ফিল্মি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসেছেন তিনি, 'নেপো-কিড' তকমাটা তাই জুড়ে গেছে নামের সঙ্গে। কিন্ত নেপোটিজমের সেই ট্যাগ ছুঁড়ে ফেলে নিজের অভিনয় প্রতিভা আর পরিশ্রমের জোরে আলিয়া হয়ে উঠেছেন বি-টাউনের অবিসংবাদিত রানী...

২০১২ সালে পুরোদস্তুর অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন মহেশ ভাট কন্যা আলিয়া ভাট। আর আজ ক্যারিয়ারের নবম বছরে এসে এই ২০২১ সালে তিনি বলিউডের অন্যতম সেরা জনপ্রিয়, দক্ষ এবং সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া একজন অভিনেত্রী। বলিউডের প্রায় সব প্রথম সারির পরিচালক প্রযোজকদের মতে আলিয়া আগামী দিনের বলিউডের সবচেয়ে বড় তারকা অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছেন। এবং নেপোটিজম ট্যাগ পাশ কাটিয়ে নিজের অভিনয় প্রতিভার জোরে সেই ভবিষ্যৎবানী সত্য করার পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। গতকা ১৫ই মার্চ ছিল এই বলিউড ডিভার জন্মদিন, তাই রইলো তাকে নিয়ে স্পেশাল একটি ফিচার। 

শুধুমাত্র সৌন্দর্য্য বা পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের জোরে নয় আলিয়া তার অভিনয় দক্ষতা এবং ভিন্নধর্মী সিনেমা, শক্তিশালী চরিত্র নির্বাচন দিয়ে নিজেকে দিন দিন নিয়ে যাচ্ছেন এক অন্যন্য উচ্চতায়। আলিয়ার শুরুটা নিজেদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বলিউডের সুপ্রতিষ্ঠিত ভাট ফিল্মসের মাধ্যমে নয়। বলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজক এবং পরিচালক করন জোহর এবং বলিউড কিং শাহরুখ খানের প্রযোজনায় 'স্টুডেন্ট অব দ্যা ইয়ার' দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন আলিয়া। করন জোহরের পরিচালনায় বরুন ধাওয়ান এবং সিদ্ধার্থ মালহোত্রার সাথে জুটি বেধে প্রথম সিনেমা সুপারহিট। সাথে নিজের সৌন্দর্য্য এবং অভিনয় দক্ষতার ঝলক,এবং নৃত্য পারদর্শীতা দিয়ে নজর কাড়েন তিনি। ফলাফল সেই বছর সেরা নবাগতার সকল পুরস্কার তার ঝুলিতে আসে। 

দ্বিতীয় সিনেমা বলিউডের অন্যতম সেরা পরিচালক ইমতিয়াজ আলীর 'হাইওয়ে'। প্রথম সিনেমায় ধনীর আদুরে দুলালী, ডিজাইনার ড্রেস, রোমান্টিক নায়িকার ইমেজ থেকে বেরিয়ে 'হাইওয়ে' সিনেমায় পুরোপুরি এক অন্য চরিত্রে দেখা দেন তিনি। মেকাপ ছাড়াই স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত একটি কিশোরীর চরিত্রে ভাটের অভিনয় চলচ্চিত্র সমালোচকদের নিকট ইতিবাচক মন্তব্য লাভ করেন তিনি, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য ফিল্মফেয়ার সমালোচক পুরস্কারও জিতে নেন। প্রথমে স্টারকিড হিসেবে নেগেটিভ মন্তব্য করলেও বলিউডের সমালোচক এবং সাধারন দর্শকেরা নড়েচড়ে বসেন এবার। অভিনেত্রী হিসেবে আলিয়া যে পরিপক্ক এবং তিনি রাজত্ব করতে এসেছেন বলিউডে তা প্রমান করেন এই সিনেমার মধ্য দিয়েই। 

হাইওয়ে সিনেমায় আলিয়া ভাট

এরপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার। 'টু স্টেটস', 'বদ্রিনাথ কি দুলহানিয়া', 'হাম্পটি শর্মা কি দুলহানিয়া' 'কাপুর এন্ড সন্স' আলিয়া বক্স অফিসে নির্ভরযোগ্য দক্ষ তারকা অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমান করেন।  মাঝে 'শানদার' সিনেমায় অভিনয় করে সমালোচিত হলেও তারপরেই 'ডিয়ার জিন্দেগী' সিনেমায় এই যুগের এক স্বাধীনচেতা নারী যে নিজের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে জীবন-যাপন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা একজন মানুষ এবং 'উড়তা পাঞ্জাব' সিনেমায় এক আদিবাসী ভারতীয় কিশোরীর চরিত্রে অভিনয় করে বলিউডের এই প্রজন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার এবং জনপ্রিয়তা সবই লাভ করেন তিনি। 

২০১৮ সালে মেঘনা গুলজারের 'রাজি' সিনেমায় 'শেহমত' নামের এক গুপ্তচরের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় একজন এজেন্ট হিসেবে পাকিস্তানি এক সেনা অফিসারকে বিয়ে করে পাকিস্তানে চলে যাওয়া এবং সেখান থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভারতে পাঠানো এক গুপ্তচর হিসেবে তিনি এককথায় স্তব্ধ করে দিয়েছেন আলিয়া। নারীকেন্দ্রিক এই সিনেমা বক্স অফিসে ১০০ কোটির ক্লাবে জায়গা করে নেয়। একা নিজের কাঁধে ভর করেই এই সিনেমাকে টেনে নিয়েছেন তিনি। অভিনেত্রী হিসেবে তার এই চরিত্র বলিউডের এই প্রজন্ম তো বটেই নারীপ্রধান যে কয়টি সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা একটি কাজ বলে বিবেচিত হয়। 

২০১৯ সালে জোয়া আখতারের 'গাল্লি বয়' সিনেমায় রনভীর সিংহের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেন তিনি। স্বল্প সময়ের জন্য তাকে এই সিনেমায় দেখা গেলেও তার লুক, ড্রেস আপ, চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়া এবং ডায়লগ ডেলিভারি তাকে এনে দিয়েছে প্রশংসা এবং খ্যাতি। তবে এই সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে বির্তকের সূচনাও হয়েছিলো। যদিও এই সিনেমাও ১০০ কোটির ক্লাবে এন্ট্রি নিয়ে নেয়। এই সিনেমা নিয়ে আলিয়ার চারটি সিনেমা ১০০ কোটির ক্লাবে জায়গা করে নিলো। টু স্টেটস, বদ্রিনাথ কি দুলহানিয়া, রাজি এবং গাল্লি বয়। স্বাভাবিক ভাবেই আলিয়া বক্স অফিসের এই সময়ের সবচেয়ে সফল নায়িকাদের একজন, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। 

তবে তারকাদের সব সময় এক রকম যায় না এটাও ধ্রুব সত্য। বলিউডে প্রতি শুক্রবার সমীকরন বদলায়৷ ধর্ম প্রোডাকশনের বিগ বাজেটের মাল্টিস্টারার 'কলঙ্ক' সিনেমা বক্স অফিস ডিজাস্টার হিসেবে গন্য হলেও মাধুরী, সঞ্জয়, বরুন, সোনাক্ষী, আদিত্য এর মতো তারকাদের মাঝেও নিজের অস্তিত্ব বেশ ভালোভাবেই দেখিয়েছেন আলিয়া। বিশেষ করে ‘ঘর মোরে পারদেশিয়া’ গানে তার ক্ল্যাসিক ঘরানার নৃত্য পারদর্শীতা মুগ্ধ করেছে সবাইকে। ২০২০ সালে সুশান্ত সিং রাজপুত এর মৃত্যুর পর পুরো বলিউড যখন নেপোটিজম ইস্যুতে বিভক্ত এবং সাধারণ দর্শকদের এই ইস্যু বিভক্তিতে ফেলে তখন যে কয়জন তারকার দিকে আঙুল উঠেছিলো স্টারকিড হিসেবে সুবিধা পাওয়ার তালিকায় সেখানে তার নামও ছিলো। হয়তো সেই রেশ ধরেই বাবা মহেশ ভাটের পরিচালনায় ‘সড়ক ২’ সিনেমা ওটিটিতে রিলিজ দেয়া হলেও দর্শক গ্রহন করেননি। 

ডিয়ার জিন্দেগিতে কায়রা হয়ে আলো ছড়িয়েছেন পর্দায়

তবে আলিয়া ভাট নীরব থেকেছেন প্রতিটা সময়। কারন তিনি জানতেন একমাত্র তার কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং পরিশ্রম একটা সময় এসব প্রশ্নের সমুচিত জবাব দিবে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হয়েছেও তাই। কিছুদিন আগে সঞ্জয় লীলা বানসালীর পরিচালনায় ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাদি’ সিনেমার টিজারে তার লুক, দক্ষ অভিনয়ের ঝলক এবং শক্তিশালী ডায়লগ ডেলিভারি তার কঠোর সমালোচকেও আলিয়ার সুনাম করতে বাধ্য করেছে। তারকাদের পাশাপাশি সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি। এই সিনেমা মুক্তি পাবার পর অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন তিনি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। 

সামনে মুক্তির অপেক্ষায় অয়ন মূখ্যার্জির পরিচালনায় সাই-ফাই ফ্যান্টাসি সিনেমা 'ব্রক্ষ্মাস্ত্র'। বলিউডের বিগ বাজেটের এই সিনেমায় রনবীর কাপুর, অমিতাভ বচ্চন আছেন তার সাথে। এছাড়াও মোঘলদের রাজত্বের সময়কার গল্প নিয়ে করন জোহরের 'তখত’, অরুণিমা সিনহার বায়োপিক সহ একাধিক সিনেমা আছে পাইপলাইনে। 

গতকাল তার জন্মদিন উপলক্ষে দক্ষিণের ‘বাহুবলী’খ্যাত নির্মাতা এস. এস. রাজামৌলির নতুন সিনেমা ‘আর আর আর’ বা ‘ট্রিপল আর’ সিনেমায় তার লুক প্রকাশ করা হয়েছে। বহুল প্রতীক্ষিত এই সিনেমায় আলিয়ার বিপরীতে অভিনয় করবেন দক্ষিণের জনপ্রিয় অভিনেতা রামচরণ এছাড়া আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন দক্ষিনের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা জুনিয়র এনটিআর। এছাড়া একটি বিশেষ চরিত্রে দেখা যাবে অজয় দেবগণকে। প্রায় চারশো কোটি রুপি বাজেটের এই সিনেমা বেশক'টি ভাষায় রিলিজ পাবে। পোস্টারে তার লুক প্রকাশের পাশাপাশি জানা গেছে ‘সীতা’ নামের চল্লিশ দশকের এক দক্ষিন ভারতীয় নারী চরিত্রে দেখা যাবে তাকে। 

আরআরআর সিনেমায় আলিয়ার লুক

সব মিলিয়ে বলা যায় ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটাচ্ছেন ভাট কন্যা। আলিয়া ভাট ১৯৯৩ সালের ১৫ মার্চ ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জনপ্রিয়  চলচ্চিত্রকার মহেশ ভাট এবং মা অভিনেত্রী সোনি রাজদান। বোন পূজা ভাট, চাচাতো ভাই পরিচালক মোহিত সুরী, আরেক ভাই জনপ্রিয় নায়ক ইমরান হাশমী। তবে পরিবারের কারো কাছ থেকেই ক্যারিয়ার জীবনে কোনো সাপোর্ট তিনি নেননি। অভিনেত্রী হবার শখ ছিল ছোটবেলা থেকেই। তাই নিজেকে তৈরী করেছেন সেভাবেই। নাচ শিখেছেন, আবৃত্তি এবং বই পড়া তার অন্যতম শখ। 

তবে পাকাপোক্ত ভাবে বলিউডের অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এখনো চেস্টা বা এক্সপেরিমেন্ট করতে কোনো ক্লান্তি বা বিরতি নেই তার। কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে আলিয়া বলেন, "বলিউড এখন আমার ধ্যান-জ্ঞান। অনেকেই বলেন আমি ভালো অভিনয় করতে পারি, কিন্তু আমার মনে হয় আমার শেখার এখনো অনেক কিছুই বাকি। আমি প্রতিদিনই নতুন নতুন কিছু শিখছি। ভবিষ্যতে আমি যেন বলতে পারি,  আমি একজন ভার্সেটাইল অভিনেত্রী, সব ধরনের চরিত্রে আমি অভিনয় করতে পারি। এই কনফিডেন্স নিজের মধ্যে আনার জন্য চেস্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।'' 

খ্যাতি এবং সফলতার শিখরে থেকেও এই ২৮ বছর বয়সী অভিনেত্রী  সহজ এবং স্বাভাবিক ভাবে নিজেকে ব্যক্ত করেন সবসময়। বলিউডের এই প্রজন্মের আরেক সুপারষ্টার রনবীর কাপুরের সাথে তার প্রেম নিয়ে গুঞ্জন ছিলো এখন সেটি দুজনেই স্বীকার করেছেন। সামনেই হয়তো বিয়ের পিড়িতে বসবেন তারা। নিজের  বুদ্ধিমত্তা, অভিনয় প্রতিভা, সৌন্দর্য্য এবং ব্যক্তিত্ব তাকে নিয়ে যাবে আরো উচ্চতায় এমনটাই আশা তার ভক্তদের। জন্মদিনে শুভকামনা রইলো বলিউডের এই সময়ের সেরা দক্ষ অভিনেত্রীর জন্য।

আরও পড়ুন- ফ্রম শানায়া টু গাঙ্গুবাই: অ্যান এপিক ট্রান্সফর্মেশন অফ আলিয়া ভাট!!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা