চারটি গল্পের কোনোটিরই ব্যপ্তি বেশি না। কিন্তু মাথা খাটিয়ে ভাবতে বসলে, প্রত্যেকটি গল্পই অনেক কিছু ভাবাবে। অনেক কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা পাল্টাতে বাধ্য করবে। 'আজিব দাস্তানস' এর সার্থকতা এখানেই। মনোজগতে ধাক্কা দেয়ার কাজটি বেশ ভালোই করেছেন সিনেমার কারিগরেরা...

কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ জোরের সাথে বলছিলেন-

আগে গল্প লিখতাম। দেখি, গল্পের অডিয়েন্স বেশি না৷ এরপর মিডিয়াম চেঞ্জ করে নাটকে এলাম। নাটকের অডিয়েন্স গল্পের চেয়ে বেশি। একটু স্বস্তি পেলাম৷ পরে দেখলাম, সিনেমার অডিয়েন্স, নাটকের অডিয়েন্সের চেয়েও ঢের গুনে বেশি। চলে এলাম সিনেমায়। আমার গল্পের জন্যে বড় অডিয়েন্স দরকার৷ যদি কোনোদিন সিনেমার চেয়েও বড় মিডিয়াম পাই, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাবো৷ আমার কাছে মিডিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমা না।

এ কথা ঠিক, সিনেমার চেয়ে বড় অডিয়েন্স বর্তমানে আর কারো নেই৷ সে কারণেই হয়তো মেইনস্ট্রিম অর্থোডক্স ঘরানার বাইরেও কিছু পরিচালকের উদ্ভব হচ্ছে যারা সমাজ সংস্কারের নানা বার্তা ছড়াচ্ছেন সিনেমার মোড়কে। ভারতে এই চলটা ইদানীং বেশ বেড়েছে। মাসান, এ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ, নিউটন, আর্টিকেল ফিফটিন, আনপজড, জিন্দেগি ইন শর্ট, পাগলাইত- গল্পের মোড়কে কটাক্ষ করা হচ্ছে প্রাচীন সংকীর্ণ সব ধ্যানধারণাকেই। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন চারজন পরিচালক প্রশ্নবিদ্ধ করলেন সামাজিক কিছু অসুখকে, 'আজিব দাস্তানস' নামক সিনেমার মাধ্যমে।

চারজন পরিচালকের চারটি গল্প নিয়ে গোটা সিনেমা। এই চারটি গল্প চার ধাঁচের। ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের। যদিও এই স্ট্রাকচারের সিনেমাগুলো বানানোর ক্ষেত্রে একটু রিস্ক থেকেই যায়৷ কারণ, কোনো একটা গল্প সামান্য দূর্বল হলেই গল্পের বাদবাকি গল্পগুলোর অতটা প্রচার-প্রসার হয় না। তবুও পরিচালকেরা সে রিস্ক নিয়েছেন। চতুষ্কোণ গল্পে সাজিয়েছেন ন্যারেশন। 

'মজনু' গল্প দিয়ে শুরু সিনেমা। গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই, বিশাল প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বাসরঘর৷ যিনি তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী কে জানাচ্ছেন, এই বিয়েতে তিনি সুখী নন। তিনি যাকে ভালোবাসতেন, তাকে তিনি বিয়ে করতে পারেনি, সমাজের চাপে। এই বিয়ে তাই অনেকটাই দেখনদারি-সর্বস্ব৷ 

আমরা, দর্শকেরা, এই দৃশ্য থেকেই নড়েচড়ে বসি। বুঝতে পারি, প্রেম-বিচ্ছেদ-অভিযোগ-আপোষকামীতার  কোনো গল্পই হয়তো দেখবো। কিন্তু গল্প হুট করেই মোড় নেয় অন্যদিকে। গল্পের শেষটা হয় লোভ, লালসা, প্রতিহিংসার অপ্রত্যাশিত এক টুইস্ট দিয়ে। যদিও সিনেমার চারটি গল্পের মধ্যে এই গল্পটাই কম জোরালো লেগেছে। গল্পের ডিউরেশনের চেয়ে বেশি কন্টেন্ট থাকায় খানিকটা ভজঘটও পাকিয়ে গিয়েছে শেষটায়। ভালো দিক বলতে, 'পাতাল লোক'খ্যাত জয়দীপ আহলাওয়াত ভালো অভিনয় করেছেন। আবার, বিপরীতে, ফাতিমা সানা শেখ ভুলভাল অভিনয়ে দক্ষতা দেখিয়েছেন। অভিনয়ে তার অপরিপক্ক আচরণ কাটেনি আজও। 

দ্বিতীয় গল্প- খিলুনা। খেলনা। এই গল্পটা একটু অন্যরকম। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, দুই বোনের গল্প এটি। বড় বোন বাড়িতে বাড়িতে ঠিকেঝি'র কাজ করে। আর ছোট বোন খুবই ছোট। স্কুলে পড়ে। এই দুই বোন মাঝেমধ্যেই নানা কারসাজি করে বড়লোকদের বাড়ি থেকে হাতিয়ে নেয় নানা কিছু। নিজেদের স্বার্থে।  বেঁচে থাকার তাগিদে। সমাজের উঁচুশ্রেণীর মানুষকে আঁকড়ে বেঁচে থাকে তারা৷ তাদের এই গল্পে যুক্ত হয় এক ইস্ত্রিওয়ালা। সে সাথে যুক্ত হয় আরো কিছু মানুষও।

হিংসা মানুষকে যে কতটা আগ্রাসী করতে পারে তার বেশ ভালো একটা দৃশ্যায়ন এ গল্প। উইলিয়াম গোল্ডিং এর 'লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ' গল্পের সাথে বেশ ভালো মিল পেলাম চরিত্রের অন্তিম ঘটনা-দুর্ঘটনায়। মানব-চরিত্রের অন্ধকারতম প্রবৃত্তির অন্যতম একটি; ঈর্ষা'র নগ্ন প্রদর্শনী 'খিলুনা।' যদিও গল্পটার ন্যারেশন স্টাইল নিয়ে আরেকটু কাজ করার ছিলো৷ শেষে চমক রাখতে গিয়ে পরিচালক প্রথম অংশে বলতে গেলে খানিকটা কক্ষপথচ্যুতই ছিলেন! 

তৃতীয় গল্প- গিলি পুচ্চি। ভেজা চুম্বন৷ এ গল্পের শর্ট ডিউরেশনের মধ্যেও অনেক কিছুকে নিয়ে এসেছেন পরিচালক৷ এবং প্রত্যেকটি জিনিসই এসেছে বেশ ছিমছামভাবে৷ জাতপাত, সমকামিতা, মাতৃত্ব, পারিবারিক সংস্কার বলয়... ডেঞ্জারাস সব থিম একসাথে এনে দারুণ এক মাল্টি-লেয়ারড গল্প উঠে এসেছে এখানে। 

এবং এ গল্পে একাই বাজিমাত করেছেন কঙ্কনা সেনশর্মা৷ দলিত সমাজ থেকে উঠে আসা এক শ্রমিক তিনি। যিনি দক্ষতা থাকা সত্বেও পান না কাজের ভালো সুযোগ৷ পদে পদে হন অপদস্থ।  বোল্ড, ওয়াইল্ড, অ্যাগ্রেসিভ এক চরিত্রে কী অসাধারণই না করলেন কঙ্কনা!  দুর্দান্ত। অদিতি রাও হায়দারিও চেষ্টা করেছেন কঙ্কনার সাথে তাল মেলাবার। তাল খুব যে একটা মিলেছে, তা অবশ্য বলা যাবে না। কঙ্কনা একাই টেনেছেন পুরোটা। তবু গল্পটা অনবদ্য। বাকিদের অভিনয়ের ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়াই যায়। 

চতুর্থ গল্প- আঁখি৷ বলা হয়ে থাকে- শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। অথবা, শেষপাতে দই।অর্থাৎ, শেষটা ভালো দেয়ার বা ভালো পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সবার, সার্বজনীন। সে জন্যেই হয়তো, শেষ গল্পটা হয়ে রইলো দুর্দান্ত৷ এই একটা গল্পের জন্যেই 'আজিব দাস্তানস' দেখা যেতে পারে বহুবার৷ 

শেফালি শাহ আর মানভ কল...এই দুইজন দুঁদে আর্টিস্ট কী অভিনয়ই না করলেন! 'দিল্লী ক্রাইম' বা 'ওয়ান্স অ্যাগেইন' এর শেফালি শাহ'তে মুগ্ধ হলাম আবার। মানভ কল এর কথা আলাদা করে কী বলা যায়! কয়েকদিন আগেই 'নেইলপলিশ' সিনেমাতে দুর্দান্ত অভিনয়ের পরে এখানে আবার আরেক স্নিগ্ধ অভিনয়৷ জাত অভিনেতা বলে কথা। 

কথায় আছে- ভালোবাসা সুখ, ভালোবাসা অসুখ। সেই কথারই যেন এক মোলায়েম গল্প 'আঁখি।' চোখের ভাষা, মুখের ভাষা, মনের ভাষা... সব একাকার হয়ে গেলে ভালোবাসার বয়স-গাছ হারিয়ে ফেলে দিকজ্ঞান৷ ঘোরগ্রস্থ মানুষের মত ছুটতে থাকে এদিক-সেদিক। মূর্ত সবকিছুই ক্রমশ বিলুপ্ত হয় বিমূর্তের স্রোতে! এই গল্পটা দিয়েই যদি পুরো সিনেমা হতো, আরেকটা 'ওয়ান্স অ্যাগেইন' হয়তো হতেই পারতো! হলো না, সেটা অবশ্যই এক আক্ষেপ। 

মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন সিনেমার এই চরিত্রেরাও! 

ঋত্বিক ঘটকের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার কথা দিয়েই শেষ করি। 'মেঘে ঢাকা তারা'খ্যাত পরিচালক একবার দিয়েছিলেন এক অমোঘ উক্তি- 

'ভাবো, ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো।' 

এই সিনেমা দেখার পরে ঋত্বিকবাবুর এই উক্তির যথার্থতা উপলব্ধি করা যাবে আরো ভালোভাবে। চারটি গল্পের কোনোটিরই ব্যপ্তি বেশি না। কিন্তু মাথা খাটিয়ে ভাবতে বসলে, প্রত্যেকটি গল্পই অনেক কিছু ভাবাবে। অনেক কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা পাল্টাতে বাধ্য করবে। 'আজিব দাস্তানস' এর সার্থকতা এখানেই। মনোজগতে ধাক্কা দেয়ার কাজটি বেশ ভালোই করেছেন সিনেমার কারিগরেরা।

সমাজের গৎবাঁধা, জংধরা ন্যারেটিভ ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে এই টালমাটাল সময়ে এই সিনেমা হয়ে থাকবে শক্তপোক্ত এক অনুঘটক হিসেবে। এ ধরণের সিনেমার এখন দারুণ প্রয়োজনও। এই সিনেমার মূল বার্তা যদি দশজন মানুষও উপলব্ধি করে, তাও তো অনেক। সার্থকতা তো সেখানেই।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা