আনন্দ এল রায় এবার ফিরলেন 'আতরাঙ্গি রে' নিয়ে। 'রানঝানা'র ধানুশকে আনলেন। সুপারস্টার 'অক্ষয় কুমার'কে আনলেন। 'ট্রোজান হর্স' হিসেবে 'সারা আলী খান'কেও আনলেন। মিউজিক ডিরেকশনে রাখলেন এ আর রহমান কে। গল্পে থাকলেন হিমাংশু শর্মা৷ রক্ষণ থেকে আক্রমন...সব দিকেই তিনি দক্ষ মানুষদের বসালেন৷ আঁটসাঁট বেঁধে নামলেন মাঠে৷ এবার সিনেমা না সুপারহিট হয়ে যাবে কই? কিন্তু, আসলেই সিনেমাটি কি সেরকম দুর্দান্ত হলো?

২০১১ সালের দিকে আনন্দ এল রায়ের সিনেমা 'তানু ওয়েডস মানু' যখন মুক্তি পেলো, এই সিনেমা দেখার পর আপামর দর্শক কিছুটা চমকেই গিয়েছিলো যেন। প্রথমত- বলিউডের কমার্শিয়াল মুভি ফরম্যাটে এ সিনেমা বিস্তর এক চমক। মফস্বল এক গ্রাম, সে গ্রামের মারদাঙ্গা এক মেয়ে গল্পের প্রোটাগনিস্ট, তাকে ঘিরে লতায়-পাতায় এগোচ্ছে গল্প, আবার সে গল্পে যুক্ত হচ্ছে বানিজ্যিক মালমশলাও...এ ফর্মুলা বলিউডে এর আগে সেভাবে কেউ এক্সপেরিমেন্ট করেনি। সে হিসেবে, প্রথম এক্সপেরিমেন্টেই বাজিমাত করেন এই নির্মাতা। এরপর এক বছর বিরতি। মুক্তি পায় 'রানঝানা।' বলিউডের আধুনিক রোমান্টিক  সিনেমাগুলোর মধ্যে যে সিনেমাকে প্রথম সারিতেই রাখবেন অনেকে। পাশাপাশি, এ সিনেমার মাধ্যমে ধানুশেরও অভিষেক হয় বলিউডে, সিনেমায় তার অভিনয়ও হয় দুর্দান্ত। 'রানঝানা'র পরে এক বছরের বিরতি। আনন্দ এল রায় ফেরেন 'তানু ওয়েডস মানু রিটার্নস' নিয়ে।' এ সিনেমাও সুপারহিট! বলিউডে 'আনন্দ এল রায়' তখন নতুন এক সেনসেশন। পাশাপাশি, এ সময়ে তিনি যেসব সিনেমাতে অর্থলগ্নি করলেন, সেসব সিনেমাও হতে থাকে জনপ্রিয়। তুম্বাদ, শুভ মঙ্গল জাদা সাবধান, নিল বাটি সান্নাটা'সহ ভিন্ন স্বাদের কিছু সিনেমার সাথে 'প্রযোজক' হিসেবে যুক্ত থাকে তার নামও। 

এরপর তিন বছরের গ্যাপ দিয়ে নির্মাতা হিসেবে তিনি আসেন 'জিরো' সিনেমা নিয়ে। অনসম্বল কাস্ট, বিগ বাজেট আর চাপা ফিসফাস...সব মিলিয়ে-মিশিয়ে বেশ বড়সড় এক প্রত্যাশা তৈরী হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার,  'জিরো' খুব মারাত্মকভাবে গোত্তা খেয়ে পড়ে বক্স অফিসে। গল্পটাই এত বাজে, এ গল্পের সিনেমা বেশিদূর না যাওয়াটা ছিলো তীব্র প্রাসঙ্গিকও। 'জিরো'র বদৌলতে কিছুটা ব্যাকফুটেই যেন পড়ে যান বলিউডের অন্যতম গুণী এ নির্মাতা। আনন্দ এল রায় কিছুটা দম নেন এরপর। আদা জল খেয়ে নামেন। ফেরেন 'আতরাঙ্গি রে' নিয়ে। 'রানঝানা'র ধানুশকে আনেন। সুপারস্টার 'অক্ষয় কুমার'কে আনেন। 'ট্রোজান হর্স' হিসেবে 'সারা আলী খান'কেও আনেন। মিউজিক ডিরেকশনে রাখেন এ আর রহমান কে। গল্পে থাকেন হিমাংশু শর্মা৷ রক্ষণ থেকে আক্রমন...সব দিকেই তিনি দক্ষ মানুষদের বসান৷ আঁটসাঁট বেঁধে নামেন মাঠে৷ এবার সিনেমা না সুপারহিট হয়ে যাবে কই?

এ সিনেমা সুপারহিট হবে কী হবে না, তা জনতা-জনার্দন জানাবেন৷ কিন্তু 'আতরাঙ্গি রে'র গল্পটা যে একটুও জাতের হলো না, সে নিয়ে আক্ষেপ রইলো এবারেও।  সিনেমার ট্রেলারেই যেমন বলা হচ্ছিলো- এখানে অন্যরকম এক প্রেমের গল্প দেখবে সবাই। সে প্রেমের গল্প দিয়েই শুরু হয় সিনেমা। বিহারের মারদাঙ্গা মেয়ে রিঙ্কুর সাথে দুর্ঘটনাক্রমে বিয়ে হয় তামিল ছেলে বিশুর। যদিও বিয়েটা যেরকম অদ্ভুতুড়ে ভাবে হয়, সে নিয়ে তীব্র অসন্তোষ আছে। সিনেমাতেই দেখা যাবে সে অসন্তোষ। এখানে তাই আর খোলাসা না করি বরং। জানা যায়, রিঙ্কুর বহু আগে থেকে এক মুসলিম ছেলের সাথে প্রেম। এদিকে বিশুরও প্রেম তার কলেজের ডিনের মেয়ের সাথে। এই পাকেচক্রের অদ্ভুতুড়ে বিয়ে তাদের দুইজনেরই লাভ-লাইফে ক্রাইসিসের অনিশ্চিত পর্দা ঝুলিয়ে দেয়৷ বিয়ের পরে তাই দু'জনেই সিদ্ধান্ত নেয়, যে যার স্ব স্ব ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরে যাবে। সবই ঠিকঠাক, পরিকল্পনাও প্রস্তুত, কিন্তু এরইমাঝে ঘটে আরেক অঘটন। এই দু'জন আবার নিজেরাই একে অন্যের প্রেমে পড়ে যান। ফলশ্রুতিতে, গল্পের গোটা সমীকরণও তখন খানিকটা 'চুরুলি' বা ঘুর্নাবর্তে পড়ে যায়। এরপর কী হয়? তা আর না বলি। সিনেমাতেই দ্রষ্টব্য।

'আতরাঙ্গি রে'র দুই প্রোটাগনিস্ট!

প্রথমত, সিনেমার আড়াই ঘন্টার গল্পে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব, ফ্যান্টাসি, মেন্টাল হেলথ, ইমোশনাল রোলারকোস্টার, ম্যাজিক রিয়েলিজম, মারামারি.. গিজগিজে সব উপাদানের উপস্থিতি। অবশ্য সিনেমায় অজস্র লেয়ার থাকতেই পারে। এক্ষেত্রে তাই গুরুত্বপূর্ণ সেটাই, লেয়ারগুলোকে কিভাবে যুক্ত করা হচ্ছে গল্পের সাথে, কিভাবে সেই লেয়ারগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করা হচ্ছে দর্শকের কাছে। এবং ঠিক এখানে এসেই 'আতরাঙ্গি রে' হারিয়েছে তার প্রাসঙ্গিকতা। দুর্ঘটনাক্রমে হওয়া দুইজন মানুষের বিয়ে যেভাবে দেখানো হচ্ছে, তা যেমন প্রাসঙ্গিক হচ্ছে না, ঠিক একইভাবে সম্পূর্ণ অপরিচিত দুইজন মানুষের মধ্যবর্তী রসায়নও ঠিক জমছে না৷ বিশ্বাসযোগ্য লাগছে ন৷ গল্পের যেটা সবচেয়ে বড় টুইস্ট, তা দেয়া হচ্ছে সিনেমার মাঝখানে। এবং টুইস্টটা যেভাবে দেয়া হচ্ছে, সেখানেও বিস্তর অবহেলা। এবং এই টুইস্টের পরবর্তী অংশটুকুতে যা হচ্ছে, সেটি উদ্ভট পাগলামি কিংবা টাইম-পাস। মনে হচ্ছে, গল্পের গরু গাছে উঠতে গিয়ে মঙ্গলগ্রহ পানে ছুটছে, যেমনটি ছুটেছিলো নিকট অতীতের 'জিরো' সিনেমাতেও! 

অভিনয়ে আসি। ধানুশের অভিনয় ভালো। সারা আলী খানও চেষ্টা করেছেন। আগের চেয়ে অভিনয়েও উন্নতি হয়েছে তার। কিন্তু কিছু দৃশ্যে এখনো তিনি বেমানান। হয়তো ক্রমশ ঠিক হবে যাপিত ত্রুটি। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে বিস্তর হতাশ করেছেন অক্ষয় কুমার। এই সিনেমায় তার যতটুকু অংশ, এ অংশটুকু কেন তাকে দেয়া হলো, এ অংশটুকু কী আরেকটু ভালোভাবে লেখা যেতো কী না...এসব প্রশ্ন সিনেমা দেখতে দেখতে ক্রমেক্রমেই আসবে মাথায়। অক্ষয় কুমার যে মাপের অভিনেতা, সে বিবেচনায় এই টিপিক্যাল, লাউড চরিত্র আক্ষেপ বাড়িয়েছে ক্রমশ। বাদবাকিরা তথৈবচ। খুব একটা উল্লেখযোগ্য না কেউই

অক্ষয়, সারা, ধানুশ! 

তবে 'আতরাঙ্গি রে'র এতসব ঋণাত্মক অনুষঙ্গের ভীড়েও একটি খুব বড়সড় ধনাত্মক দিক - মিউজিক। এ আর রহমানের কম্পোজিশনের গান, বিজিএম সবই সুন্দর। শ্রুতিমধুর। পাশাপাশি 'তুম্বাদ'খ্যাত পঙ্কজ কুমারের সিনেম্যাটোগ্রাফীও সুন্দর। ভিএফএক্স এর কাজ যতটুকু, তাও ছিমছাম। সিনেমা শেষে সব বিভাগকে ধরে ধরে কৃতিত্ব দেয়ার বিষয়টিও ভালো লেগেছে৷

এটা তো ধ্রুবসত্যি, গল্প যেরকমই হোক, সে গল্পের এক্সিকিউশন যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাহলে সে গল্পকে উপজীব্য করে আসা নির্মাণ প্রাসঙ্গিকতা হারায়। গল্পে সবকিছুই যে রিয়েলিস্টিক হয় সবসময়, তাও না। গল্পে রাক্ষস-খোক্কস আসতে পারে, ইউএফও আসতে পারে, আসতে পারে গ্রিম ভাইদের রূপকথাও। যা-ই আসুক না কেন, সে গল্প যদি দর্শককে জব্দ না করতে পারে, সে গল্প যদি দর্শককে হাততালি দেয়াতে বাধ্য না করতে পারে, তাহলে সে গল্প নিয়ে আর যাই হোক, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায় না। যেটা হয়েছে 'আতরাঙ্গি রে'র ক্ষেত্রে। আশা করবো- পুরোনো নিজেকে হারিয়ে বিব্রত 'আনন্দ এল রায়' খুব তাড়াতাড়িই ফিরবেন আবার৷ গত দুই সিনেমার ভুল শুধরে চমকের কোনো সিনেমা নিয়ে খুব শীঘ্রই ফিরবেন তিনি, সেজন্যে তাই রইলো শুভকামনা। 

 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা