আয়ুষ্মান খুরানার সিনেমায় জাতপ্রথার বিষবাষ্প, সেক্স পজিটিভিটি, ফ্যাটফোবিয়া, এলজিবিটিকিউ, লোনলিনেস, ট্রান্সজেন্ডার কমপ্লেক্সিটি সহ নানা বিষয়ে বহু বার্তাই পাওয়া যায়। কিন্তু সিনেমালব্ধ সেসব জ্ঞান দূরে সরিয়ে যদি কেউ শুধুমাত্র ব্যক্তি আয়ুষ্মান খুরানার দিকে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখেন, তাহলেও এমন সব বিষয়ের সন্ধান পাবেন, যা জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখার অনুভূতিই পালটে দেবে পুরোপুরি...
চণ্ডীগড় থেকে যখন প্রথম মুম্বাই আসি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যতদিন না কাজের কোনো সুযোগ পাই, আমি মুম্বাইয়ের কোনো বীচ দেখবো না। মানু্ষ মুম্বাই এলে প্রথমে একবার হলেও জুহু বীচে যায়ই। আমি সেই বীচেও যাইনি। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে যখন বীচ পড়তো, চোখ নামিয়ে নিতাম। এভাবেই চলছিলো। কিছুদিন পরে যখন 'রেডিও জকি' হিসেবে কাজ পেলাম, প্রথমেই যা করলাম, চলে গেলাম জুহু বীচে৷ দুই হাত দুইপাশে বাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললাম-
ওয়েলকাম টু মুম্বাই!
কথাটুকু যে মানুষটির, তিনি মুম্বাইয়ে আছেন বহুদিন। শুধু যে আছেন, তা না। বেশ সদর্পেই আছেন। মানুষের চোখের মধ্যমণি হয়ে আছেন। বিলবোর্ডের মানচিত্রে আছেন। সংবাদের শিরোনামে আছেন। আছেন মানুষের প্রশংসা, স্নেহ ও ভালোবাসায়ও। মানুষটি বলিউডে সম্প্রতি পারও করেছেন এক দশক। এই এক দশকের ক্যারিয়ারে পেয়েছেন নানারকম জীবনমুখী শিক্ষাও৷ প্রথম সিনেমার সাফল্যের পর দেখেছেন রাতারাতি জনপ্রিয়তা। আবার সে সিনেমার পরেই একাধিক সিনেমা ফ্লপ হওয়ায় অজস্র মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন অকুন্ঠ বিদ্রুপও। খুব অল্পসময়েই মূদ্রার দুইপাশ দেখেছেন। এবং বুঝেছেন- ভেবেচিন্তে এগোতে হবে এবার। এগিয়েছেনও। পরবর্তীতে এমন সব সিনেমায় অভিনয় করেছেন, সিনেমাগুলো কমার্শিয়াল টেক্সচার, আর্টফর্ম ও সোশ্যাল মেসেজের অদ্ভুত সুন্দর মিশেল হয়ে টিকে রয়েছে আজও। আস্তে আস্তে নিজের এক আলাদা জঁরাই তৈরী করে ফেলেছেন তিনি। পেয়েছেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসহ বহুকিছু। অল্পসময়ের মধ্যেই এত সাফল্য, তবু পা বরাবরই মাটিতে। তবু প্রশংসায় এখনো জড়িয়ে আসে গলা। যে মানুষটিকে নিয়ে কথাবার্তা, এরইমধ্যে অনেকেই হয়তো তাকে চিনে ফেলেছেন। কিন্তু যারা চেনেননি, তাদের জন্যেই বলা, মানুষটি- আয়ুষ্মান খুরানা।
প্রিয় অভিনেতা ইরফান খান'কে কখনো তারকা মনে হতোনা। মনে হতো, আশেপাশেরই কোনো মানুষ৷ যে মানুষ ঘরে এলে 'দাঁড়ান, চেয়ারটা একটু মুছে দিই, এরপর বসুন' বলার ভদ্রতা দেখাতে হয়না। ক্যামেরার চোখে হৃদয়ের ঠিকঠাক প্রকোষ্ঠে ইরফান খান এমনভাবেই ঢুকে গিয়েছিলেন, 'তারকা'দ্যুতি উপেক্ষা করে তিনি একসময়ে রূপান্তরিত হয়েছিলেন আটপৌরে প্রিয় মানু্ষে। যদিও ইরফান খানের সাথে আয়ুষ্মান খুরানার অভিনয় ক্ষমতার তুলনা মোটেও করছি না, কিন্তু যেসব সিনেমায় আয়ুষ্মান খুরানাকে দেখেছি, এবং যেসব চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন, সেসবের মিলিত যোগফলে তিনি নিজেও যে কখন পরিণত হয়েছেন অনাড়ম্বর প্রিয় মানুষে, তা আর বুঝে ওঠা হয়নি।
যেসব চরিত্রে অভিনয় তার, হোক তা 'বালা'র বালমুকুন্দ, 'ভিকি ডোনার' এর 'ভিকি অরোরা' কিংবা 'বাধাই হো'র 'নকুল কৌশিক', এই চরিত্রগুলো এতটাই সাধারণ, তথাকথিত হিরোদের 'লার্জার দ্যান লাইফ' থেকে এতটাই ভিন্ন, খুব সহজেই যেন তারা মিশে গিয়েছে মানসপটে। চরিত্রগুলোও এমন, প্রত্যেক পরিবারে, প্রত্যেক মহল্লায় খুঁজলে এরকম দুয়েকটা মানুষকে পাওয়া যাবেই যাবে। এবং সেটাই মূলত আয়ুষ্মান খুরানার অন্যতম ইউএসপি। এক্স ফ্যাক্টর। তিনি নিজেই যেমন বলেন-
আমি যেসব চরিত্রে অভিনয় করি, সেসব চরিত্রের অধিকাংশই স্পাইডার-ম্যান এর মতন। প্রচণ্ড ভালনারেবল। কমপ্লেক্স। আবার দিনশেষে এরা খুব শক্তিশালীও। যদিও লার্জার দ্যান লাইফ ক্যারেক্টারে অভিনয় করিনি। কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে, এই চরিত্রেরাও কম না মোটেও!
আয়ুষ্মান খুরানা ব্যক্তিজীবনেও 'স্পাইডার-ম্যান' এর ভক্ত। এবং হয়তো সে কারণেই স্পাইডার-ম্যানের মত তাকেও নিয়মিত যুঝতে হয়েছে পরিস্থিতির সাথে। উল্টোস্রোতের সাথে। প্রথম প্রথম যখন মুম্বাই এলেন, তখন এমনও হয়েছে, কাজের চাপে মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমানোর সময় পেতেন সারাদিনে! তখন সবেমাত্র পায়ের নীচের মাটি শক্ত হচ্ছে। সেই অনিশ্চিত সময়ে, কাজের বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলেও তিনি ছাড়তেন না৷ রেডিও জকি, দুয়েকটা ছোটখাটো অভিনয়ের সুযোগ, টুকরোটাকরা কাজ, সময় করে লেখালেখি... চলতো সবই। কাজের চাপে পরিবারের সাথে কথা বলাও বন্ধ হয়ে যেতো সময়ে সময়ে। তবে তাতে বিচলিত হতেন না তিনি। তিনি জানতেন, থামলেই মৃত্যু। থামা যাবেনা। অর্থাৎ, শো মাস্ট গো অন!
নাভিশ্বাস ওঠা এ সময় একপর্যায়ে এসে থামলো। সুদিন ফিরলো। 'ভিকি ডোনার' সিনেমায় অভিনয় করে রাতারাতি সাফল্যও পেলেন আয়ুষ্মান। চারপাশে হুল্লোড়, প্রশংসার বন্যা, অ্যাওয়ার্ড... বহুকিছু। কিন্তু এরপরই যবনিকাপাত! বেওকুফিয়ান, হাওয়াইজাদা... দুই সিনেমা পরপর ফ্লপ। রাতারাতি গজিয়ে উঠলো সমালোচকদের তরবারি। মানুষজনের বিদ্রুপ, কটাক্ষ এতটাই সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছালো, আয়ুষ্মান খুরানা একবার ভেবেওছিলেন, সব গুটিয়ে চণ্ডীগড় ফিরে যাবেন আবার। কিন্তু এরইমধ্যে, খানিকটা দৈবক্রমেই যেন এলো 'দম লাগা কী হাইশা'র ট্রেলার। সে ট্রেলার এতটাই দারুণ, মানুষজনের 'রা' কাটা বন্ধ হয়ে গেলো। আয়ুষ্মান খুরানা ফিরলেন পাদপ্রদীপের তলে। ব্যাক টু ব্যাক সিনেমা ফ্লপ হওয়া আয়ুষ্মান খুরানাকে শিক্ষা দিলো, তাড়াহুড়ো না করার শিক্ষা। আয়ুষ্মান খুরানা বুঝলেন, এটা মুম্বাই। পা পিছলে গেলেই মহাপতন। এও বুঝলেন- সফলতা এবং ব্যর্থতার চেয়ে বড় কোনো শিক্ষক নেই৷ তার ভাষ্যে-
আমি সৌভাগ্যবান, ক্যারিয়ারের শুরুতেই ব্যর্থতাগুলো দেখেছি। যদি আরও পরে এরকম হোঁচট খেতাম, তাহলে আর উঠে দাঁড়াতেই পারতাম না।
আয়ুষ্মান খুরানা এরকম ধাক্কা খেয়েছেন বারবার, সেখান থেকেই আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এভাবে ঠেকে ঠকে সময়ের নানা চলকে যে শিক্ষা তিনি পেয়েছেন, মূলত সেসবই তার চিন্তাকে করেছে পরিশুদ্ধ। এবং এভাবেই মূলত তৈরী হয়েছে জীবনকে দেখার চোখ। এবং জীবনকে তিনি যেভাবে দেখেন, সেসবই মূলত তার সিনেমাগুলোয় ফুটে উঠেছে বরাবর৷ যদিও জীবনকে গভীরভাবে দেখার পুরো কৃতিত্ব তিনি দেন নিজের স্ত্রী তাহিরা কাশ্যপকেই। যে তাহিরা বহুদিন লড়েছেন ক্যান্সারের সাথে। এবং এই লড়াইটা খুব কাছ থেকে দেখেছেন বলেই, আয়ুষ্মান দাবী করেন, তার চিন্তাভাবনায় এসেছে বিস্ময়কর সব বাঁক-
এমনও হয়েছে আমার সিনেমার ওপেনিং ডে'র জমকালো প্রোগ্রাম চলছে। অথচ আমি যেতে পারছি না৷ কারণ, আমি তখন হাসপাতালে। তাহিরার কেমোথেরাপি চলছে। আমার জীবনের সুখ ও দুঃখের সময়গুলো হেঁটেছে পাশাপাশি। আমি তাই কোনোকিছু নিয়েই খুব বেশি অখুশি হইনা। আক্ষেপ করিনা। কারণ, আমি জানি, জীবন ব্যালেন্স করে দেয়। আহামরি কোনো কিছুই পাওয়া হবেনা এ জীবন থেকে। তাই, সে আশা করিওনা।
বিনা শর্তে জীবনকে এভাবে মেনে নেয়ার শিক্ষা বারবারই দেখি আয়ুষ্মান খুরানার মধ্যে। নিরহংকার থেকে অকপটে নিজের দোষ স্বীকার করতেও তিনি করেন না কার্পণ্য। তথাকথিত তারকাদের মত 'অহংকার'ও নেই তার। এখনও কোনো সিনেমার স্ক্রিপ্ট পছন্দ হলে নিজে থেকে চলে যান পরিচালকের কাছে। তিনি যে সেই সিনেমায় অভিনয় করতে চান, সেটা নিজে থেকেই বলেন। যে কাজটি তিনি করেছিলেন, 'আন্ধাধুন' সিনেমার সময়ে। ঘটনাক্রমে তার হাতে এসে পড়েছিলো 'আন্ধাধুন' এর স্ক্রিপ্ট! স্ক্রিপ্টটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পড়া শুরু করেন তিনি। এবং মূলগল্পটা তার এতই ভালো লেগে যায়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে যান শ্রীরাম রাঘবনের কাছে। গিয়ে বলেন, তার আগ্রহের কথা। বলেন-
স্যার, যত স্ক্রিন-টেস্ট করা লাগে করতে পারেন। আমি পিয়ানো বাজাতে পারি। অন্ধ চরিত্রে থিয়েটারে অভিনয়ও করেছি। আমি মনে করি, এ চরিত্রটা আমি পারবো। আমি এ সিনেমায় কাজ করতে চাই।
শ্রীরাম রাঘবন এরপর কিছু স্ক্রিন-টেস্ট করান আয়ুষ্মান খুরানার। সেসবে ভালোভাবেই উতরে যান তিনি৷ এরপর অভিনয়ে ডাক আসে তার৷
আয়ুষ্মান খুরানা এরকমই। যদি কোনো গল্প পছন্দ হয়, তাহলে নিজে থেকেই চলে যাবেন, 'স্টার স্ট্যাটাস' নিয়ে ভাববেন না একবিন্দুও। তার নিজের ভাষায়, তিনি একজন 'ওয়ার্কার।' আর ওয়ার্কারকে কাজ তো নিজে থেকেই খুঁজে নিতে হবে! এবং সেভাবে কাজ খুঁজতে বিন্দুমাত্রও গ্লানি নেই তার।
এখন আশেপাশে কাজের প্রচুর চাপ। কন্টেন্ট, অ্যাডভারটাইজিং, মিডিয়া হ্যান্ডেলিং, প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন... বহুকিছু নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তবুও, এত ব্যস্ততার পরেও, আয়ুষ্মান খুরানার কাছে তার স্ত্রী, তার পরিবারই ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তাদের কাছে মুহুর্তখানেক বসলেই যেন ব্যস্ত সময়ে পাগলের মত ছোটার রসদটুকু পেয়ে যান তিনি। হাতে খানিকটা সময় পেলে এখনও বইও পড়েন। হিন্দি সাহিত্যের ভক্ত আয়ুষ্মান। নিজে লেখেনও। কবিতা লেখেন। তার সোশ্যাল মিডিয়া চেক করলে যেসব কবিতা ও ক্যাপশন পাওয়া যায়, সেসবও তারই লেখা।
এই অভিনেতার সিনেমা থেকে জাতপ্রথার বিষবাষ্প, সেক্স পজিটিভিটি, ফ্যাটফোবিয়া, এলজিবিটিকিউ, লোনলিনেস, ট্রান্সজেন্ডার কমপ্লেক্সিটি সহ নানা বিষয়ে বহু বার্তাই পাওয়া যায়। কিন্তু সিনেমালব্ধ সেসব জ্ঞান দূরে সরিয়ে যদি কেউ শুধুমাত্র ব্যক্তি আয়ুষ্মান খুরানার দিকে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখেন, তাহলেও এমন সব বিষয়ের সন্ধান পাবেন, যা জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখার অনুভূতিই পালটে দেবে পুরোপুরি। যেখানে মূর্ত হবে এই বার্তাই-
জীবনে প্রাপ্তি যেমন থাকবে, তেমনি শূন্যস্থানও থাকবে। প্রাপ্তির পাশাপাশি মেনে নিতে হবে শূন্যস্থানকেও। দুটিকে পাশাপাশি নিয়েই এগোতে হবে। তাহলেই জীবন সুন্দর।
পায়ের তলার সর্ষে থাকার পরেও যিনি ভুলে যাননি নিজের মনুষ্যত্বকে, ছোট ছোট প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে, 'বিন্দুতে সিন্ধু'কে ধারণ করার মত যিনি জীবনঘনিষ্ঠ সব উপলব্ধিকে করেছেন পথের পাথেয়, 'ঝিনুক নীরবে সহো'র মত সয়ে যাচ্ছেন নানামুখী স্রোতের দাপট, সে আয়ুষ্মান খুরানা বলিউডে আরো বহুসময় থাকবেন, নিজের চিন্তাভাবনা আর সিনেমার গভীর বার্তা মিলিয়ে দর্শককে ঋদ্ধ করবেন, দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হবেন, এটাই প্রত্যাশা। সেজন্যেই রইলো শুভকামনা।