েছি এই তো জরুরি খবর।' নিকটে ঢেউ এসে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। নিরন্তর সামুদ্রিক বাতাসের ঝাপটা। পেছনে অনেক দূরে একরাশ ঝাউবনের পেছনে নাগরিক বিল্ডিং। দুয়েকটা তলায় টিমটিমে আলো জ্বলছে। বাকিসব তলা স্তব্ধ। কেমন যেন থম মারা সময়। এই এক দৃশ্য যেন মেটাফোরিক্যালি বুঝিয়ে যায় অর্ণবের জীবনকেও। অর্ণব যখনই একাকীত্বে ভুগেছেন, আশ্রয় নিয়েছেন গানে। সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। হারিয়ে গিয়েছেন জনচক্ষুর আড়ালে। সেটাকেই জানান দেয় নিঃসীম সমুদ্রপাড়। একা অর্ণব। 'হারিয়ে গিয়েছি' গান। অর্ণবের জীবনকে এর চেয়ে দারুণভাবে পর্দায় তোলা আর কী যেতো?

কিছু বিষাদ হোক পাখি! 

'আধখানা ভালো ছেলে, আধা মস্তান' এর সত্তর মিনিটে ঘুরেফিরে কখনো শায়ান চৌধুরী অর্ণব এসেছেন। তার বাবা-মা এসেছেন। স্ত্রী সুনিধি নায়েক এসেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা যাদবপুর ইউনিভার্সিটি এসেছে। সরাসরি না এলেও গানের কথায় সাহানা বাজপেয়ী এসেছেন। শান্তিনিকেতন এসেছে। পাগলাটে ডুব্বাও এসেছে। সবমিলিয়ে এসেছে বহুকিছুই। তবুও যা এলো না অথচ আসা উচিত ছিলো, সেগুলোকে এবারের মতন উপেক্ষা করাই যায় হয়তো। কারণ, এ ঘরানার কাজ বাংলাদেশে হয় খুব কম। তাই নতুন এ কাজটিকে খানিকটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে খুব একটা তারতম্য হবে না বলেই বিশ্বাস। 

অর্ণব, সুনিধি, ডুব্বা! 

'আধখানা ভালো ছেলে, আধা মস্তান' এর মতো মিউজিক্যাল ফিল্ম বাংলাদেশে আরো হোক। বাংলাদেশে গুণী মানুষ আছেন অনেক। তাদের নিয়ে এরকম কাজ হোক। মানুষ তাদের সম্পর্কে জানুক। পর্দা বা মঞ্চের সামনে কয়েক মিনিট দেখেই কোনো মানুষকে বিচার করবার যে প্রবণতা আমাদের, তা স্তব্ধ হোক। পর্দার আড়ালের বিষাদের খানিকটুকুর ভাগিদার সাধারণ মানুষও হোক। তাহলেই হয়তো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কিংবা সহনশীলতা বাড়বে। এ বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর অস্থিতিশীল সময়ে দাঁড়িয়ে সেটাই মূলত কাম্য। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা