অ্যান্থনি হপকিন্স: মহীরূহের প্রিয় তিন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তালিকার এই তিনটি সিনেমা দেখলে মহীরূহ 'ফিলিপ অ্যান্থনি হপকিন্স' এর বিশালত্বের অনেকটুকুই আঁচ করা যাবে। এই মানুষটি কী দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, উপলব্ধি করা যাবে তাও।
যারা হলিউডের সিনেমা নিয়ে মোটামুটি ওয়াকিবহাল, সেখানকার তারকাদের ঠিকুজিকোষ্ঠী যাদের নখদর্পনে, তাদের অনেকেরই প্রিয় অভিনেতার তালিকার প্রথম সারিতে 'ফিলিপ অ্যান্থনি হপকিন্স' এর নাম দেখতে পাওয়া যায়। আর দেখতে পাওয়া যাবে নাও বা কেন? ১৯৬৮ সালে ' দ্য লায়ন ইন উইন্টার' সিনেমা দিয়ে আবির্ভূত হয়ে টানা এতগুলো বছরে ধরে কম ভানুমতীর খেল তো তিনি দেখাননি৷ অনেকদিন আগে অশ্বারোহী হয়ে যে রথ তিনি ছুটিয়েছিলেন, মুখে অজস্র বলিরেখার এই বয়সে এসেও সে রথ চলছে। রথ, জয়রথে রূপান্তরিত হয়ে এগিয়েই চলছে।
রবার্ট ডি নিরো, আল পাচিনো, অ্যান্থনি হপকিন্স, জ্যাক নিকোলসন...এদের নিয়ে আসলে আলাদা করে স্তুতিবাক্য লেখা আর সূর্যকে প্রদীপ দেখানো একই হয়ে যায়। সে আদিখ্যেতায় যাচ্ছিও না। 'দ্য ফাদার' দেখে যেসব দর্শক নতুন নতুন অ্যান্থনি হপকিন্স কে চিনেছেন, তাদের জন্যে আরো তিনটি 'মাস্ট ওয়াচ অ্যান্থনি শো'র সাজেশন দিয়ে যেতে পারি। হপকিন্স এর অভিনবত্ব তাহলে নিজে থেকেই ধরতে পারবেন পাঠকেরা।
১. দ্য ওয়ার্ল্ড'স ফাস্টেস্ট ইন্ডিয়ান
এ সিনেমা নিয়ে কথাবার্তা কমই শুনি কেন যেন৷ অথচ মোটিভেশনাল সিনেমার তালিকা করতে বসলে এ সিনেমা আসা উচিত প্রথম দশের তালিকার মধ্যে। তাছাড়া হপকিন্সের মুগ্ধ করা অভিনয় তো রইলোই।
নিউজিল্যান্ডের বার্ট মুনরো নামক একজন মোটর-সাইক্লিস্ট এর জীবনী অবলম্বনে এ সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন রজার ডোনাল্ডসন। বার্ট মুনরো নিউজিল্যান্ডের মানুষ৷ জীবনযুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে যুঝতে যুঝতে উপস্থিত হয়েছেন বয়স-বাড়ির চৌকাঠের সামনে। এরকম অন্তিম সময়ে এসে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, যাবেন আমেরিকায়। সেখান থেকে বনেভিল যাবেন। মোটর সাইকেলের রেসে অংশগ্রহণ করবেন৷

নিউজিল্যান্ডের এই বৃদ্ধ মানুষটি জীবনে প্রথমবার আমেরিকা গেলেন। যাত্রাপথে কীসব বিপত্তির মুখোমুখি হলেন, কীভাবে স্বপ্নকে সত্যি করতে পাড়ি দিলেন বহুদূরের পথ, তা নিয়েই সিনেমা। অনবদ্য স্ক্রিপ্ট, সিনেম্যাটোগ্রাফী আর হপকিন্স এর 'জীবন্ত' অভিনয়, সব মিলেমিশে যেন হয়ে গেলো কড়া পাকের ছানার সন্দেশ!
সে সাথে সিনেমার দারুণ দারুণ সব লাইন। এই সিনেমার হপকিন্স এর বলা কয়েকটা লাইন তো রীতিমতো বাঁধাই করে রাখবার মতন দারুণ। যেমন-
Cheerio, my friend. If you don't go when you want to go, when you do go, you'll find, you are gone
কী অসাধারণ!
আরো একটি লাইন লেখার লোভ সামলাতে পারছি না৷ বৃদ্ধ বার্ট তার মোটরসাইকেল 'ইন্ডিয়ান' এ উঠছেন রেসের জন্যে, একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে সতর্ক করে দিচ্ছেন-
Aren’t you scared you'll kill yourself if you crash?
জবাবে বার্ট মানরোর উত্তর-
No... you live more in five minutes on a bike like this going flat out than some people live in a lifetime.
অসাধারণ এক সিনেমা৷ মাস্ট ওয়াচ!
২. দ্য টু পোপস
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এ সিনেমা সবার জন্যে না। ফিলোসোফিক্যাল জনরার এ সিনেমায় আছে দারুণ দারুণ কিছু কথোপকথন। সম্প্রতি 'উইন্টার স্লিপ' নামে টার্কিশ এক সিনেমা দেখলাম। নুরে বিলজে সেইলান আমার প্রিয় পরিচালক। তাঁর নির্মিত ৩ ঘন্টা ১৬ মিনিটের এ সিনেমার অনেকটা জুড়েই শুধু কথা আর কথা৷ অথচ একবিন্দু বিরক্তি ছাড়াই তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখেছি পুরোটা।
এই ভূমিকাটুকু টানার কারণ, যারা ঘটনার পরম্পরা, চরিত্রগুলোর দ্রুত গতিশীলতা দেখতে চান, 'দ্য টু পোপস' তাদের ভালো লাগবে না। যারা অভিনয়ের চমৎকারিত্ব আর দারুণ কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে সেঁচে নিয়ে আসতে চান অপার্থিব কিছু জীবনবোধ, এ সিনেমা তাদের জন্যে।

যাজক বেনেডিক্ট ষোড়শ আর হবু যাজক ফ্রান্সিস একত্রিত হন ভ্যাটিকান সিটিতে৷ দুইজন দুই মেরুর মানুষ। তাদের মধ্যে মতের মিল হয় না। বেনেডিক্ট একটু খিটখিটে মেজাজের, কিছুটা গোঁড়া সংস্কারপন্থীও। মাঝেমধ্যে জেদ করেন বাচ্চাদের মত। রেগে ওঠেন। আবার থেমে যান। ভেতরটা পেলব নরম, বাইরেটা তপ্ত পাত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করলেন অ্যান্থনি। কী যে দারুণই না করলেন! যাজক ফ্রান্সিসের চরিত্রে ছিলেন জনাথন প্রাইস। তিনি বিচক্ষণ যাজক। উদার চিন্তাচেতনার মানুষ। তিনিও করলেন চমৎকার অভিনয়।
এই দুই যাজক মাঝেমধ্যেই ঝগড়া করছেন। আবার পরক্ষণেই খুনসুটিতে মেতে উঠছেন৷ জীবন, দর্শন, আদর্শ, ধর্ম... সবকিছু নিয়ে মুখোমুখি হচ্ছেন দুইজন। যুক্তির কৃপাণে রক্তাক্ত করছেন একে অপরকে।
বাইরের মানুষেরা জানেন, পোপরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় অপার্থিব সত্তার নিকটতম প্রতিনিধি। অথচ পোপরাও তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদেরও প্রিয় ফুটবল টিম আছে, প্রিয় খাবার আছে, প্রিয় ব্যান্ড আছে৷ ধর্মদর্শন দিয়ে শুরু হওয়া এ সিনেমা সীমাবদ্ধ থাকেনি শুধু ধর্মে, ক্রমশই ছুঁয়ে গিয়েছে অজস্র দিক।
মাস্ট ওয়াচ। 'স্যার টনি'র আরেকটা দারুণ কাজ এই সিনেমা।
৩. দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস
'টনি' ভক্তরা এতক্ষণে হয়তো উশখুশ শুরু করে দিয়েছেন৷ তাদের সবচেয়ে প্রিয় সিনেমার নামটাই না আবার আমি এড়িয়ে যাই। না, সে সুযোগ নেই৷ 'সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস' এর নাম না লিখলে এ তালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই সিনেমা আমার দেখা অন্যতম ভয়ের সিনেমা। যদিও এটা হরর সিনেমা না। কিন্তু, ভীতিজাগানিয়া নানা উপকরণে অকৃপণ ছিলো এ সিনেমা।
কোয়েন ব্রাদার্সদের 'নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন' সিনেমার সেই ভিলেনকে মনে আছে? সে যখনই পর্দায় আসতো, তটস্থ হয়ে উঠতাম ভয়ে। অথবা হালের 'রাতসাসান' সিনেমার কথাও বলা যায়। তবে ভিলেন দেখে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোতের অনুভূতি প্রথম হয়েছিলো ডঃ হানিবাল (ক্যানিবাল) লেকটার কে দেখে।

সর্বসাকুল্যে পঁচিশ মিনিট স্ক্রিনটাইম ছিলো তাঁর, এটুকু সময়ের মধ্যেই অদ্ভুত ত্রাসে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিলেন তিনি। ক্রুর হাসি, বক্র চাহনি আর জমাটি সব সংলাপ! এ সিনেমা করার জন্যে হপকিন্স সিরিয়াল কিলার বিষয়ক একগাদা নথিপত্র পড়েছেন, জেলে গিয়ে সিরিয়াল কিলার দেখেছেন, এরকম দুঁদে আসামীদের কীভাবে বিচার করা হয়, তা দেখার জন্যে বহুবার গিয়েছেন আদালতেও।
এতসব হোমওয়ার্ক করে যে সিনেমা তিনি করছেন, সেখানে তিনি সবাইকে ছাপিয়ে যাবেন, এটাই প্রত্যাশিত ছিলো। অস্কার তো পেয়েছিলেনই। এখনও ক্রাইম থ্রিলার জনরার সিনেমার কথা এলে 'সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস' এবং 'ডঃ হানিবাল লেকটার' এর কথা সবার আগেই চলে আসে
'দ্য ফাদার' সিনেমায় অস্কার জেতার সাথে সাথে যেমন তিনি একটি রেকর্ড গড়েছেন, 'দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস' এর জন্যেও অস্কার জেতার পাশাপাশি আরেকটি রেকর্ড গড়ার কথা ছিলো তাঁর। একটুর জন্যে হয়নি৷ সবচেয়ে কম টাইম (চব্বিশ মিনিট বায়ান্নো সেকেন্ড) স্ক্রিনটাইম নিয়ে অস্কার বিজয়ীর মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। প্রথম যিনি, তার স্ক্রিনটাইম তেইশ মিনিট উনচল্লিশ সেকেন্ড!
তালিকার এই তিনটি সিনেমা দেখলে মহীরুহ 'ফিলিপ অ্যান্থনি হপকিন্স' এর বিশালত্বের অনেকটুকুই আঁচ করা যাবে বলেই বিশ্বাস করি। এই ছোটোখাটো মানুষটি কী দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী হয়ে এত যুগ ধরে রাজত্ব করে আসছেন বিশ্বের অন্যতম বিশাল সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে, সেটার সুলুকসন্ধানের জন্যেও সঙ্গী হতে পারে এই ত্রয়ী৷