
বাঁধন কাঁদছিলেন, এবং তার আনন্দাশ্রু ক্রমশ সংক্রামিত হচ্ছিলো প্যারিস থেকে হাজার মাইল দূরের ছোট্ট এক ব-দ্বীপেও। কান্না সংক্রামক। বাঁধনের কান্নায় বাষ্পীভূত হচ্ছিলো সেই অপ্রতুল ভূখন্ডের মানুষের চোখও।
প্যারিসের বিখ্যাত পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের সাল দুবুসি প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভর্তি। দর্শকেরা সেখানে দেখতে এসেছে এমন একটি দেশের সিনেমা, যে দেশের সিনেমাহল ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ভালো সিনেমার অভাবে, দর্শকের অভাবে। সে দেশের পলেস্তরা-খসা প্রেক্ষাগৃহের রুপোলী পর্দায় এখন আলো অতীত, সেখানে ভর করে থাকে বহুপ্রাচীণ মাকড়সার জালের কটাক্ষ! এমন একটি দেশের সিনেমা এসেছে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের 'আঁ সাতেঁ রিগা' নামক মহাগুরুত্বপূর্ণ বিভাগে, যে বিভাগে অংশগ্রহণ করা সিনেমাগুলো উৎসবের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করার জন্যে লড়াই করে। এমন একটি দেশের সিনেমা আজ সাল দুবুসি প্রক্ষাগৃহে দেখানো হয়েছে, যে সিনেমা চলাকালীন এক ঘন্টা সাতচল্লিশ মিনিট পিনপতন নীরবতায় ডুবে ছিলো পুরো প্রেক্ষাগৃহ, যে সিনেমা শেষে উপস্থিত দর্শকেরা বুঁদ হয়ে ছিলেন বহুক্ষণ। যে সিনেমা এতটাই মুগ্ধ করেছে তাদের, নিজ নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু হাততালিতে তারা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নির্মাতা ও গোটা দলের উদ্দেশ্যে। সাল দুবুসি প্রেক্ষাগৃহে আসা সে সিনেমাটা বাংলাদেশের, সে সিনেমাটা আমাদের! সে সিনেমার নাম 'রেহানা মরিয়ম নূর'।
খুব মনোযোগ দিয়ে 'রেহানা মরিয়ম নূর' এর 'ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার' পরবর্তী দর্শকদের 'স্ট্যান্ডিং ওভেশন' এর সে ভিডিওটা দেখছিলাম। সিনেমার বাংলা ভাষা ঐ প্রেক্ষাগৃহের অনেকে দর্শকই বোঝেননি। সেটা বোঝা সম্ভবও না। তবু শুধু সাবটাইটেল আর কুশীলবদের অভিনয়ের ভাষায় ভর করে যতটুকু আকৃষ্ট হওয়া যায়, ঠিক ততটুকুতেই হয়তো ডুবে গিয়েছেন তারা। সিনেমা শেষেও তাই তারা স্থানু। ধাতস্থ হবার পরে তারা ঘিরে রাখলেন নির্মাতা সহ গোটা টিমকে। সাল দুবুসি'তে তখন হাততালিতে কান পাতা দায়। যেন হাজার পায়রার প্রবল পাখা ঝটপটানিতে কেঁপে উঠছে সহস্র আসনের সে হলরুম। হল্লা, হাততালি, হর্ষধ্বনি শুনছিলাম। হুট করে সবকিছু ছাপিয়ে ভেসে উঠলো একজন মানুষের কান্না। কাঁদছিলেন পর্দার 'রেহানা' বা বাস্তবের 'বাঁধন।' বিদেশ-বিভুঁইয়ে এত এত অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ একসাথে দাঁড়িয়ে যে ভালোবাসা ও সম্মানে সিক্ত করলো বাংলাদেশের একটি সিনেমাকে, সে বিরল সম্মানের সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হওয়াই বুঝি নিয়ম। চোখ ভিজে ওঠাও হয়তো খুব প্রাসঙ্গিক। বাঁধনও তাই নিজেকে সামলাতে পারলেন না। সামলালেনও না। নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ যতই তাকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছিলেন, ততই ভেঙ্গে পড়ছিলেন তিনি। বাঁধন কাঁদছিলেন, এবং তার আনন্দাশ্রু ক্রমশ সংক্রামিত হচ্ছিলো প্যারিস থেকে হাজার মাইল দূরের ছোট্ট এক ব-দ্বীপেও। কান্না সংক্রামক। বাঁধনের কান্নায় বাষ্পীভূত হচ্ছিলো সেই অপ্রতুল ভূখন্ডের মানুষের চোখও।

হবে নাও বা কেন? একটা ভালো নির্মাণের জন্যে হাপিত্যেশ কতদিনের, সে এদেশের মানুষই ভালো জানে। দেশের যেকোনো একটা 'মোটামুটি' নির্মাণ দেখলেও এদেশের মানুষ নিয়মিত আশাবাদী হয়েছে। আবার সে আশার প্রদীপ নিয়মিতই নিভেছে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা-উপেক্ষা-সীমাবদ্ধতায়। এই 'স্ট্যান্ডিং ওভেশন' তাই কোথায় যেন আমাদের এতদিনের লড়াইকেই সম্মান জানিয়ে যায়। এতকিছুর পরেও এদেশের সংস্কৃতিজগতের সাথে জড়িত মানুষেরা যে হাল ছাড়েননি একবিন্দুও, সেটারই যেন স্বীকৃতি মেলে সাল দুবুসি প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত এই মানুষদের কাছ থেকে।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নিভৃতচারী মানুষ। খুব বেশি কথা বলেন না। দেশের মিডিয়া তার টিকিটিরও সন্ধান পায় না। 'রেহানা মরিয়ম নূর' নিয়ে তাই আগেভাগে জানে নি কেউই। মানুষ তখনই জানলো, যখন এই সিনেমার পোস্টারে লেগেছে 'কান' এর লোগো। সময়ের পরিক্রমায় এখন অনেকটুকুই সবার জানা। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর ভাবনা, আজমেরী হক বাঁধন সহ গোটা টিমের টানা এক বছর ধরে অনুশীলন, একটা শটের পেছনে পঁচিশ-ত্রিশ টেক, সবার গাণিতিক নিয়ম মেনে অভিনয়ের প্রচেষ্টা- এর সবকিছু মিলেমিশে আঁ সাতেঁ রিগা, 'কান' এর লাল গালিচা, সাল দুবুসি হলরুম এর সম্মান! বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতের ইতিহাসে এরকম গর্বের দিন আর এসেছে কিনা, তা বিস্তর গবেষণারই এক বিষয়।

সীমিত কলাকুশলী আর তথৈবচ টেকনোলজি নিয়ে, প্রচার-প্রসারের ঢাকঢোল না পিটিয়েও যে দুর্দান্ত সব নির্মাণ করা সম্ভব, এবং সে নির্মাণ নিয়ে বিশ্বমঞ্চে এসে যে যথাযোগ্য সম্মান আদায় করাও সম্ভব, তা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ ও তার 'রেহানা মরিয়ম নূর' করে দেখালেন। বাকিরা কবে থেকে শুরু করবেন তাদের নির্মাণ নিয়ে এরকম শ্রম, ত্যাগ, যত্ন? আবার কবে এরকম বিরল সম্মানের অশ্রুজলে সিক্ত হবে এই দেশ, বাংলাদেশ? উত্তর দেয়ার জন্য কাল থেকে ভাবতে পারেন আমাদের নির্মাতারা। আজকের রাতটুকু কাটুক অশ্রুভেজা আনন্দে।
আরও পড়ুন-