ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে দাপুটে এক বাংলাদেশ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বহু বছর পরে 'কান ফিল্ম ফেস্টিভাল' এ মনোনয়ন পেয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা! পাশাপাশি মুক্তির অপেক্ষায় আছে এমনকিছু নির্মাণ, যেগুলো মুক্তির পরে তুমুল আলোড়ন তুলবে, নির্দ্বিধায় বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা এমন কিছু নির্মাতা এসেছেন প্রেক্ষাপটে, যারা মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে জানেন। এবং যারা মস্তিষ্ক ব্যবহার করেনও...
অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিখ্যাত উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম' অবলম্বনে বাংলাদেশে এসে একটি সিনেমা বানাবেন পশ্চিমবাংলার প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক। যথারীতি তিনি ভারত থেকে বাংলাদেশে এলেন। ছবি বানানো শুরু করলেন। ছবি বানানোর সে অভিজ্ঞতায় তিনি বললেন-
বাংলাদেশের এত দৈন্যদশা আশা করিনি। সিনেমা বানানোর একটা ভালো যন্ত্রপাতিও যদি থাকতো ওদের! প্রায় সবগুলোই ধারদেনা করে এনেছে। নিজেদের যা দুয়েকটা হেঁদিয়ে যাওয়া কলকব্জা আছে, তাও ব্যবহার না করতে করতে ঝুরঝুরে-অচল হয়ে গিয়েছে।
সত্যি তো এটাই, দেশভাগে বহু মানুষের বিভিন্ন-বিচিত্র ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতেও। দেশভাগের ফলে সিনেমার পরিচালকেরা রয়ে গিয়েছেন ওপার বাংলায়। এপার বাংলায় রয়ে গিয়েছে শুধু সিনেমাহল। ওপার বাংলায় প্রেক্ষাগৃহ নেই। এপার বাংলায় নেই পরিচালক। তবে সেখানে সত্যজিৎ-মৃণাল-তপন ত্রয়ী হয়ে হাল ধরেছেন, এনেছেন পরিবর্তন৷ কিন্তু বাংলাদেশে? এখানে যে একেবারেই কোনো কাজ হয়নি, তা না৷ গুটিকয়েক কাজ হয়েছে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যে এই অপ্রতুল কাজ কতটুকুই বা যথেষ্ট? এক জহির রায়হানে ভরসা ছিলো সবার। তিনি হয়তো পাল্টাতে পারতেনও সব। কিন্তু যুদ্ধ তাকেও থামিয়ে দিয়েছে চিরতরে। ফলাফল, অসীম ঘুটঘুটে আঁধার।
এরপর সময়ে-অসময়ে এদেশের সংস্কৃতি-অঙ্গনে ছিটেফোঁটা কিছু ভালো অথবা মন্দের ভালো কাজ হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ শোরগোল উঠেছে৷ আবার ক'দিনের ব্যবধানে সে শোরগোল থেমেও গিয়েছে। আমরা আশাবাদী হতে হতেও কেন যেন হতে পারিনি শেষমেশ। মন্দ কাজের তুলনায় ভালো কাজের পরিসংখ্যান এতটাই হতদরিদ্র, চাইলেও প্রত্যাশার চরম পরাকাষ্ঠা দেখানো সম্ভব হয়নি। অদ্ভুত এক প্রহসনেই কেটেছে সময়।
কিন্তু চার্লি চ্যাপলিন যেমন বলতেন, কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এমনকি, দুঃখকষ্টও। সে বেদবাক্য মেনে বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান যদি খেয়াল করি, এদেশের শিল্পজগতেও খুব আস্তে আস্তে কিছু পরিবর্তন এসেছে। একটা বড়সময় ধরেই যেখানে সিনেমা বলতে ছিলো, কর্মাশিয়াল সস্তা স্ক্রিপ্টের পঁচা-গলা শবদেহ, সেখানে দুর্দান্ত কিছু নির্মাণ এসেছে। বহু বছর পরে 'কান ফিল্ম ফেস্টিভাল' এ মনোনয়ন পেয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা! মুক্তির অপেক্ষায় আছে এমনকিছু নির্মাণ, যেগুলো মুক্তির পরে তুমুল আলোড়ন তুলবে, নির্দ্বিধায় বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা এমন কিছু নির্মাতা এসেছেন প্রেক্ষাপটে, যারা মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে জানেন। এবং যারা মস্তিষ্ক ব্যবহার করেনও।

অসাধ্যসাধন হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্ষেত্রে৷ ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম 'হইচই' বা 'জিফাইভ' এ বাংলাদেশের কন্টেন্টগুলো তুমুল সাড়া ফেলছে। সাম্প্রতিক মহানগর, ক'দিন আগের তাকদীর, বা, আরেকটু পিছিয়ে গেলে কন্ট্রাক্ট, মানি হানি অথবা একাত্তর... কন্টেন্টগুলো শুধু যে শিল্পের নন্দনতত্ত্বেই উতরে যাচ্ছে, তা না, সমাজের যাপিত ক্ষত নিয়েও কথা বলছে নির্মানগুলো। ঋত্বিক ঘটক যেমন বলতেন- তিনি সিনেমার মধ্য দিয়ে সমাজকে পাল্টাতে চান। সে বিষয়টিই ঘটছে সাম্প্রতিক নির্মানগুলোর বেলায়। কাজগুলো এতটাই সরব, শক্তিশালী ও অসাধারণ.. বাংলাভাষী বিভিন্ন দেশের মানুষজন অকুন্ঠ সমর্থন দিচ্ছে তাদের, ভূয়সী প্রশংসা করছে। বাংলাদেশি শিল্পসংস্কৃতির এহেন সমাদর ঠিক কতটা তৃপ্তির, তা বলে বোঝানো খুব কঠিন এক বিষয়।

এবং ভালো কাজের খুব সুস্থ এক প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করি এখানে৷ 'জিফাইভ'এ কয়দিন পরে আসবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকি'র 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন', চরকি'তে আসবে 'ঊনলৌকিক।' অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সিনেমা 'রিকশা গার্ল' এরইমধ্যে টক্কর দেয়া শুরু করেছে বিদেশি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে। যে নির্মানগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর গল্প এবং কুশীলব তালিকা যদি কেউ একটু লক্ষ্য করেন, বুঝতে পারবেন, কতটা শক্তিশালী হয়ে প্রস্তুত হচ্ছে একেকটি নির্মাণ। রূপকথায় সবাই-ই পড়েছি, জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় মৃত্যুপুরীও জেগে ওঠে। এদেশও যেন সেরকম এক জিয়নকাঠি পেয়েছে, যে জিয়নকাঠি দুর্দান্ত সব নির্মাণে জ্যান্ত করে যাচ্ছে আমাদের বহু পুরোনো এক প্রত্যাশাকে।

শুরু করেছিলাম, দেশভাগ আর আমাদের শিল্পসংস্কৃতির মরে যাওয়ার আখ্যান দিয়ে। শুরুর সেই ধাক্কা আমরা সামলে উঠেছি... এরকম উত্তুঙ্গ আস্ফালনের সময় এখনো আসেনি। তবে যে নবজাগরণ দেখছি, ঘুরে দাঁড়ানোর যে আপ্রাণ তাগিদ দেখছি সবার মাঝে, তা প্রচণ্ড আশাবাদী করার মতনই বিষয়। কিন্তু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও তো চমকায়। তাই, অস্বস্তির এক শঙ্কাও বিঁধে থাকে শিরদাঁড়ায়। আশা রাখি, নির্মাতারা তাদের পা মাটিতে রাখবেন। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে সরব কন্ঠস্বর তোলার যে সংস্কৃতির প্রচলন তারা করেছেন, তা বজায় রাখার সৎসাহসও দেখাবেন নিয়মিত। সমাজের দৃষ্টিকটু আগাছাকে উচ্ছেদ করার যে জোয়ার উঠেছে, সে জোয়ারে পরিচালক-কুশীলবেরা মোটেও একা নন, দর্শকদের তুমুল সমর্থনই পাচ্ছেন তারা। আমরা আশাবাদী, গনমানুষের অকুন্ঠ সমর্থনের যোগ্য সম্মান তারা দেবেন। তারা বলবেন। বলাবেন। দেখবেন। দেখাবেন। শুনবেন। শোনাবেন। জাগবেন এবং অতি অবশ্যই, জাগাবেন।
আমরা নিরন্তর আশাবাদী৷