সম্পর্কের টানাপোড়েন: গেহরাইয়ান যেখানে প্রথম নয়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যারা এক 'গেহরাইয়া' দেখেই 'বলিউড রসাতলে গিয়েছে' বলে রব তুলেছেন, তারা ব্যভিচার, অনৈতিক সম্পর্ক-কেন্দ্রিক প্রাচীন এই সিনেমাগুলো দেখলে খানিকটা যে চমকে যাবেন, তা নিশ্চিত। নিজেদের মন্তব্যের জন্যে অনুতপ্তও হবেন হয়তো দুই একজন! এবং এই সিনেমাগুলোর সার্থকতা ঠিক সেখানেই!
শকুন বাত্রার বহুল প্রতীক্ষিত 'গেহরাইয়া' মুক্তি পেলো। সে সিনেমায় দীপিকার অভিনয়ে মুগ্ধ হলো অনেকেই। অল্প সময়ের জন্যে এসে মন ভরালেন নাসিরুদ্দিন শাহও। সম্পর্কের জটিলতার সাথে খানিকটা অন্যরকম টানাপোড়েন, মেটাফোরিক্যালি কিছু বিষয় এনে যে গল্প বলা হলো, তা বেশ উতরেও গেলো। তবুও, আলোচনার এত প্রসঙ্গ থাকা সত্বেও কিছু দর্শক পড়ে রইলেন কয়েকটি রগরগে দৃশ্য দিয়ে পুরো সিনেমা বিচার করে ফেলার পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকাণ্ডে। এমনই বিতর্ক উঠলো, অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, যেন এর আগে কোনো বলিউডি সিনেমায় শয্যাদৃশ্য দেখানো হয়নি, কিংবা, এর আগে কোনো সিনেমায় দীপিকা এরকম স্বল্পবসনে ক্যামেরার সামনে আসেননি। বা, এর আগে কোনো বলিউডি সিনেমার থিম হিসেবে 'ব্যভিচার' বা 'অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক'ও আসেনি!
যাই হোক, জনতা জনার্দনের এরকম উন্মাসিক আচরনের হেতু কী, কেন তাদের এ চাপানউতোর, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন৷ সে প্রসঙ্গ পিছিয়ে রেখে বরং কথা বলি, এমন কিছু বলিউডি সিনেমা নিয়ে যেসব সিনেমায় বারবারই এসেছে 'অনৈতিক যৌনাচার' বা 'ব্যভিচার' এর প্রসঙ্গ। এবং সবচেয়ে বড় বিষয়, যেসব সিনেমা মুক্তি পেয়েছে বহু বহু আগে।
১. সিলসিলা
সম্পর্কের জটিলতা এবং ব্যভিচার নিয়ে যদি একটি সিনেমা বাছাই করতে বলা হয়, তাহলে 'সিলসিলা' সেখানে বোধহয় সবার উপরেই থাকবে। অমিতাভ বচ্চন, জয়া বচ্চন, রেখা... অনসম্বল কাস্টের এ সিনেমার বিষয়বস্তু ও তারকাদের দুর্দান্ত অভিনয়... দুই মিলেই 'সিলসিলা' আলাদাভাবে অর্থবহ। যদিও তৎকালীন সময়ে এ সিনেমা ফ্লপ করেছিলো। কিন্তু, ফ্লপে কি আসে যায়? বহু বছর পরে এসে এ সিনেমা এখনও প্রাসঙ্গিক, অর্থবহ।
২. ইজাজত
সুবোধ ঘোষের গল্প 'যতুগৃহ' অবলম্বনে 'ইজাজত' নামের বিশেষ এ সিনেমাটি নির্মাণ করেন গুলজার। কমপ্লেক্স লাভ ট্রায়াঙ্গেল, সম্পর্কের টানাপোড়েন আর খুবই ম্যাচুরড এক ফিলোসোফি নিয়ে নির্মিত এ সিনেমায় নাসিরুদ্দিন শাহ, রেখা এবং অনুরাধা প্যাটেলের অভিনয়ও হয় দুর্দান্ত। দুটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও ঘরে তোলে সিনেমাটি।
৩. অর্থ
