পরিচালক সাদ তাকে বলেছিলেন, ‘এই ক্যারেক্টার যদি তুমি করতে না পারো, তাহলে আর কেউ পারবে না।’ সত্যিই বাঁধন ছাড়া অন্য কারো পক্ষে রেহানার এই স্ট্রেসফুল জার্নিটা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না, সম্ভব নয় এখনও...

সিনেমার নাম রেহানা মরিয়ম নূর। ট্রেলারের একটা জায়গায় শারীরিক নিপীড়নের শিকার হওয়া ছাত্রীটি তার শিক্ষিকাকে বলছেন, 'ম্যাম, আপনার সাথে তো আর কিছু হয় নাই। কেন আপনি এরকম করতেসেন?' সেই শিক্ষিকা, যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন, তিনি জবাবে কি বলেছেন সেটা আমরা শুনতে পাই না। কিন্তু বাঁধনের গল্পটা অল্পস্বল্প জানি বলেই মনে হলো, এই চরিত্রে তার চেয়ে পারফেক্ট কোন কাস্টিং হতে পারতো না! এমন নাছোড়বান্দা হয়ে সত্যের পথে দাঁড়ানোর কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করার কথা তো বাঁধনের গলাতেই শোভা পায়। নিজের জীবনে যিনি লড়ে এসেছেন, অধিকার আদায় করে নিয়েছেন, তাকে সিনেমাতেও প্রায় কাছাকাছি রকমের একটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখে রিল আর রিয়েল লাইফের মেলবন্ধনটা যেন খুব স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। 

আজমেরী হক বাঁধন, লাক্স চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগীতায় ২০০৬ সালের রানারআপ। প্রতিযোগীতায় জেতার জন্যে নয়, অংশ নিয়েছিলেন প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে কাছ থেকে একবার দেখতে পাবেন, এই আশায়। সেই বাঁধন নিজের মেধা আর প্রতিভার জোরে হয়ে গেলেন রানারআপ। ভাগ্যের পরিহাসটা দেখুন, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত দারুচিনি দ্বীপ সিনেমায় পরের বছর চার লাক্স সুন্দরী অভিনয় করলেন, অথচ সিনেমাটা করতে পারলেন না বাঁধন। কারণ তিনি তখন ডেন্টাল কলেজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। 

বাঁধনের গোটা জীবনটার দিকে তাকালেও মনে হবে, ভাগ্য যেন বারবার বক্রোক্তি করেছে তার দিকে তাকিয়ে। মিডিয়ায় তার ১৪ বছরের ক্যারিয়ার, অথচ কাজের পরিমাণ খুবই কম। লম্বা একটা সময় এই জগতটা থেকে দূরেই ছিলেন। প্রথমে পড়াশোনা, তারপর সংসারের ব্যস্ততা, এরপর জীবন তাকে নানা সময়ে ধাক্কা দিয়েছে, নাড়িয়ে দিয়েছে, চেয়েছে এলোমেলো করে দিতে। যাদের বিশ্বাস করেছিলেন বাঁধন, তাদের কেউ কেউ পিঠে ছুরি মেরেছে। বাঁধন মুখ বুঁজে সহ্য করেননি, চুপ থাকেননি, থেমেও যাননি। 

স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবু মেয়ের জন্য সেই লোকটার সঙ্গেই ঘর করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, হয়েছেন প্রতারিত। সেই পতিদেবতাটি তার মেয়েকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, তার নামে মিথ্যে মামলা করেছেন। হতভম্ব বাঁধন ছুটে গেছেন আদালতে, চেয়েছেন প্রতিকার। আদালত তাকে মিথ্যে মামলা থেকে রেহাই দিয়েছে, মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছে মায়ের কোলে। 

মেয়ে সায়েরার সঙ্গে বাঁধন

মেয়েকে ফিরে পেয়ে বাঁধনের কান্না বাঁধ মানেনি। নারীত্বের শক্তিতে, মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার তাড়নায় যে যুদ্ধটা তিনি শুরু করেছিলেন একদম একা, সেই যুদ্ধে সেদিন একটা বড় জয় পেয়েছিলেন তিনি। বাঁধনের যুদ্ধটা এখনও চলমান। তিনি কথা বলেন নারীর অধিকার নিয়ে, তিনি মুখ খোলেন সাইবার বুলিংয়ের নোংরামি নিয়ে। সেলিব্রেটি হয়েও তিনি নেমে আসেন রাজপথে, ধর্ষণের বিচার চেয়ে অংশ নেন মশাল মিছিলে, তিনি হয়ে ওঠেন আমজনতার অংশ। 

কাজেই রেহানা মরিয়ম নূরের ট্রেলারে বাঁধনের 'একরোখা', 'বিপ্লবী' বা 'ছকভাঙা' রূপ দেখে অনেকেই যখন চমকে ওঠেন, তখন আমার অবাক লাগে না। আমি জানি, এই নারী বুকের ভেতর ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরি পুষে রেখে বাঁচেন। ট্রেলারে দেড় মিনিটে যে তাণ্ডব তিনি দেখিয়েছেন, শিক্ষিকা হিসেবে, মা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে তার যে জার্নিটা আপনাদের মনে আলোড়ন তুলেছে, সেই জার্নিটা রিল লাইফের বাইরে রিয়েল লাইফে অনেক আগে থেকেই করে আসছেন বাঁধন। সবকিছু ভুলে গিয়ে তিনি তাই খুব অবলীলায় বলতে পারেন, 'জীবনের ৩৪টা বছর তো মানুষের জন্য বাঁচলাম, এবার একটু নিজের জন্য বাঁচি!' 

সেই নিজের জন্য বাঁচতে চাওয়া বাঁধনকে যত দেখি, তত মুগ্ধ হই। তিনি পাখির মতো ডানা মেলে ওড়েন, মেয়েকে নিয়ে নিজের দুনিয়া সাজান, ঘুরে বেড়াতে যান, ফটোসেশনে অংশ নেন, নতুন নতুন প্রোজেক্টে তার নাম যুক্ত হয়, মিউজিক ভিডিও থেকে সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ- সর্বত্র তিনি নিজের পায়ের ছাপ রেখে আসার মিশন শুরু করেন। ভাগ্য তার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। সেই ভাগ্যই বাঁধনের সামনে ফিরে আসার মঞ্চ তৈরি করে দেয়, দীপ্ত পায়ে সেই মঞ্চের ওপর ওঠে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন বাঁধন। সেই শ্রেষ্ঠত্ব কাউকে হারিয়ে দেয়ার নয়, বরং নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার। সেই শ্রেষ্ঠত্ব একজন নোবডি থেকে উঠে এসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবার। 

সেরকমই একটা মঞ্চের নাম রেহানা মরিয়ম নূর। এই সিনেমার অফার পাওয়ার আগে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের নামটাও জানতেন না বাঁধন। লাইভ ফ্রম ঢাকা দেখার পরে নিজেই আগ্রহী হয়েছেন এই টিমের সাথে কাজ করার ব্যাপারে। মেকাপ ছাড়া অডিশন দিলেন, চরিত্রের প্রয়োজনে অদ্ভুত আবদার মেনে মুখ ধুয়ে স্কার্ফ জড়ালেন মাথায়। সবকিছু খুব অদ্ভুত লাগলেও ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলেন। টানা নয় মাস রিহার্সেল করেছেন, শুটিংয়ের প্রয়োজনে কুমিল্লার এক মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে থাকলেন দুই মাস। ছোট্ট একটা আপেল কাটার দৃশ্য আছে সিনেমায়, সেটার জন্য সারাদিন ধরে ছয় কেজি আপেল কেটেছেন বাঁধন, যতক্ষণ পর্যন্ত পরিচালকের মনমতো হয়নি দৃশ্যটা, তিনি থামেননি। 

রেহানা মরিয়ম নূর সিনেমার একটি দৃশ্যে বাঁধন

সকাল সাতটায় ক্যামেরা ওপেন হতো, সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতো একটানা, প্রতিদিন। গোটা সময়টা ডিরেক্টর্স আর্টিস্ট হয়ে ছিলেন বাঁধন। সাদ তাকে বলেছিলেন, ‘এই ক্যারেক্টার যদি তুমি করতে না পারো, তাহলে আর কেউ পারবে না।’ সিনেমাটা দেখার আগেই আমিও একই রকমের আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি, বাঁধন ছাড়া অন্য কারো পক্ষে রেহানার এই স্ট্রেসফুল জার্নিটা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না, সম্ভব নয় এখনও। এই চরিত্রটা শুধু তার জন্যেই জন্ম নিয়েছে। ট্রেলারের দেড় মিনিট পর্দাজুড়ে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন; লুক, ডায়লগ ডেলিভারি, এক্সপ্রেশন- প্রতিটা জায়গায় উপহার দিয়েছেন বিস্ময়, করেছেন মুগ্ধ।

বাঁধনের এখন একাদশে বৃ্হস্পতি। 'রেহানা মরিয়ম নূর' কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অফিসিয়াল সিলেকশনে সম্মানজনক 'আঁ সার্তে রিগা' বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে, জুলাইয়ের সাত তারিখে সিনেমাটি অফিসিয়ালি প্রদর্শিত হবে সেখানে। হইচইয়ে মুক্তির অপেক্ষায় আছে এবছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত বাংলা কন্টেন্ট 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি', রহস্যময়ী মুশকান জুবেরী হিসেবে তার ওপরেই ভরসা রেখেছেন সৃজিত মুখার্জী। জানিনা সেই সিরিজটা ভালো হবে কি মন্দ, কিন্তু 'নিজের জন্য বাঁচতে চাওয়া' বাঁধনের এই অগ্রযাত্রা দেখে ভালো লাগে, হাজার প্রতিকূলতাকে পায়ে মাড়িয়ে এই নারীর মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যাওয়া দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।

জীবনের একটা পর্যায়ে মানসিক যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল বাঁধনকে। সেই মনোবিদ তাকে বলেছিলেন, রুটিরুজির জন্য অভিনয়টা যখন করতেই হবে, তখন সেটাকে ভালোবাসো। অভিনয়কে বাঁধন এতটাই ভালোবেসেছেন, সেই ভালোবাসা তাকে এনে দিচ্ছে খ্যাতি, এনে দিচ্ছে সম্মান। নিজেকে এবং অভিনয়কে ভালোবাসার এই জার্নিটা চালু থাকুক, বাঁধনের এই 'জয়যাত্রা' দীর্ঘ হোক, সমৃদ্ধ হোক, এটাই চাইবো সবসময়...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা