শুটিং শেষ করে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন নদীর পাড় ধরে। গ্রামের কয়েকজন মহিলা কলসি নিয়ে এসেছিলেন পানি নিয়ে যেতে, তারা এটিএম শামসুজ্জামানকে দেখেই রাস্তার আরেকপাশে চলে গেল, নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করতে লাগলো- ‘হারামজাদা খাচ্চর বেডা’!

বেশ কয়েক দফায় তার মৃত্যুর খবর ছেপেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। তিনি নিজে লাইভে এসে বলেছেন, 'আমি বেঁচে আছি, আমার মৃত্যু নিয়ে গুজব ছড়াবেন না৷ মরার সময় হলে এমনিই মরে যাব, আগেভাগে মারতে হবে না আমাকে।' বাংলাদেশী সেলিব্রেটিদের মধ্যে তার মৃত্যুর গুজবই সবচেয়ে বেশিবার রটেছে। কিন্ত গত বছর ফাল্গুনের এক নাতিশীতোষ্ণ সকালটাকে বিষাদের চাদরে ঢেকে দিয়ে সত্যি খবরটাই ভেসে এলো, প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান আর নেই! অন্ত্রের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে নিজ বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই কিংবদন্তী। 

সিনেমা তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল না কখনোই। রঙিন জগতে পা রাখবেন, এমনটা ভাবেননি তিনি। ছোটিবেলায় সিনেমা দেখতেন অবশ্য, লুকিয়ে লুকিয়ে একা বা বন্ধুবান্ধব মিলে ছুটতেন হলে, দুরন্ত কৈশরে এমন অনেক স্মৃতি জমিয়েছিলেন জীবনে। সেই মানুষটাই পরে হয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ছয় দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিমান অভিনেতাদের একজন, শুধু অভিনয় দিয়েই যিনি মানুষকে হাসিয়েছেন, রাগিয়েছেন, সিনেমার পর্দায় নিজের শয়তানীমাখা সংলাপ আর কার্যক্রমে কুড়িয়েছেন ঘৃণা! যদিও বাস্তব জীবনে তাঁর মতো অমায়িক ভদ্রলোক আর হয় না। বিশেষণের ব্যবহারে আসলে তাঁকে বোঝানো যাবে না, তিনি নিজেই তাঁর পরিচয়। তিনি এটিএম শামসুজ্জামান, একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, রঙিন পর্দার সেই খলনায়ক। 

বাবা কর্মসূত্রে থাকতেন ঢাকায়, নোয়াখালীতে তাঁর নানার বাড়ী। সেখানেই তাঁর জন্ম, সেটা আজ থেকে সাতাত্তর বছর আগের কথা। শৈশবেই বাবার সঙ্গে ঢাকা চলে এসেছিলেন, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা সবকিছুই পুরান ঢাকায়। বাবা নামকরা উকিল ছিলেন, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতিও করেছেন, মোটামুটি স্বচ্ছ্বল পরিবারেই বেড়ে উঠেছেন এটিএম শামসুজ্জামান।

লেখালেখির শখ ছিল আগে থেকেই, পগোজ স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্কুল ম্যাগাজিনে গল্প লিখতেন নিয়মিত। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন প্রবীর মিত্র। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে ১৯৬১ সালে উদয়ন চৌধুরী নামের এক পরিচালকের সহকারী হিসেবে সিনেমাজগতে তাঁর প্রবেশ ঘটলো। 'জলছবি' নামের একটা সিনেমার গল্প লিখলেন তিনি, সেই সিনেমা আবার পরিচালনা করলেন বিখ্যাত পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা, যদিও মিতা নিজেও তখন খুব বড় কোন নাম ছিলেন না।

এটিএম শামসুজ্জামান

জলছবি সিনেমা দিয়ে নায়ক ফারুক তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন। সেই সিনেমাটা দিয়েই শুরু হলো সিনেমার গল্পকার হিসেবে এটিএম শামসুজ্জামানের যাত্রা, এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি। তবে চিত্রনাট্য দিয়ে তো তিনি পরিচিতি পাননি, তাঁকে লোকে চেনে অভিনয়ের কারণে, সেই অভিনয়টা শুরু হলো ক'বছর পরেই। ছোটখাটো চরিত্রে তাঁকে দেখা যেতে লাগলো পর্দায়, কখনও হাস্যরসাত্নক কিছু নিয়ে আসছেন, কখনও বা নায়কের হাতে মার খাচ্ছেন, কখনও নায়িকার বিয়ের ঘটকালী নিয়ে আসছেন; কিন্ত বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না সেগুলো। 

স্বাধীনতার পরে নতুন করে চলচ্চিত্রজগত তখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, দেশে ভারতীয় বা পাকিস্তানী সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ। রাজ্জাক-ফারুকরা আছেন নায়কের আসনে, কিন্ত খলনায়ক কই? পর্দায় নায়ককে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো ভিলেন তো খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনই এক সময়ে, ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেনের 'নয়নমণি' সিনেমায় খলচরিত্রে তাঁর আবির্ভাব। অনেকক্ষণ পর্দায় থাকতে পারবেন, আর টাকাপয়সার পরিমাণটাও ভালো- এসব ভেবেই ভিলেন হতে আপত্তি করেননি তিনি। সেটা দিয়েই আলোচনায় চলে এলেন এটিএম শামসুজ্জামান। এরপর একে একে 'গোলাপী এখন ট্রেনে', সূর্যদীঘল বাড়ী, অশিক্ষিত, ছুটির ঘন্টা, 'রামের সুমতি' তে অভিনয় করলেন তিনি, মানুষ চিনলো তাঁকে, খলচরিত্রে তাঁর কৃত্রিমতাবর্জিত অভিনয় দেখে কখনও রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠতো তাদের, কখনওবা ইচ্ছে হতো সিনেমার পর্দা থেকে টেনে বের করে এনে কষে দু ঘা লাগিয়ে দিতে! 

তাঁর অভিনয়ে কোন জড়তা ছিল না, একদম শুরু থেকেই ক্যামেরা ভীতি ব্যাপারটা তাঁর মধ্যে ছিল অনুপস্থিত, কারণ ক্যামেরার পেছনে কাজ করেই তো ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি। সত্তর আর আশির দশকে তাঁর অভিনয় যারা দেখেছেন তারা জানেন, সেই সময়ে কেমন রোগাপাতলা ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। এমন ফিগারের একটা মানুষের পক্ষে ভিলেন হওয়া কতটা মানানসই? নায়কের এক ঘুষিতেই তো দশফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়ার কথা তাঁর। কিন্ত ফিটনেসের ঘাটতি তিনি পুষিয়ে দিতেন অভিনয় দিয়ে, নিজে লেখক ছিলেন, খলনায়কের অংশের ডায়লগ নিজেই কাঁটাছেড়া করে পরিচালককে দেখাতেন, পরিচালক সেটা পছন্দ না করে পারতেন না। খল চরিত্রে একটা মানুষ হিসেবে যতটা কুটিল আর ভয়ঙ্কর হওয়া যায়, সেটাই সাজার চেষ্টা করতেন এটিএম শামসুজ্জামান, আর এই কাজে বেশীরভাগ সময়েই তিনি ছিলেন শতভাগ সফল।

পর্দায় নানারকমের শয়তানি দেখে লোকে সত্যি সত্যি তাঁকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিল, এমন ঘটনার মুখোমুখি খুব কম অভিনেতাই হয়েছেন জীবনে। একবার শুটিঙের জন্যে ঢাকার বাইরে গিয়েছেন, যেখানে শুটিং হচ্ছে, সেই নদীর পাড় থেকে বিশ্রামের জায়গাটা খানিক দূরে, হেঁটে যেতে হয়। নিজের শুটিং শেষ করে এটিএম শামসুজ্জামান হেঁটে যাচ্ছিলেন নদীর পাড় ধরেই। গ্রামের কয়েকজন মহিলা কলসি নিয়ে এসেছিলেন পানি নিয়ে যেতে, তারা এটিএম শামসুজ্জামানকে দেখেই রাস্তার আরেকপাশে চলে গেল, নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করতে লাগলো- 'হারামজাদা খাচ্চর বেডা'! 

আরেকবার শুটিং করতে ঢাকার বাইরে গেছেন৷ শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়তে গেলেন মসজিদে৷ গেট দিয়ে ঢোকার ঠিক আগে এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সিনেমা করেন না? তিনি হ্যাঁ-বোধক উত্তর দিলেন৷ লোকটি আবার প্রশ্ন করলেন, এখানে কি করতে আসছেন? এটিএম শামসুজ্জামানও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় পাল্টা প্রশ্ন করলেন, শুক্রবার দুপুরে মানুষ মসজিদে কী করতে আসে? লোকটি একটু থতমত খেলেও থামলো না। বললো, 'জীবনে তো চুরি-বাটপারি, খারাপ কাজ কম করেন নাই৷ নামাজ পড়েও লাভ নাই আর!' 

অসুস্থতা আর বয়সের ভারে এখন তিনি খানিকটা দুর্বল

রাজ্জাকের পরিচালনায় শাবানার বিপরীতে 'চাঁপাডাঙ্গার বউ' সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে বেশভুষা পাল্টে একটা সিনেমা হলে গিয়েছিলেন তিনি। পাশের সিটে বসা লোকটা সিনেমা চলার পুরোটা সময় ধরে একটানা পর্দার এটিএম শামসুজ্জামানকে গালি দিয়ে গেল! একজন খল অভিনেতার জন্যে এই গালিগুলোই বিশাল বড় পাওয়া। ১৯৮৭ সালে তাঁকে নিয়ে কাজী হায়াৎ নির্মাণ করলেন 'দায়ী কে' সিনেমাটা। ইলিয়াস কাঞ্চন সেখানে নায়ক, অথচ নিজের সুণিপুণ অভিনয়ের জাদু দিয়ে সেবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার জিতে নিয়েছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। এরপরেও চারবার বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেছেন এই গুণী অভিনেতা। 

পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে অনেক নায়কের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, রাজ্জাক-ফারুক-আলমগীর থেকে শুরু করে জাফর ইকবাল-ইলিয়াস কাঞ্চন-সালমান শাহ-রিয়াজ-মান্না সহ আরো অনেকের সঙ্গে পর্দায় তাঁর টক্কর বেঁধেছে, কিন্ত উপমহাদেশের চিরাচরিত নায়কপ্রধান সিনেমাতেও নিজের প্রতিভার জাদুতে আলাদা একটা স্মাক্ষর রেখে গেছেন তিনি সবসময়ই। সহকারী পরিচালনা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, কাজ করেছিলেন খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তদের মতো পরিচালকের সঙ্গে। নিজের সিনেমা বানানোর সুপ্ত ইচ্ছেটা পূরণ করেছেন অনেক পরে, ২০০৯ সালে শাবনূর-রিয়াজ জুটিকে নিয়ে নির্মান করেন 'এবাদত' সিনেমাটি, সেটাই হয়ে আছে তাঁর পরিচালিত একমাত্র সিনেমা। 

এটিএম শামসুজ্জামান যখন খলচরিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন, তখন ভিলেন হিসেবে ছিলেন শুধু খলিলুল্লাহ খান। এরপর তো কতজন এসেছে, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদ, নাসির শাহ, জাম্বু থেকে হাল আমলের মিশা সওদাগর, ড্যানি সিডাক বা ডন- অথচ তিনি থেকেছেন নিজের প্রতিভায় উজ্জ্বল। হ্যাঁ, একজনের নাম নেই এই তালিকায়- হূমায়ুন ফরীদি, তাঁর সঙ্গেই কেবল তুলনা দেয়া যায় এই মানুষটার, বাকীরা অনেকটাই পিছিয়ে ওদের দুজনের চাইতে। 

বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতা জমেছে, সেইসঙ্গে সিনেমার পর্দায় বেড়েছে তাঁর কূটিলতা। সেসব কূটিলতা দেখে লোকে যে শুধু তাঁকে ঘৃণা করতো এমনটাই নয়, প্রাণখুলে হাসতেও পারতো দর্শকেরা। ভিলেন চরিত্রের ভয়ঙ্কর রূপের মধ্যেই শুধু নিজেকে বেঁধে রাখেননি এটিএম শামসুজ্জামান, একজন মন্দ মানুষের চরিত্রের বাজে দিকগুলোকেই কখনও হাস্যরসাত্নকভাবে উপস্থাপন করেছেন পর্দায়। জাত অভিনেতা না হলে এমনটা কে পারে বলুন? নতুন শতকে পা দেয়ার পরেই যখন অশ্লীলতা জেঁকে বসলো চলচ্চিত্রাঙ্গনে, তখনই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি। 

এরপর থেকে তাঁকে নিয়মিত দেখা গেছে টিভিপর্দায়, নাটক আর টেলিফিল্মে জমিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি; বিশেষ করে গ্রামের পটভূমিতে নির্মিত নাটকে বেশী দেখা গেছে তাঁকে। একটা আক্ষেপ তাঁর আছে, চলচ্চিত্রাঙ্গনের দুরবস্থা তাঁকে ভাবায়, তাঁকে কষ্ট দেয়। এই জায়গাটাই তো তাঁকে মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছে, এতগুলো বছর কাজ করেছেন এখানে, আবেগটা পুরোপুরিই মিশে আছে এই সিনেমা জগতের সঙ্গে। তবুও মাঝেমধ্যে চলচ্চিত্রে দেখা গেছে তাঁকে, অনেদিনের বিরতি বা অনভ্যস্ততা তাঁর অভিনয়ে ছাপ ফেলতে পারেনি এতটুকুও। 'গেরিলা' সিনেমার কথাই বলা যাক, পুরান ঢাকার অধিবাসীর চরিত্রে কি প্রাণবন্ত অভিনয় তাঁর! কচি খন্দকারকে দেয়া সেই ধমক- "তোমার এই শান্তি কমিটিরে, অর মেম্বারগো, আর তামাম রাজাকার বাহিনীরে আমি যদি টিকটিকি দিয়া না ****(বাকীটা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য) এখনও কানে ভাসে!

এটিএম শামসুজ্জামান

এত যে সাফল্য, দর্শকদের কাছে এমন জনপ্রিয়তা, এত গ্রহনযোগ্যতা- এসবের রহস্য কি? জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এটিএম শামসুজ্জামানকে। তিনি বলেছিলেন- জামাতে নামাজে দাঁড়িয়ে যেমন আমরা নিয়ত ধরে বলি, ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছি, আমার কাছে সিনেমা ব্যপারটাও সেরকম। এখানে পরিচালক সবকিছু। সিনেমার সেটে আমার চোখে তিনিই ঈশ্বর। আমি কি জানি, আমার বয়স কত, কয়টা সিনেমায় অভিনয় করেছি আমি এসব নিয়ে ভাবি না। আমি শুধু ভাবি কাজ দিয়ে পরিচালককে সন্তষ্ট করতে হবে, সে যেভাবে চায় সেভাবে অভিনয়টা করে দিতে হবে। আর তাই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই আমার মনে হয় আজকেই আমি প্রথম এই জিনিসটা দেখছি, আজই আমার প্রথম অভিনয়, আজকেই আমি প্রথমবারের মতো সংলাপ বলবো। হয়তো এটাই রহস্য..." 

তাঁকে কেউ দারুণ অভিনেতা বললে তিনি এতটা খুশী হতেন না, যতটা হতেন শিল্পী বললে। তাঁর মতে, "অভিনেতা তো হাজার হাজার আছে, শিল্পী আছে ক'জন? একজন অভিনেতা খারাপ মানুষ হতে পারেন, নোংরা কাজ করতে পারেন, কিন্ত একজন শিল্পী কখনোই খারাপ কিছু করবেন না, কাদায় পা ডোবাবেন না..."; সিনেমাপাড়ায় একটা বিষয়ে তাঁর নামে সুনাম এবং দুর্নাম দুটোই ছিল, মানুষ হিসেবে তিনি অসম্ভব স্পষ্টভাষী। মনে যা আসে, যেটা তাঁর কাছে ভালো বা খারাপ মনে হয় সেটা মুখের ওপর বলে দেন, সেই সৎসাহসটা তাঁর ছিল। 

নিজের প্রতিভা আর পরিশ্রম দিয়ে পাঁচ দশক পার করেছেন চলচ্চিত্রজগতে, সিনেমার ভালো দিন দেখেছেন, খারাপ সময়ের সাক্ষী ছিলেন, কাউকে তোয়াজ বা তোষামোদ করে কাজ বাগিয়ে নেননি কখনও, পরিচালকেরাই তাঁর পেছনে লাইন দিয়েছে শিডিউল পাবার জন্যে। একটা সময়ে বলা হতো, রাজ্জাক সাহেবের ডেটও এক সপ্তাহ ঘুরলে পাওয়া যায়, এটিএম শামসুজ্জামানেরটা তো একমাস গেলেও নিশ্চিত হওয়া যায় না! সেটা আশির দশকের ঘটনা, রাজ্জাক-আলমগীর-ফারুক-জসিম-জাফর ইকবাল-ইলিয়াস কাঞ্চন সবার সঙ্গেই চুটিয়ে কাজ করেছেন তিনি, তাঁর সময়ের তখন দারুণ অভাব ছিল সত্যিই! সেই মানুষটা সত্যি কথা বলতে কারো ধার ধারবেন না, এমনটাই তো স্বাভাবিক। 

তাঁর মধ্যে কোন পিছুটান নেই, কারো পরোয়া করার কোন ব্যাপার নেই, কাউকে তেলানোর অভ্যাসও ছিল না কোনকালে। আড়ালে আবডালে লোকে তাঁর ঠোঁটকাটা স্বভাব নিয়ে দু-চার কথা বলে, কিন্ত সিনেমাপাড়ায় এটাও তাঁকে অন্যরকম একটা সম্মানের জায়গায় অধিষ্ঠিত করেছিল, সেই সম্মানটা বজায় আছে এখনও। 

আশির কাছাকাছি বয়সেও যৌবনের উদ্দীপ্ত আভা যেন ঝরে পড়তো তাঁর শরীর থেকে, তিনি ছিলেন দারুণ প্রাণবন্ত, তাঁর প্রতিটা কথায় এখনও প্রাণখুলে হেসে উঠত সবাই। প্রতি বছর নিয়ম করে বারদুয়েক তার মৃত্যুর গুজব রটানোটা আমাদের মিডিয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তবুও বয়স ঘড়ির কাঁটায় ঊনআশিতেও তিনি তারুণ্যের দূর্বিনীত অহঙ্কার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন মৃত্যুর আগ অব্দি, নিজের কাজ আর কাজের প্রতি সবটুকু সম্মান আর ভালোবাসাকে সঙ্গী করে। তার মৃত্যুর গুজবে আমাদের আর উৎকণ্ঠিত হতে হবে না, খবরের সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে হবে না। তিনি যে চিরতরে চলে গেছেন না ফেরার দেশেই...

ফিচার্ড ইমেজ- আরিফ আহমেদ ফটোগ্রাফি


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা