গুরু আজম খান গাইছেন, চোখ ছলছল করছে। তিনি গাইছেন, বাচ্চু তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাচ্ছেন। অসুস্থ, আবেগপ্রবণ মানুষটা জোরে চিৎকার দিয়ে বললেন, 'গাওওওওও বাচ্চু...'

গুরু আজম খানের প্রিয় শিষ্য আইয়ুব বাচ্চু। কত কনসার্ট দুইজনে মাতিয়েছেন একসাথে তার কি কোনো হিসেব আছে! নব্বুইয়ের দশকের ঘটনা। মতিঝিল মডেল স্কুলের পেছনে প্রগতি মাঠে ওপেন এয়ার কনসার্টের আয়োজন হয়েছে। ১০০ টাকা টিকেট হবার কথা, তাই টিন, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল চারপাশ। কিন্তু জনতার প্রবল চাপে কিসের টিন, কিসের কি। যে কনসার্টে গুরু আসবে, সেই কনসার্টকে কি বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা যাবে। তার সাথে আছে এলআরবি। জনতা টিনের বেড়া টেড়া ভেঙ্গে একাকার অবস্থা করে ফেলেছে। পরিস্থিতি দেখে ঘোষণা আসলো, কনসার্ট সবার জন্য উন্মুক্ত, ততক্ষণে উন্মুক্ত করার কিছুই আর বাকি ছিল না। 

আইয়ুব বাচ্চু তখন গানের লাইনে বেশ পরিচিত, ডাবল এলবাম বের করে সুপারহিট। চারদিকে তার নাম। তিনি মঞ্চে উঠলেন। গাইলেন একে একে তার সৃষ্টি করা মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীত। মাধবী, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, হকার, সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে বাজছে, জনতার সমবেত চিৎকারে কান পাতা দায়। রুপালি গিটার গানটা যখন ধরলেন তখন আসলেন, গুরু আজম খান। পরণে ঢিলেঢালা একটা ট্রাউজার, আর সাদাসিধে একটা টিশার্ট। 

হঠাৎ, আইয়ুব বাচ্চু গান থামিয়েই বললেন, "আমার গুরু চলে এসেছেন, আমি আর গাইবো না।" আজম খানের প্রতি এরকমটাই শ্রদ্ধাবোধ ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। আজম খানও প্রিয় শিষ্যকে জড়িয়ে ধরলেন। বুকে জড়িয়ে বললেন, "আমি হয়ত বেশিদিন থাকবো না, মনে রাখিস আমারে তোরা..." 

অসুস্থ আজম খানকে ভুলেননি কখনো আইয়ুব বাচ্চু। এরপর আরো বেশ কবার গুরুর সাথে এক মঞ্চে বাজিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। গুরুর সাথে বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেন আইয়ুব বাচ্চু। তাদের দুজনের রসায়ন এত চমৎকার যে বাংলালিংকের সেই বিজ্ঞাপনটাকে এখনো ভাল লাগে। সেই বিজ্ঞাপনে আইয়ুব বাচ্চু গুরুর ইন্ট্রোডাকশন দিচ্ছিলেন, গুরু সাদামাটা মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা। বলেছিলেন বিখ্যাত ডায়লগ, "গুরু তোমায় সেলাম।"

আজম খানের সাথে কিভাবে আইয়ুব বাচ্চুর এতখানি সখ্যতা হলো? একটা সময় আইয়ুব বাচ্চু ফেরারির মতো জীবনযাপন করেছেন। বোহেমিয়ান সেই জীবন কোনো এক্সিডেন্টাল ঘটনা না। একটা বনেদি পরিবারে জন্ম তার। অথচ, বুঝতে শেখার পর তিনি দেখলেন পারিবারিক বনেদিআনার কিছুই তাকে ছুঁতে পারছে না, টানছে না। তার ইচ্ছে বড় হতে হবে নিজের মতো করে। টুকটাক গিটার বাজাচ্ছেন তখন। ১৯৭৬ সালের এমনই এক সময়ে গুরু আজম খান আসলেন চট্টগ্রামে। মুসলিম হল মিলনায়তনে নিজের ব্যান্ড 'উচ্চারণ'কে নিয়ে কনসার্ট করতে এসেছেন গুরু। আজম খান তখন তরুণদের ক্রেজ। 

আইয়ুব বাচ্চু গেলেন সেই কনসার্টে। আজম খানকে দেখলন, লম্বা চুল, বোতাম খোলা শার্ট, ঝুঁকে গান গাইছেন, গিটার বাজাচ্ছেন। দেখে আইয়ুব বাচ্চুর মনে হলো, জীবনে আর কিছু চান না, তিনি এই কাজটাই করতে চান। সেদিন চট্টগ্রামে আইয়ুব বাচ্চুর মনে হলো, যেভাবেই হোক দেখা করতে হবে গুরুর সাথে। মঞ্চের পেছনে বাঁধা পেরিয়ে টপকে গিয়ে পড়লেন গুরুর সামনে। আজম খান দেখতে পেলেন এক টিনএজার তরুণকে, যার পায়ে জুতো নেই। ঘেমে জবুথবু অবস্থা। গুরুকে সামনে পেয়ে আইয়ুব বাচ্চু বললেন, তার স্বপ্নের কথা। গুরু তখন মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে দিলেন তাকে। 

সেদিনকার সেই মুগ্ধতা, গুরুর প্রতি ভালবাসা এতটুকু কমেনি কখনো। নিজে যখন নাম কামিয়েছেন, যশ খ্যাতি পেয়েছেন, তার নিজের গানই সুপারডুপার হিট, তখনো আইয়ুব বাচ্চু কনসার্টে কিংবা লাইভ শোতে সুযোগ পেলে গুরুর একটা গান কাভার করতে দ্বিধা করতেন না। সবচেয়ে জমে যেত যখন গুরু আজম খান আর আইয়ুব বাচ্চু এক স্টেজে গান গাইতেন। তারা দুইজন এক হলে কি দুর্দান্ত একটা কম্বিনেশন হয়, তার একটা প্রমাণ এখনো আছে ইউটিউবে।

এক মঞ্চে আজম খান ও আইয়ুব বাচ্চু

আজম খানের সাথে আইয়ুব বাচ্চুর অদ্ভুত এক রসায়ন। এই রসায়নটা বুঝতে তারা সবচেয়ে বেশি পারবে, যারা সরাসরি গুরু আর গিটারের জাদুকরের একসাথে করা পারফর্মেন্স দেখেছে। তারা সত্যিই বড্ড সৌভাগ্যবান। যারা দেখেনি, সেই কনসার্টের ভিডিও একবার দেখলে তারাও বুঝবে কতটা আপন ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু আজম খানের, আজম খানও কতটা স্নেহ করতেন তার শিষ্যকে। 

কনসার্টটা হয়েছিল ২০০৫ সালে। কত আগের কথা। আজম খান তখন খুব একটা সুস্থ নেই। কিন্তু, স্টেজ কাঁপাতে বুক কাঁপে না তার। যখন লাইনটা দিয়ে শুরু করলেন, "রেললাইনের ওই বস্তিতে, জন্মেছিল একটি ছেলে..." প্রবল চিৎকারে ভেসে গেল যেন সব। আজম খান গান গাইছেন, গিটার হাতে আরেক লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু। গিটার বাজিয়ে যাচ্ছেন এবি, এক অদ্ভুত মূর্ছনার সৃষ্টি হলো। এমন ঝংকার সম্ভব কেবল তখন, যখন গুরু আর লিজেন্ড এবি একসাথে হন। 

'বাংলাদেশ' গানটা গাইবার সময় আজম খান বরাবরই আবেগপ্রবণ থাকেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেই হয়তো আবেগটা বেশি ধারণ করেন সবার চেয়ে। সেদিন আইয়ুব বাচ্চুর গিটারেরও কী যেন হয়েছে, ঝংকারে ঝংকারে যেন এবির গিটারটাও কাঁদানোর পায়তারা শুরু করেছে। গুরু আজম খান গাইছেন, তার চোখ ছলছল করছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে সেখানে জল টলমল করছে। তিনি গাচ্ছেন, বাচ্চু তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাচ্ছে। অসুস্থ, আবেগপ্রবণ মানুষটা জোরে চিৎকার দিয়ে বলেন, "গাওওওওও বাচ্চু....."। আইয়ুব বাচ্চুও তখন গানটা গাইলেন, গুরু তখন পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন আইয়ুব বাচ্চুকে। গুরু শিষ্যের এমন মিলনে আবেগপ্রবণ না হয়ে কে থাকবে! আজম খানের চোখে তখনও জল।

তিনি যখন গাও বাচ্চু বলে চিৎকার করেন, তখন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কান্না পায়। আজকে সেই কনসার্টের ভিডিও আবার দেখলাম, আহ, আজম খানের প্রিয় শিষ্য বাচ্চু যে আর গাইবেন না! সময় কি করুণ। সুন্দর মুহূর্তগুলোকেও কাঁদার উপলক্ষ্য বানিয়ে দেয়। সেই কনসার্টে আজম খানের "গাও বাচ্চু" বলাটা একরকম প্রতীকী যেন! যেন শিষ্যকে বলা, আমি আগামীতে নাও থাকলে তুই গাইবি বাচ্চু, তোরে গাইতেই হবে। আইয়ুব বাচ্চুও বেশিদিন আর গাইলেন কই! অন্যলোকে গিয়ে পাড়ি জমালেন, কে জানে এই পৃথিবীর কাছে লুকানো অভিমানগুলো লোকান্তরে গুরুর কাছে বলার কোনো তাড়াহুড়ো কিনা। 

গুরুকেও বেঁচে থাকতে কম অবহেলা সহ্য করতে হয়নি। আজম খান যখন মারা গেলেন, তাকে গার্ড অফ অনার দেয়া হচ্ছিল দেখে আইয়ুব বাচ্চু ক্ষোভ নিয়ে বলেন, বেঁচে থাকতে কেউ খোঁজ নেয় না, এখন গার্ড অফ অনার কেন। আইয়ুব বাচ্চু জীবিত অবস্থায় গুরুর সম্মান না পাওয়ায় যেমন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, তেমনি নিজেরও হয়ত না বলা অনেক ক্ষোভ জমেছিল তার। শেষের দিনগুলোর ফেসবুক স্ট্যাটাস তারই ইংগিত দেয়। বলেছিলেন পালাতে চান। যদিও সব কথা খোলাসা করে বলতে চাইতেন না। বলতেন, কিছু কথা থাকুক গোপন। সেই কথাগুলো বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছে জানিয়েছিলেন নাগরিক টিভিতে এসে। আইয়ুব বাচ্চুর জীবনী লেখার কথা ছিল তারই গীতিকার সাজ্জাদের। চেয়েছিলেন ৮/১০ দিন বাইরে থেকে ঘুরে আসবেন, মনের সব কথা বলবেন। যা যা বলতে পারেননি, যা গোপন, সব কথা, পুরো জীবনের কথা। সেই বইয়ের কদ্দুর কি করে যেতে পেরেছেন জানি না।

আইয়ুব বাচ্চু গোপন রেখে শুধুই ইংগিত দিয়ে গেলেন। সুখের পৃথিবীতে সুখের অভিনয় করে গেলেন। কেউ দেখলো না তার হাসি শেষের নীরবতা। গুরু আজম খানের পর আইয়ুব বাচ্চুরও এই চলে যাওয়া কতখানি হতাশার, কতটা ক্ষত আর শূণ্যতার তৈরি করেছে মনের মধ্যে, তা কেবল আমরাই বুঝি। তারা হয়তো ভালই থাকবেন, কথা কইবেন সুখে দুখের, মান অভিমান আদান প্রদান করবেন, মনের দুয়ার খুলে মনের কথা বলবেন। গুরু-শিষ্যতে আবার একত্র হবার পালা এখন। আমরা এই শুন্যতা নিয়ে কি করবো এখন সেটা তো বলে গেলেন না কেউ...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা