
সিনেমার শেষ প্রান্তে এসে অজয়ের মুখে শুনলাম- "আমরা একটি নতুন দেশের জন্ম দিলাম, বাংলাদেশ।" ভারত কীভাবে জন্ম দিলো বাংলাদেশের? ‘জন্ম দিলাম’ মানে কি? আপনাদের ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে? আপনারা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে নয় মাস যুদ্ধ করেছেন? ৪৭ থেকে আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের শিকার হয়েছেন?
বলিউডের ওয়্যার ড্রামা নিয়ে আমাদের দেশের দর্শকদের কমন অভিযোগ- ধুর, আবার সেই কাশ্মীর, ভারত-পাকিস্তান মারামারি; ভারতের পাকিস্তানকে প্যাদানো এসবই। এই জেনারালাইজড অভিযোগে আমরা ভালো সিনেমা, খারাপ সিনেমাও মিলিয়ে ফেলে অনায়াসেই।
রিসেন্টলি এই লাইনগুলোর আবার দেখা পেলাম কারণ আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পরপর বেশ কিছু বড় সিনেমা রিলিজ পেয়েছে বলিউডে। শেরশাহ্ রিলিজ পেলো প্রথমে, তারপর ভূজ এরপর বেল বটম। শের শাহ্ বেশ ভালো সিনেমা, ভূজ সেখানে হয়েছে রাবিশ। একটা দেশ স্বাভাবিকভাবেই তাদের ইতিহাস নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করবে, এভাবেই তাদের ইতিহাস জানবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কিন্তু সেই ইতিহাস জানাতে গিয়ে যদি ইতিহাসকে বিকৃত করে, প্রতিপক্ষ দেশ বা বাহিনী ছাড়া অন্য দেশকে অপমান করে তাহলে কাজটা খুবই দৃষ্টিকটু।
এই কাজটা বলিউডের সিনেমা বলতে গেলে উঠতে বসতে করছে এখন। ভারত-পাকিস্তানের লড়াইয়ে বাংলাদেশ উঠে আসছে বারবার। আর সেখানে বাংলাদেশকে দেখানো হচ্ছে চরম অপমানজনকভাবে। সম্প্রতি ভূজ সিনেমায় তো তাই হয়েছে। ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে জন্ম দিয়েছে।
ভূজও আসলে দর্শকদের সেই অভিযোগের মধ্যে কমন পড়ে যায়। সেই একই ভারত-পাকিস্তান গল্প, ভারতের একপাক্ষিক জয়ের গল্প। ভূজের গল্পটা সত্য ছিল। কিন্তু সত্য হলেও শেরশাহ্ যেখানে সফল সেখানে চরমভাবে ব্যর্থ ভূজ। ভূজের রিভিউ করতে আসি নি তাই ঐ প্রেক্ষাপটে যাব না। অসম্ভব বাজে এই সিনেমা সুপারস্টার অজয় দেবগন, সঞ্জয় দত্তের মতো তারকারা কীভাবে করলেন সে কথাতেও যাব না।
কথা বলবো রাইটিং নিয়ে। এতো বড় ক্যানভাসের সিনেমার গল্প লিখতে গিয়ে, ডায়লগ লিখতে গিয়ে রাইটাররা ন্যূনতম কোন রিসার্চ করলেন না সেটাই অবাক করার মতো। আর তাদের লেখা সে ডায়লগও অজয় গড়গড় করে বলে গেলেন তোতাপাখির মতো। প্রচুর ঐতিহাসিক ভুল তো আছেই। বাংলাদেশকে ডিমিন করা তো আছেই। ৭১ এর যুদ্ধ পুরোটাই নিজেদের করে নেয়া তো আছেই। কিন্তু যখনই আপনি এই ডায়লগ দিয়ে ফেলবেন, তখন চাইলেও মাথা ঠাণ্ডা রাখার উপায় থাকে না।
ভূজ সিনেমায় নোরার অভিনয়, সোনাক্ষীর কাস্তে দিয়ে বাঘ মেরে ফেলা, অজয়ের ট্রাক দিয়ে প্লেন ল্যান্ড করানো সহ্য করে শেষপ্রান্তে এসে অজয়ের মুখে শুনলাম-
"আমরা একটি নতুন দেশের জন্ম দিলাম, বাংলাদেশ।"

ভারত কীভাবে জন্ম দিলো বাংলাদেশ? ‘জন্ম দিলাম’ মানে কি? আপনাদের ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে? আপনারা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে নয় মাস যুদ্ধ করেছেন? ৪৭ থেকে আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের শিকার হয়েছেন? আমি জানি না এর চেয়ে অসম্মানজনক কিছু কেউ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বলেছে কীনা! তবে প্রায়শই বলিউড ইতিহাসের ঐ পাতা উল্টাতে গিয়ে ৭১’কে তাদের অর্জন বলে দাবি করে এসেছে। দাবি করতেই পারে, অবশ্যই ঐ যুদ্ধে তাদের অর্জন আছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধও হয়েছে। কিন্তু সেটাকেই কেবল সত্য ধরে, সেটাকেই স্ট্যাবলিশ করে পুরো যুদ্ধ জয়ের ক্রেডিট নিজেদের করে নিয়ে ‘জন্ম দিয়েছি’র মতো ঔদ্ধত্য দেখানোর অধিকার তাদের নেই।
অবশ্য এতে দায় আমাদেরও অনেক। আমি বলবো আমাদেরই বেশি। আমাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা আইএমডিবিতে সিনেমার রেটিং কমিয়ে দেয়া। এর চেয়ে বেশি কিছু আমরা করতে পারি না। অথচ, ইতিহাসকে, ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী অর্জনগুলোকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় তাকে জীবনযাপনের অনুষঙ্গগুলোর সাথে মিশিয়ে ফেলা। মিশিয়ে ফেলা বিনোদনের মাধ্যমগুলোতেও। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান এসবের মাঝে ইতিহাসকে ধরতে হবে, ইতিহাসকে ধারণ করতে হবে সিনেমা-সিরিজেও। অথচ আমাদের সেই প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে। যতটুকু প্রচেষ্টা হয় তা হয় ব্যক্তিকে খুশি করতে, রাষ্ট্রকে খুশি করতে। ইতিহাস খুশি হয় না, আফসোস!
আজও আমাদের বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক মানের কোন সিনেমা-সিরিজ বানাতে পারি নি। বীরশ্রেষ্ঠদের আগে যাকে নিয়ে কাজ হবার কথা সে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজও মাত্র শুরু হল, তাও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। আমাদের নির্মাতারা কি ইতিহাসের গল্প বলতে চান না? নাকি বলতে গেলে তাদের গলা টিপে ধরা হয়? কেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে একটা সিনেমা হল না? কেন ছয় দফার পুরো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ৬ পর্বের এক মিনিসিরিজ ভাবতে পারলো না কেউ? কেন নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা নিয়ে একটা পলিটিক্যাল থ্রিলারের স্ক্রিপ্ট আজ অব্দি লেখা হয় নি?
আমাদেরও তো বিক্রম বাত্রা আছেন, আমাদেরও ভূজের মতো গল্প ঢের। তাও আমাদের স্বাধীনতা দিবসে বিনোদন মাধ্যম নিশ্চুপ থাকে কেন? কিছু নাটক, ব্যক্তিপূজা আর মুখে জাতির পিতার নাম জপ করে শেষ হয়ে যায় আমাদের এই বিশেষ দিবসগুলো। আমাদের সামরিক বাহিনীর গল্পও উঠে আসে না, আসে না তাদের দেশপ্রেমের গাঁথা। শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের চ্যালেঞ্জ, স্ট্রাগল, স্যাক্রিফাইস নিয়েও তো কতো গল্প আছে! আঠারো কোটি মানুষের দেশ আমরা। আমরা যদি লিখে না যাই, বলে না যাই, না দেখাই তাহলে ইতিহাস তো আমাদের ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করবেনা আমাদের দেশও।