মহেশ ভাটের এ সিনেমায় উঠে এসেছে তার জীবনের কিছু অস্বস্তিকর অধ্যায়। অভিনেত্রী পারভীন ববির সাথে তার এক্সট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের সাত-সতেরো নিয়ে নির্মিত এ সিনেমাকে নির্মাতা মহেশ ভাটের 'আধা-আত্মজীবনী' বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হয়না। বিতর্কিত এক গল্প, সে গল্পে কুলভূষণ খারবান্দা, স্মিতা পাতিল, শাবানা আজমির মাল্টি-লেয়ারের অভিনয়...সব মিলিয়ে, অনবদ্য এক নির্মাণ 'অর্থ।'
৪. অস্তিত্ব
যদি কোনো পুরুষ অনৈতিক কোনো সম্পর্কে লিপ্ত হয়, সেটা সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যা না, কিন্তু যদি নারী এরকম কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তাহলেই দুনিয়া রসাতলে চলে যাবে...এরকম ন্যারেটিভের এক সামাজিক ব্যাধিকে উপজীব্য করে 'অস্তিত্ব' নামের এ বাই-লিঙ্গুয়াল সিনেমা নির্মাণ করেন মহেশ মাঞ্জরেকার। প্রোটাগনিস্ট চরিত্রে ছিলেন টাবু৷ টাবু অভিনয়ও করেন খোলতাই। পাশাপাশি, সময়ের সাপেক্ষে নির্মাণের গল্পটা এতটাই প্রোগ্রেসিভ হয়, তা হজম করতেও বেগ পায় অনেকে।
৫. লিবাস
থিয়েটার ডিরেক্টর সুধীর এবং তার স্ত্রী সীমার দাম্পত্যজীবন বেশ সুখেই কাটছিলো। কিন্তু আচমকাই শুরু হয় দমকা বাতাস। সুখী দম্পতির নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রবেশ করে তৃতীয় একজন মানুষ৷ গল্পের টানাপোড়েন তখন থেকেই শুরু। গুলজারের ছোটগল্প 'সীমা' অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমা খুব কমপ্লেক্স এক ইস্যু নিয়ে যেভাবে এগোয়, তা চমৎকৃত করে ক্ষণে ক্ষণে।
৬. মাসুম
আমেরিকান লেখক এরিখ সেগালের বই 'ম্যান, ওম্যান অ্যাণ্ড চাইল্ড' অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা 'মাসুম', শেখর কাপুরেরও অভিষেক সিনেমা। যে সিনেমায় সাম্যাবস্থায় থাকা একটি পরিবারে আচমকাই একদিন আবিষ্কৃত হয় এক অবৈধ সন্তানের অস্তিত্ব। এই আবিষ্কার থেকেই গল্প ক্রমশ যেতে থাকে একের পর এক সংকটে৷ অসাধারণ গল্প, নাসিরুদ্দিন শাহ এবং শাবানা আজমীর দুর্দান্ত অভিনয়... 'মাসুম' মনে রাখার মতই এক নির্মাণ!
৭. গৃহ প্রবেশ
বাসু চ্যাটার্জির সিনেমা 'অনুভব' কিংবা 'আবিষ্কার' যেরকম, অনেকটা সেরকমই 'গৃহ প্রবেশ' এর থিম হিসেবেও চলে আসে ব্যভিচারের প্রসঙ্গ। এবং কমপ্লেক্স এ গল্পের নির্মাণে সঞ্জীব কুমার, শর্মিলা ঠাকুর এবং সারিকার অভিনয়ও যেন গল্পকে সঙ্গত দিয়ে যায় দারুণভাবে৷
যারা এক 'গেহরাইয়া' দেখেই 'বলিউড রসাতলে গিয়েছে' বলে রব তুলেছেন, তারা উল্লেখিত এই সিনেমাগুলো দেখে থাকলে নিজেদের মন্তব্যের জন্যে অনুতপ্ত হতেন কি না, তা জানা নেই৷ তবে বহু আগে নির্মিত এ নির্মাণগুলো যেসব বিষয় নিয়ে ভেবেছে এবং যেভাবে দর্শককে ভাবিয়েছে, সেসবের সাপেক্ষে 'গেহরাইয়া' যে খুব একটা ভিন্ন কিছু নয় মোটেও, সেটাও ধ্রুবসত্যি৷ এবং প্রসঙ্গত বলাই যায়, যেহেতু এই নির্মাণগুলোর পরেও 'বলিউড' রসাতলে যায়নি, সে হিসেবে 'গেহরাইয়া' এখন এসেও যে রসাতলে নেয়ার সে কাজটি করতে পারবে না, হয়তো সেটাই এখন হতে পারে নিন্দুকদের জন্যে স্বস্তির নিদান!