নিজের আলাদা একটা ধাঁচ তৈরি করেছেন, এর বাইরে কখনো ফোক, কখনো রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে শ্রোতাদের সামনে যখনই হাজির হয়েছেন মুগ্ধ করেছেন বরাবরই। এখনো তার গান শোনার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে শ্রোতারা...

'ব্যস্ত শহরে, ঠাস বুনোটের ভিড়ে, আজো কিছু মানুষ, স্বপ্ন খুজে ফেরে...' শৈশবে একুশে টেলিভিশনের মেগাসিরিয়াল 'বন্ধন' এর সেই মুগ্ধ করা শীর্ষ সংগীত দিয়ে পরিচয়। কৈশোরের দুরন্ত সময়ে 'হোক কলরব' গান নিয়ে মাতোয়ারা, এরপর কখনো ফোক সঙ্গীত, কখনো রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে শ্রোতাদের সামনে যখনই হাজির হয়েছেন, সবসময় মুগ্ধ করেছেন। এখনো তাঁর গান একটু খানি শোনার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে। সঙ্গীত পিপাসু মানুষের কাছে সুরের মূর্ছনায় আবেশ ছোঁয়া এক মুগ্ধতার নাম- 'শায়ান চৌধুরী অর্ণব'। 

বাবা চিত্রশিল্পী স্বপন চৌধুরী, চাচা বিখ্যাত গায়ক তপন চৌধুরী। ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছেন সাংস্কৃতিক আবহে। কলকাতায় পড়াশোনাকালীন সময়ে মুগ্ধ হয়ে ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে, সেখানেই শুরু সঙ্গীতচর্চা। শান্তিনিকেতনে বেড়ে উঠলেও তার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন গুরু আজম খান। মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের জীবনমুখী এবং রক ফর্মের গান অর্ণবকে উৎসাহিত করে তোলে, এছাড়া অঞ্জন দত্ত, কবির সুমন ও নচিকেতার গানেও অনুপ্রাণিত হতেন। 

নব্বই দশকের শেষের দিকে শান্তিনিকেতনে পড়ার সময়ই সেখানকার কিছু বন্ধু নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ড 'বাংলা', পরবরর্তীতে সেখানে যোগ দেন আনুশেহ আনাদিল। পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে ফিরে আসেন বাংলাদেশে, ব্যান্ড দলটাকে আরো সাজিয়ে তোলেন। ২০০২ সালে বের হয় প্রথম অ্যালব্যম 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়'। এই এলব্যামে আনুশেহ আনাদিলের সঙ্গে ফোক সংগীত 'মন তোরে পারলাম না বোঝাইতে' বেশ জনপ্রিয়তা পায়, এই এলব্যামেই ছিল তাঁর একটি মৌলিক গান 'তুই গান গা'। 'সে যে বসে আছে একা একা'- অফবিট নাটকের এই গানটি তরুণদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। একই বছরেই বের করেন নিজের প্রথম এলব্যাম 'চাইনা ভাবিস'। 

শায়ান চৌধুরী অর্ণব

'হোক কলরব' অর্নবের দ্বিতীয় এলব্যাম, এই এলব্যামের 'তোমার জন্য' ও 'হোক কলরব' সহ বেশকিছু গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তার দরুণ অর্ণব পৌঁছে যান সর্বপ্রান্তের শ্রোতাদের মাঝে। গানগুলো এখনো শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনেন। এরপর একে একে বের করেন ডুব, রোদ বলেছে হবে, আধেক ঘুমে, খুব ডুব, অন্ধ শহর নামে একক এলব্যাম। 'আধেক ঘুমে' এলব্যামটি অর্ণবের জন্য বিশেষ কিছু হয়ে থাকবে। নিজেকে ভেঙ্গে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েও বিমুগ্ধ করেছেন সবাইকে, সেটা ফাগুন হাওয়ায় হোক কিংবা মেঘ বলেছে যাবো যাবো-ই হোক।  

'আমার সোনার ময়না পাখি'র মতো জনপ্রিয় এই ফোক সঙ্গীতকে নিজ আঙ্গিকে ব্যবহার করেছিলেন সাড়া জাগানো 'মনপুরা' সিনেমায়, এখানেও তিনি দারুণ সফল। প্রথম চলচ্চিত্রে গান করেন 'আহা!' সিনেমায়, জাগো সিনেমার সবকটা গান ই শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল, একে একে তার গায়কী, সুরের দেখা মিলেছিল পদ্ম পাতার জল, আইসক্রিম, এবং আয়নাবাজি সিনেমায়। তবে প্রতিভানুযায়ী চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেছেন খুবই কম। নিজের এলব্যামের বাইরে সাহানা বাজপেয়ীর রবীন্দ্র সংগীতের এলব্যাম 'নতুন করে পাবো বলে' সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন,এই এলব্যামের দুইটি গান পরবর্তীতে আন্ডার কন্সট্রাকশন সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল। কৃষ্ণকলির এলব্যাম 'সূর্যে বাঁধি বাসা'র ও সঙ্গীতায়োজক তিনি। 

বাংলা ব্যান্ডের বাইরে গিয়ে তৈরি করেছেন 'অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস' নামে আরেকটি ব্যান্ড দল। এই ব্যান্ড থেকে প্রথম এলব্যামটিও সাড়া ফেলে, খুব শীঘ্রই আসবে দ্বিতীয় এলব্যাম। এছাড়া যুক্ত ছিলেন ঝালমুড়ি সহ বেশ কয়েকটি এলব্যামে। সঙ্গীতশিল্পী পরিচয়ের বাইরে তিনি একজন চিত্রশিল্পীও, শান্তিনিকেতনে এই বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এসরাজ বাজানোর জন্যও খুব বিখ্যাত তিনি।

অর্ণব এক মুগ্ধতার নাম

সঙ্গীত জগতে অর্ণব যেমন মুগ্ধতার নাম, তেমনই আক্ষেপের নামও। নিজের মেধা, প্রজ্ঞা দিয়ে আজ যে জায়গায় পৌঁছার কথা, তিনি তা পারেন নি পুরোপুরি। মাদকের অতি ভয়াবহ গ্রাসে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছিলেন, বারবার রিহ্যাবে গিয়েছেন। শান্তিনিকেতন পড়ার সময়ই প্রেমে পড়েছিলেন সাহানা বাজপেয়ীর, অতঃপর বিয়ে। কিন্তু সেই ভালোবাসা, আস্থা এক সময় রূপ নেয় বিচ্ছেদে। ব্যক্তিজীবনের হতাশায় সঙ্গীতজ্ঞ অর্ণব ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন। 'আমার আমি'তে অতিথি হয়ে এসেছিলেন, দর্শকরা পেয়েছেন আশার সঞ্চার।  বায়োস্কোপের 'নো কাপল এন্ট্রি' সিরিজে 'তবে থাক' গানে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। শ্রোতারা তাঁর গানের অধীর অপেক্ষায় থাকেন,তবুও তিনি সেভাবে আসেন না। তাই তাঁর গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতের মত বলতে হয় 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,চিরদিন কেন পাই না'!

১৯৭৯ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করা এই জনপ্রিয় সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আজ পেরোচ্ছেন জীবনের ৪২ টি বসন্ত, শুভকামনা রইলো তার জন্য। সম্প্রতি বিয়ে করেছেন সুনিধিকে। শীতের পাতাঝরা দিন পেরিয়ে বসন্তের সুবাতাস নিয়ে ফিরে আসুক আপন ভুবনে। শুভ জন্মদিন, অর্ণব!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা