বলিউড কেন নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়াকে শুধু বাণিজ্যের উপকরণ হিসেবেই দেখে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
'আনেক' সিনেমার নির্মাতা অনুভব সিনহা যদি সত্যিই 'নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া'কে প্রায়োরিটি দিতেন, সত্যিই বুঝতে চাইতেন এই এলাকার গল্প, তাহলে এই অঞ্চলের অধিবাসী কাউকে দিয়ে অভিনয় করানো খুব কঠিন কিছু ছিল না। মিনিমাম যে রিসার্চগুলো একটা সেন্সেটিভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সিনেমা থেকে প্রত্যাশা করে দর্শক, সেগুলো ঠিকঠাকভাবে পূরণ করাও অসাধ্য ছিলোনা। কিন্তু সেসবের কিছু হয়নি এ সিনেমায়। একইভাবে ম্যারি কম সিনেমাতেও প্রিয়াঙ্কার জায়গায় কাস্ট হতে পারতেন স্থানীয় কোন অভিনেত্রী...
বলিউডের সাথে ভারতের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির খুব কমন একটা পার্থক্য হচ্ছে- অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি যখন সময়ের সাথে সাথে নিজেদের ভাঙ্গছে, প্রতিদিনই নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে, বলিউড এখনও পড়ে আছে শর্টকাটে হিটের ধান্ধায়। হয় হিট মুভির রিমেক, অথবা, স্টেরিওটাইপ প্যাটার্ণের একের পর এক কাজ... মূলত, এই দুই চেনাপরিচিত আবর্তেই আটকে আছে তারা। অবশ্যই এখানে ব্যতিক্রমও আছে। তবে সংখ্যাগুরুদের তুলনায় তারা এতটাই ক্ষুদ্র, তারা ধর্তব্যও না৷ অধিকাংশ ফিল্ম-মেকারদেরই এখানে চিন্তা থাকে- দর্শককে খানিকটা বোকা বানিয়ে, একই গৎবাঁধা টুলস এনে ব্লেন্ড করে কিছু বানালে... দর্শক হয়তো রা কাড়বে না। এই জগাখিচুড়ি হাসিমুখে গিলে খাবে। কিন্তু, এখানের নির্মাতারা যে জিনিসটি বরাবরই ভুলে যান, সেটি হচ্ছে- আজকালের দর্শক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, তথ্যপ্রযুক্তি-সত্যমিথ্যা-সাদাকালো, সবকিছুই তার হাতের মুঠোয়। ফলে, যা কিছু গছিয়ে দিলেই দর্শক সেটিকে মেনে নেবে... এই ন্যারেটিভ শুধু যে ভুল, তা-ই না। অনেকক্ষেত্রে সুইসাইডালও। যেটার মাশুলই মূলত এখন দিচ্ছে বি-টাউন।
কিভাবে মাশুল দিচ্ছে, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসি। বরং, ক্রমশ ঢুকি অন্য আরেক বিষয়ে। বিষয়টির নাম- ইনক্লুসিভ ফিল্ম। 'ইনক্লুসিভ ফিল্ম' বলতে আমরা সোজা বাংলায় ধরে নিতে পারি এমন সিনেমাকে, যে সিনেমায় একটা নেপালী চরিত্র রাখা হলে, সে চরিত্রে একজন নেপালী মানুষকেই কাস্ট করা হবে৷ মায়ানমার থেকে আনা কাউকে 'নেপালী' হিসেবে চালানো হবেনা। অর্থাৎ, যেখানে যে চরিত্রে যাকে প্রয়োজন, তাকেই আনা হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি- 'জলসা' সিনেমার কথা। বিদ্যা বালান আর শেফালী শাহ'র এ সিনেমায় বিদ্যা বালানের ছেলে যে থাকবে তার সেরেব্রাল পালসি থাকার কথা লেখা ছিলো স্ক্রিপ্টে। এবং, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে- 'সেরেব্রাল পালসি'তে আক্রান্ত একজনকেই অভিনয় করতে আনা হয়েছিলো এ সিনেমার বিশেষ এ চরিত্রে। যেমনটা দেখি, ওয়েব সিরিজ 'পাতাল লোক'এও। যেখানে 'ট্রান্সজেন্ডার' চরিত্রে আসলেই এক 'ট্রান্সজেন্ডার মানুষ'কে কাস্ট করা হয়েছিলো।
এই প্রসঙ্গ থেকেই এবার আসি, আয়ুষ্মান খুরানার সাম্প্রতিক সিনেমা 'আনেক' এর প্রসঙ্গে। এ সিনেমা নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার কন্ট্রোভার্সাল কনফ্লিক্ট নিয়ে ডিল করবে, জানতাম। মূলত, এই ইস্যুটাই ছিলো সিনেমার সেলিং আইটেম। সুতরাং, এটাকে কেন্দ্র করেই হয়েছে অধিকাংশ মার্কেটিং। তাছাড়া, ডিরেক্টর অনুভব সিনহা এবং লিড কাস্টে আয়ুষ্মান খুরানা থাকায়ও বেশ ভরসা পাচ্ছিলাম। এই জুটির আগের সিনেমা 'আর্টিকেল ফিফটিন' এ তারা যেভাবে দলিত সম্প্রদায়ের উপর বৈষম্যের নানা সেনসিটিভ ও প্যাথেটিক সিনারিও তুলে এনেছিলো পর্দায়... সেখান থেকেই ধারণা জন্মেছিলো- হয়তো এই সিনেমাও সেরকম কিছু অর্থোডক্স মেন্টালিটির গোড়া ধরে নাড়া দেবে তারা। আশাবাদী হচ্ছিলাম।
যদিও, সিনেমা দেখার পরে আশা হতাশায় রূপান্তরিত হতে সময় লাগেনি। বলা ভালো, অনুভব সিনহা খানিকটা যেন হতাশই করেছেন৷ সেই হতাশার প্রথম কারণ- নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়াকে কেন্দ্র করে বানানো সিনেমায় এমন একজনকে ওয়ান অফ দ্য লিডস বানানো হয়েছে, যিনি কি না নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ারই অধিবাসী না! হ্যাঁ, আন্দ্রেয়া কেভিচুসার কথাই হচ্ছে। যিনি জন্মসূত্রে নাগাল্যান্ডের মানুষ। এবং, প্রশ্ন উঠেছে ঠিক এখানেই। এমন তো না যে, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার মানুষেরা অভিনয় পারেনা৷ বরং সত্যি এটাই, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার অনেক অভিনয়শিল্পী আছেন, যারা ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা'র নিয়মিত মুখ! ঠিক এই প্রসঙ্গে এসেই চাপানউতোর বেড়েছে। কেন নর্থ ইস্টের কোনো মানুষের বদলে নাগাল্যান্ডের একজনকে করা হলো এই অঞ্চলের বাসিন্দা, করা হলো অন্যতম প্রোটাগনিস্ট... সে প্রশ্নও ছুঁড়েছেন কেউ কেউ। এবং, এই প্রশ্নবানে যখনই বিদ্ধ হয়েছে এ সিনেমা, সিনেমাটা আপেক্ষিকতা হারিয়েছে ঠিক তখনই। পাশাপাশি, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার কনফ্লিক্ট যখন দেখানো হচ্ছে, তা করতে গিয়ে ঐ অঞ্চলের সব জায়গাকেই জেনারেলাইজ করা হয়েছে। ভাষার বৈচিত্র্য, জাতি-উপজাতিদের বর্ণময়তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেনি কিংবা লেশমাত্রও কাজও করেনি সিনেমার গোটা টিম।
অর্থাৎ, প্রমাণিত এটাই, 'নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া'র কনফ্লিক্ট নিয়ে সিনেমা বানানোর এই যে বিষয়, এখানে এই 'অঞ্চল'কে শুধুমাত্র বাণিজ্যের উপকরণ হিসেবেই দেখেছেন নির্মাতা। আর কিছুই না। যদি ডিরেক্টর অনুভব সিনহা সত্যিই 'নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া'কে প্রায়োরিটি দিতেন, সত্যিই বুঝতে চাইতেন এই এলাকার গল্প, তাহলে এই অঞ্চলের অধিবাসী কাউকে দিয়ে অভিনয় করানো খুব কঠিন কিছু ছিলোনা। মিনিমাম যে রিসার্চগুলো একটা সেন্সেটিভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সিনেমা থেকে প্রত্যাশা করে দর্শক, সেগুলো ঠিকঠাকভাবে পূরণ করাও অসাধ্য ছিলোনা। এবং, ঠিক এখানে এসেই যেন প্রমাণিত হয়েছে, এই সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষের দায়সারা মানসিকতা। কাউকে একজন আনলেই হলো, একজনকে দাঁড় করিয়ে দিলেই হলো, যা খুশি দেখালেই হলো, দর্শক আর কি বুঝবে... মূলত, এই দায়সারা মানসিকতাই প্রচ্ছন্নে থেকে 'আনেক'কে ডুবিয়েছে পুরোপুরি। যার ফলাফল এসেছে বক্স অফিসেও।
বলিউডে এরকম দায়সারা মানসিকতার সিনেমা এই যে প্রথম, এমন না। বরং, বলা ভালো, উদাহরণ দিতে বসলে 'ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়' হওয়ারই উপক্রম হবে। এই মুহুর্তে 'মেরি কম' এর কথা মনে পড়ছে। যেখানে মনিপুরের মেয়ে 'মেরি কম' চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নর্দান ইন্ডিয়ার মেয়ে 'প্রিয়াঙ্কা চোপড়া।' এই ঘটনা নিয়েও জলঘোলা কম হয়নি। একসময়ে এসে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নিজেই স্বীকার করেছিলেন-
মেরি কম চরিত্রে আমার অভিনয় করা ঠিক হয়নি। এই চরিত্রে মনিপুরী কাউকে আনলেই বেশি ভালো হতো।
সুজাত সওদাগরের একটা সিনেমা আছে 'রক অন টু' নামে। এ সিনেমার শুটিং হয়েছিলো সিকিমে। এবং, মজার ব্যাপার হলো, এ বলিউডি সিনেমার প্রায় আড়াই ঘন্টার রানটাইমে একজন লোকাল মানুষকেও রাখা হয়নি সিনেমার কাস্টে! অর্থাৎ, বোঝা গেলো এটাই, 'নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া' বলিউডি নির্মাতাদের কাছে থেকে গিয়েছে শুধুমাত্র একটা জায়গা হিসেবে। একটা শুটিং স্পট হিসেবে। কোনো এক অঞ্চলও যে গল্প হয়ে উঠতে পারে, তাকেও যে ক্যারেক্টার বানানো যেতে পারে, সেই জায়গা নিয়েও যে গবেষণা হতে পারে, সেটা ভারতের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি বুঝলেও কেন যেন বোঝেনি খোদ বলিউডই!
স্ট্রিমিং সাইট 'অ্যামাজন প্রাইম' এ ' দ্য লাস্ট আওয়ার' নামে এক ওয়েব সিরিজ এসেছিলো, সেখানে কয়েকটা দৃশ্য ছিলো এরকম- যেখানে সিকিমের লোকাল মানু্ষ নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার বদলে কথা বলছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে। মাস অডিয়েন্সকে কানেক্ট করার জন্যেই যে রিজিওনাল ল্যাঙ্গুয়েজকে বাদ দেয়া হয়েছে, তা নাহয় বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যে পুরো নির্মাণের অ্যাটমোস্ফিয়ারই 'ফেক' হয়ে গিয়েছে, এটা কি বোঝেনি সংশ্লিষ্টরা? আর, সবকিছুতেই হিন্দি আনতে হবে, সবাইকে দিয়েই হিন্দি বলাতে হবে... বলিউডের এই ন্যারেটিভও যে আজকাল কতটা দৃষ্টিকটু, তা কি বলিউডের মানুষজন জানে?
এবং, এসব অর্থোডক্স মেন্টালিটি থেকে না বেরোনোর কারণেই মূলত 'আনেক' অনেক প্রত্যাশা জাগালেও দিনশেষে করেছে হতাশ। কারণ, ঐ একটাই৷ দর্শকেরা এখন প্রচণ্ড সচেতন। তারা এখন শুধু দেখার জন্যেই দেখে না। শেখার জন্যেও দেখে। জানার জন্যে দেখে। তাই, এই সচেতন দর্শককে মেয়াদোত্তীর্ণ ঝালমশলার মশলামুড়ি বানিয়ে খাওয়াতে গেলেই যে সিদ্ধিলাভ হবেনা, 'আনেক' এর সাম্প্রতিক ভরাডুবিই বোধহয় সেটার প্রমাণ। এবং, বলিউড যদি এখান থেকেও না শেখে, অর্থাৎ, কোনো একটা অঞ্চলকে শুধু অঞ্চল হিসেবে দেখার বদলে সেই অঞ্চল নিয়ে মিনিমাম রিসার্চটুকু করার তাগিদটুকু যদি এখান থেকেই না পায় তারা... তাহলে এই বলিউডের নির্মাণ নিয়ে আর যা-ই হোক না কেন, ভালো কিছুর আশা যে করা যাবেনা মোটেও, মূলত সেখানেও নেই কোনো যদি-কিন্তুর সুযোগ।
তথ্যসূত্র- ফিল্ম কম্প্যানিয়ন