এ সিনেমা দেখা উচিত বিশেষ কিছু কারণে। ঢিমেতালের গল্পের মোড়কে জীবনবোধের যে সূক্ষ্ম আঘাত এ সিনেমা করবে, তা স্থুল গল্পের কোনো সিনেমাতে পাওয়া যাবে না মোটেও। তাছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয় দেখার জন্যে হলেও 'বাহাত্তর ঘন্টা' দেখা উচিত। আর যারা স্লো-বার্ন ট্রিটমেন্ট পছন্দ করেন, তাদের জন্যে তো এ সিনেমা রাজযোটক, সোহায় সোহাগা!

অতনু ঘোষের সিনেমাগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক এটাই, খুব আলগোছে কিছু না কিছু জীবনবোধ তিনি প্রবেশ করান গল্পে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বিনিসুতোয়, কিংবা রবিবার, ময়ূরাক্ষী... সব সিনেমাতেই কিছু না কিছু স্বকীয় বার্তা ছিলো। তবে এটাও সে সাথে বলে রাখা ভালো, গল্প বলার ক্ষেত্রে স্লোবার্ণ ট্রিটমেন্টেই তিনি এগোন বরাবর। ধীরস্থির স্ক্রিনপ্লে'র কারণে অনেক দর্শকই তার নির্মাণের সাথে পুরোদস্তুর সড়গড় হতে পারেন না। এ কারণে সিনেমার গল্প পছন্দ হলেও স্ক্রিনপ্লে নিয়ে বরাবরই খানিকটা চাপান-উতোর থাকে দর্শকের।

স্ক্রিনপ্লে'র সে খামতি কাটাতেই বোধহয় অতনু ঘোষ এক্সপেরিমেন্ট চালালেন 'বাহাত্তর ঘন্টা' সিনেমা দিয়ে। ছয়টি গল্প, বারো জন মানুষ, বাহাত্তর ঘন্টা সময়। গল্পগুলোর কুশীলব ভিন্ন৷ গল্পের  আবহ ভিন্ন৷ কিন্তু কোথাও গিয়ে গল্পগুলো আবার একই ঘরানার। সূক্ষ্ম জীবনবোধের ঘরানার। সে গল্প কখনো জিলিপি, কখনো বাতাসা আবার কখনো জিভে গজা৷ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার থেকে সারকাস্টিক কমেডি...সবই বহাল তবিয়তে উপস্থিত। প্রতিটি গল্পই শুরু দুজন মানুষ থেকে। যে গল্প   ক্রমশ ঘুরপাক খাবে অচেনা রাজপথে। এটাই প্যাটার্ন। সূত্র।

গল্পের শুরুতেই যেমন জানা গেলো, ট্রেনের নীচে কাটা পড়েছেন প্রখ্যাত এক কৌতুকশিল্পী। সেখান থেকেই সিনেমার শুরু। এই কৌতুকশিল্পীর প্রয়াণ কখনো পরোক্ষে, কখনো প্রত্যক্ষে থেকে একে একে জাদুকরের আস্তিন থেকে বের করলো একেকজন কুশীলবকে। ভিন্ন স্বাদের একেকটা গল্পকে। সে গল্পে কখনো এলো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। এলো সম্পর্কের ক্ষনস্থায়ী রূপান্তর থেকে দেখনদারি সময়ের অস্বস্তি। জীবন নিয়ে তামাশা-তাচ্ছিল্য আর অজ্ঞাতকুলশীল কারো কাছে জীবনের সব ঝাঁপি খুলে ফেলা...সবই এলো ক্রমে ক্রমে। 

'বাহাত্তর ঘন্টা'র কুশীলব তালিকাও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। অভিনেতাদের মধ্যে প্রথমেই এলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গুণী এই অভিনেতার প্রয়াণের পরে এটিই সম্ভবত মুক্তি পাওয়া তার প্রথম সিনেমা৷ সব ভুলে যাওয়া এক দিশেহারা বৃদ্ধের চরিত্রে কী অভিনয়টাই না করলেন! মুগ্ধ করলেন। ক্রমশ এলো অনেকেই। পরাণ, খরাজ, ইন্দ্রানী, অনন্যা, আবীর, ঋত্বিক, সুদীপ্তা...সবাই-ই দক্ষ শিল্পী। অভিনয়েও তাই সবাই যার যার অবস্থান থেকে ছিমছাম শৈলীই দেখালেন। 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় ছড়িয়েছে মুগ্ধতা! 

তবে আক্ষেপ খানিকটা রয়ে গেলো গল্পেই। যেহেতু গল্প ছয়টি, সেহেতু কোনো গল্পই যে দীর্ঘস্থায়ী কোনো আবহ তৈরী করবে না হৃদয়ে, তা একরকম নিশ্চিতই ছিলো৷ কিন্তু তবুও, চাইলেই চরিত্রগুলোর মধ্যবর্তী মিথস্ক্রিয়া আরেকটু গাঢ় হতে পারতো। প্রথম গল্প এবং শেষ গল্পে দুই চরিত্রের মধ্যে যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের চমৎকারিত্ব, সেটি বাকি গল্পগুলোতে কেন যেন সেভাবে পেলাম না। আর পৌনে দুই ঘন্টার সিনেমায় এতগুলো গল্প, এতগুলো চরিত্র, এতগুলো ভিন্ন স্বাদ এনে সবকিছুকে জটিল করা কেন, সেটারও ঠিক কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। চাইলেই গল্প কমিয়ে, সে গল্পগুলোকে সিনেমার মূল যে থিম, তার সাথে খুব নিবিড়ভাবে যুক্ত করা যেতে পারতো। তাহলে দর্শকও হয়তো বেশ আত্মিক এক টান অনুভব করতো কুশীলবদের প্রতি। যা এখানে হয়নি মোটেও। 

কিন্তু তবুও এ সিনেমা দেখা উচিত। ঢিমেতালে গল্পের মোড়কে জীবনবোধের যে সূক্ষ্ম আঘাত এ সিনেমা করবে, তা স্থুল গল্পের কোনো সিনেমাতে পাওয়া যাবে না মোটেও। তাছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয় দেখার জন্যে হলেও 'বাহাত্তর ঘন্টা' দেখা উচিত। আর যারা স্লোবার্ণ ট্রিটমেন্ট পছন্দ করেন, তাদের জন্যে তো এ সিনেমা রাজযোটক, সোহায় সোহাগা! 

সূক্ষ্ম জীবনবোধের বার্তা দেবে এ সিনেমা! 

তবে আশা থাকবে এটাই, নির্মাতা অতনু ঘোষ পরবর্তী নির্মাণে ত্রুটির এ বিষয়গুলোতে সতর্ক হবেন। তাহলেই নির্মাণ আরেকটু উপভোগ্য হবে সবার জন্যে। এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে বলি, বাংলাদেশের 'চরকি' স্ট্রিমিং সাইটে কলকাতার এই সিনেমার প্রিমিয়ার হওয়াতে বেশ তৃপ্তি পেয়েছি। ওপার বাংলার এত এত কুশীলব-সমৃদ্ধ এক নির্মাণ এবং সৌমিত্রের অনবদ্য অভিনয়ের সাথে যে এদেশীয় এক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে, তা দেখতে পারাটাও আনন্দের৷ সংস্কৃতির কাঁটাতার ভেঙ্গে এভাবেই নিয়মিত মিলিত হবে এদেশ-ওদেশ, সেটাই এখন চাওয়া। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা