'শাসকগোষ্ঠীর এত ভয় কেন এই আর্ট কালচারকে?'- লিখেছেন আশফাক নিপুণ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

যদি নাটক, সিনেমা দিয়েই সমাজ বদলানো যেত; তাহলে আজকে রাশিয়া হয়ত ইউক্রেন আক্রমণ করত না। কারণ রাশিয়ায় দশকের পর দশক ধরে প্রচুর মানবিক সিনেমা তৈরী হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
প্রায়ই বলতে শুনি শিল্পের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা। আমি বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখি। আমি বলি শিল্পের দায়বদ্ধতা প্রথমেই এবং প্রথমেই শুধুমাত্র তাঁর দর্শকের প্রতি। পার্সোনাল আর্ট বাদ দিলে প্রজেকশন বেইজড ফিকশনাল বাণিজ্যিক যত আর্ট ফর্ম আছে (মঞ্চ নাটক, থিয়েটার, টেলিভিশন ফিকশন, সিনেমা), যা তৈরী এবং প্রদর্শিত হয় দর্শকদের জন্যে, তার দায়ও থাকা উচিত দর্শকের সময়ের প্রতি, অন্য কোথাও নয়। নাটক, সিনেমা দিয়ে কি সমাজ বদলায়? অবস্থা দেখে তো তা মনে হয় না। যদি নাটক, সিনেমা দিয়েই সমাজ বদলানো যেত তাহলে আজকে রাশিয়া হয়ত ইউক্রেন আক্রমণ করত না কারণ রাশিয়ায় দশকের পর দশক ধরে প্রচুর মানবিক সিনেমা তৈরী হয়েছে, এখনো হচ্ছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খোদ আমেরিকায় যুদ্ধের ভয়াবহতা আর মানবতার বিপর্যয় নিয়ে প্রচুর প্রচুর স্টুডিও এবং ইণ্ডি সিনেমা তৈরী হয়েছে কিন্তু তাতে আমেরিকার মহা সমুদ্রের এপারে এসে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান আক্রমণ বন্ধ হয়নি।
কিন্তু দর্শক কি সমাজের বাইরের কেউ? তার জীবন কি শুধুই প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ বা মিলনেই সীমাবদ্ধ? সে কি চাইলেই রাজনীতির বাইরে অবস্থান করতে পারে? রাজনীতি কি তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না? আবহমানকাল থেকেই আমাদের জীবনে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতির সূক্ষ্ম এবং স্থুল প্রভাব সবসময় বিরাজ করছে। রাজনীতিই আমাদের জীবনচরিত (লাইফস্টাইল) নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের সংস্কৃতিতেও রাজনীতি ঢুকে গেছে কিন্তু একমাত্র সংস্কৃতিই পারে এই রাজনীতির চোখে চোখ রেখে কিছু বলতে। রাজনীতির চোখরাঙানীকে ভয় না পেয়ে পালটা প্রতিবাদ করতে পারে সংস্কৃতিই, যাকে আমরা "আর্ট কালচার" বলি।

৭০ এর দশকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে আগে তাই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতির চোখরাঙানীকে তোয়াক্কা না করে জহির রায়হান তৈরী করেছেন "জীবন থেকে নেয়া", যে সিনেমা আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। অথবা ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলের অত্যাচারের প্রতিবাদে সত্যজিত রায় নির্মাণ করেছেন "হীরক রাজার দেশে", মৃণাল সেন নির্মাণ করেছেন "আকালের সন্ধানে" আর দেশভাগের বেদনার প্রতিবাদে হৃত্বিক ঘটক নির্মাণ করেছেন "সুবর্ণরেখা", যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিবাদে ডানিশ তানোভিচ নির্মাণ করেছেন "নো ম্যানস ল্যাণ্ড"। আমরা বারবার এসব ছবির কাছেই ফিরে যাই। আমরা এসব ছবি থেকেই আমাদের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নিই "এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে", "দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খানখান" অমর লাইনগুলোর মধ্য দিয়ে।
নিছক বিনোদনের সংস্কৃতির প্রয়োজন অবশ্যই আছে। আমাদের চারপাশে এত অভাব, অনটন, যন্ত্রণা, চাপ থেকে সাময়িক মুক্তিলাভের আশায় আমরা একটু বিনোদন চাই। নাটক, সিনেমায় সেই বিনোদন খুঁজি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির রাজনীতিতে পিষ্ট হতে হতে আমাদেরও কিছু বলতে ইচ্ছে করে। প্রতিবাদ করতে চাই আমরাও। আর তাই যখন পর্দায় কোন সিনেমায়, গল্পে, নাটকে সেই প্রতিবাদ দেখতে পাই; তখন আমরাও উদ্বেলিত হই, প্রভাবিত হই। আমরা সেসব কাজে আমাদের কন্ঠকে খুঁজে পাই, সাধারণ দর্শক থেকে আমরাও পর্দার সেসব চরিত্র হয়ে প্রতিবাদ করি, সেই প্রতিবাদ নীরব হলেও। আর এভাবেই সেসব নাটক, সিনেমা সময়কে অতিক্রম করে অমর হয়ে বেঁচে থাকে যুগে যুগে।
নাটক, সিনেমা হয়ত সমাজকে, রাষ্ট্রকে বদলাতে পারে না সহসা। কিন্তু সে ধীরে ধীরে নিজের ছাপ রেখে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর এভাবেই ধর্মান্ধ, রাজনীতিন্ধ, দুর্নীতিপরায়ণ সমাজ আর রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার, ভেঙেচুরে পালটে দিয়ে মানবিক হওয়ার রসদ যুগিয়ে যায় এইসব "আর্ট কালচার"। তাইতো শাসকগোষ্ঠীর এত ভয় এই আর্ট কালচারকে। এত নিয়ম নীতি, শৃংখল দিয়ে যত দমন পীড়ন শিল্প আর শিল্পীদের। কারণ তারাও বোঝেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এই আর্ট কালচারের শক্তি আর প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী।