'দিলওয়ালে' সিনেমা ফ্লপ হলো, একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিলেন শাহরুখ খান-রোহিত শেঠি। একই কথা প্রযোজ্য, মহেঞ্জোদারো সিনেমার ক্ষেত্রেও। ঋত্বিক-আশুতোষ নামলেন সম্মুখ বিতর্কে। এবং এই বিতর্কের মাঝখানেই প্রশ্ন উঠলো- কোনো একটি সিনেমা যদি ফ্লপ হয়, তাহলে সে দোষ মূলত কার? নির্মাতার? অভিনেতার? প্রযোজকের? হল-মালিকদের? নাকি, দর্শকদের?
আশুতোষ গোয়ারিকর ম্যাগনাম ওপাস পিরিয়ড ফিল্ম 'মহেঞ্জোদারো' বানালেন। সিনেমা বানাতে দেড় বিলিয়ন রূপি খরচ করলেন৷ দুই বছর সময় নিয়ে যত্ন করে তিলে তিলে নির্মিত হলো সিনেমা।বানানো শেষে সিনেমার জোরদার মার্কেটিংও করলেন তিনি। কিন্তু এতসব প্রচেষ্টা সত্বেও এ সিনেমা বক্স-অফিসে খুব একটা ভালো ব্যবসা করলোনা। এরইমধ্যে হলো আরেক কাণ্ড। সিনেমার ভরাডুবি দেখে 'মহেঞ্জোদারো'র প্রোটাগনিস্ট ঋত্বিক রোশন রেগেমেগে ডিরেক্টর আশুতোষ গোয়ারিকরকে কিছু উত্তপ্ত বার্তা লিখে পাঠালেন। আশুতোষ গোয়ারিকরও চুপ রইলেন না। দুই পক্ষেই শুরু হলো বাদানুবাদ। এবং এ বাদানুবাদে বেশ কিছুদিন সরব রইলো মিডিয়া।
'দিলওয়ালে' সিনেমা নিয়ে শাহরুখ খান এবং রোহিত শেঠি... দুইজনেরই ছিলো বিস্তর প্রত্যাশা। এই জুটির আগের সিনেমা 'চেন্নাই এক্সপ্রেস' হিট হয়েছে। আশা ছিলো, এবারের সিনেমাও বক্স-অফিস কাঁপাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি দিয়ে সিনেমাটা খানিক মুখ থুবড়েই পড়লো। রোহিত শেঠি সিনেমার এ ব্যর্থতার দায় দিলেন শাহরুখ খানকে। তার বক্তব্য- সঞ্জয় লীলা বানসালির 'বাজিরাও মাস্তানি'র সাথে একইসময়ে এই সিনেমা মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শাহরুখ খান, যা ঠিক হয়নি। ওদিকে শাহরুখ খান পাল্টা বক্তব্য দিলেন- রোহিত শেঠি নাকি এই সিনেমা ভালো করে বানাতেই পারেননি! শুরু হলো বিতর্ক। দুজনের এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে জলঘোলাও হলো বিস্তর।
কোনো একটা সিনেমা আশানুরূপ ব্যবসা করতে না পারলে সিনেমার বিভিন্ন পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যাওয়ার এ নজির নতুন না মোটেও। বলিউড হোক কিংবা হলিউড, অথবা, অন্য কোনো ইন্ডাস্ট্রি... একে অন্যকে দায়ী করাটা বেশ পরিচিত এক স্ট্রাটেজিই। 'ব্লেম গেম' এর মাধ্যমে নিজের বার্ডেন অন্যের ঘাড়ে শিফট করার এই সংস্কৃতি বেশ পুরোনোও। যদিও 'সিনেমা' পুরোটাই টিমওয়ার্ক, সিনেমা হিট হলে সবাই মিলেই ভাগাভাগি করে নেয় সাফল্য। কিন্তু বিস্ময় এটাই, দোষ চাপানোর বেলাতেই কেন যেন একে অন্যের সাথেই সম্মুখ সমরে লিপ্ত হতে চায় সবাই। এবং এ সমরের মাঝখানেই আচমকাই জীবিত হয় কিছু প্রশ্ন। যে প্রশ্নের সারাংশ- কোনো একটি সিনেমা যদি ফ্লপ হয়, তাহলে সে দোষ মূলত কার? নির্মাতার? অভিনেতার? প্রযোজকের? হল-মালিকদের? নাকি, দর্শকদের?
বলিউডের মাস্টার ফিল্মমেকার অনুরাগ কাশ্যপের মতে-
সিনেমা হিট হলে তার সিংহভাগ ক্রেডিট যদি নির্মাতা পায়, তাহলে সিনেমা ফ্লপ হলে সে বার্ডেনও তার নেয়া উচিত। কারণ, সিনেমাটা ভালো হবে কী খারাপ, সেটা একেবারে শুরুতেই যেহেতু বুঝতে পারেন নির্মাতা, সেহেতু, তার 'হ্যাঁ অথবা না'ই মূলত গড়ে দিতে পারে মূল পার্থক্য। যেহেতু সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মত প্রিভেলজড এক পজিশনেই থাকেন তিনি, সেহেতু সিনেমা ফ্লপের সিংহভাগ দায় নির্মাতার উপরেই পড়াটা প্রাসঙ্গিক। পড়া উচিতও।
অনুরাগ কাশ্যপের সাথে একমত অনেকেই। অনেক অভিনয়শিল্পীরই দাবী, গল্পের সিনোপসিস পড়ে, স্ক্রিপ্টে তাদের অভিনয়ের সুযোগ দেখে এরপর তারা অভিনয়ে আসেন। এবার নির্মাতা যদি গল্পের এক্সিকিউশন ঠিকঠাক করতে না পারেন, এবং সেজন্যে যদি সিনেমা ফ্লপ হয়, তাহলে সেখানে পুরো দোষ নির্মাতারই হওয়া উচিত৷ অভিনেতাদের না। অভিনয়শিল্পীদের এ দাবী যে একেবারে অমূলক, এমনও না। এরকমটা আশেপাশে মাঝেমধ্যেই দেখি, যেখানে অভিনয়শিল্পীরা দারুণ করার পরেও শুধুমাত্র গল্পের বিতিকিচ্ছিরি রূপান্তরের কারণে নির্মান ব্যর্থ হয়েছে বহুবার। এবং এসব ক্ষেত্রে দায়ভার পুরোপুরিই যে নির্মাতার উপর বর্তায়, তাতেও থাকেনা কোনো সন্দেহ।
নমস্য সত্যজিৎ রায় বলতেন-
সিনেমার সাফল্য/ব্যর্থতায় পরিচালকের ভূমিকাই মূখ্য। তাকে প্রথমেই বুঝতে হয় সিনেমার ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ বুঝে নির্বাচন করতে হয় সবকিছু। শুটিংসেট, কুশীলব, স্ক্রিপ্ট... সবকিছুকে আনতে হয় সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের আওতায়। হ্যাঁ, এটা ঠিক, সিনেমায় অনেকগুলো ইউনিট কাজ করে একত্রে। কিন্তু প্রতিটি ইউনিটকে নেতৃত্ব দেয়া এবং দিনশেষে প্রতিটি ইউনিটের কাজের শেষকথা কিন্তু নির্মাতাই বলেন। সুতরাং নির্মাতার দায়ই সবচেয়ে বড়।
তবে অনেক সময় এমনও হয়, সিনেমা ভালো হওয়া সত্বেও, সবার অভিনয় ভালো হওয়া সত্বেও, নির্মাতার গল্পবয়ান দারুণ হওয়া সত্বেও সিনেমা ভালো ব্যবসা করতে পারে না। ব্যবসা কেন করতে পারে না, সেটা বুঝতে হলে, সিনেমার ক্রিয়েটিভিটির বদলে তাকাতে হবে সিনেমার ইকোনমিকসের দিকে। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। কঙ্কনা সেনশর্মার ডিরেকশনে খুব বিখ্যাত এক সিনেমা 'আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ।' এ সিনেমা যখন প্রথমবার দেখি, সিনেমার গল্প, অভিনয় আর এক্সিকিউশনে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। কিন্তু পরে যখন একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, খুব অবাক হয়েই লক্ষ্য করলাম- এ সিনেমা বক্স অফিসে খুব একটা ব্যবসা করেনি। এর পেছনের প্রধানতম কারণ- মাত্র একশোটি স্ক্রিনে চলেছিলো এই সিনেমা! এবং 'মার্কেটিং ও প্রমোশন' এর জন্যেও সিনেমাটির ছিলোনা বিশেষ কোনো বাজেট। ফলে অধিকাংশ মানুষই সিনেমা সম্পর্কে জানেনি, হল মালিকেরাও এরকম এক সিনেমা নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি। ফলে, সিনেমাও শেষপর্যন্ত বক্স অফিসের বৈতরণী পার হতে পারেনি।
'আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ' এর এই উদাহরণ দেখে একটা বিষয় কিন্তু খুব স্পষ্ট, যে বিষয়ের মূলকথা- সিনেমা বানানোর চেয়েও সিনেমার মার্কেটিং খুব বেশি জরুরি। খুব বেশি দূরে না, যদি সাউথের এস এস রাজামৌলির সিনেমা-পরবর্তী কাজগুলো কেউ লক্ষ্য করেন, দেখবেন, সিনেমার প্রমোশনে কতটা অ্যাগ্রেসিভলি কাজ করেন তিনি। তার বানানো সিনেমাগুলো এমনিতেই অনবদ্য। কিন্তু তবুও সিনেমার প্রমোশনে লেশমাত্র ছাড়ও দিতে চাননা তিনি। দেনওনা। একই কথা প্রযোজ্য 'কেজিএফ' এর ক্ষেত্রেও। এখন 'কেজিএফ' ফ্রাঞ্চাইজির আলাদা সুনাম। কিন্তু যখন প্রথমবার প্রশান্ত নীল এই সিনেমার প্রথম খণ্ড বানালেন, তখন তিনি ছিলেন পুরোপুরিই আন্ডাররেটেড একজন ফিল্মমেকার। তবুও রাজামৌলিকে উদাহরণ মেনে তিনি করেছেন তুখোড় প্রমোশন। তৃণমূল পর্যায় থেকে টপ মোস্ট লেভেল... নিজের সিনেমা নিয়ে করেছেন বিস্তর খ্যাপাটেপনা। যার ফলশ্রুতিতেই, কেজিএফ পৌঁছেছে আজকের এই পর্যায়ে।
অর্থাৎ প্রমাণিত এটাই, সিনেমার প্রচার ও প্রসারে প্রমোশনাল ও মার্কেটিং স্ট্রাটেজিও রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে এক্ষেত্রে মাথায় রাখা দরকার, সিনেমার মধ্যে যদি 'এক্স ফ্যাক্টর' না থাকে, দর্শককে বুঁদ করার মত যদি উপাদান না থাকে, তাহলে সে সিনেমা তুমুল মার্কেটিং করেও কিন্তু খুব একটা ফায়দা করতে পারেনা। অর্থাৎ, মূলকথা এটাই, সিনেমার ক্রাফটিং হতে হবে দারুণ। সিনেমার প্রচারণা হতে হবে আরো দারুণ। বেশিসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে যাতে সিনেমাটা যায়, নিশ্চিত করতে হবে সে ব্যবস্থা। দর্শককে হলে টানার জন্যে বানাতে হবে জোরদার স্ট্রাটেজিও। এবং এসবের সাপেক্ষেই মূলত সিনেমা একটা পর্যায়ে যাবে।
সুতরাং, মোদ্দাকথা এটাই, ঢালাওভাবে কোনো একজনের দোষে সিনেমা মোটেও ব্যর্থ হয়না। বরং, সিনেমার শুরু থেকে বিপণন পর্যন্ত নানা ধাপের বহু কুশীলবের নানাবিধ আচরণের মিলিত প্রক্রিয়ার ফলাফলেই মূলত নির্ধারিত হয় সিনেমার ভাগ্য৷ একজন নির্মাতা যদি ভালো সিনেমা বানিয়েই বসে থাকেন, একজন প্রোডিউসার যদি শুধু 'পপুলার ফেস'কেই দিতে চান প্রাধান্য, একজন হল-মালিক যদি 'হিট জুটি'র সিনেমাকেই দিতে চান স্লট, আর একজন দর্শক যদি শুধুমাত্র হাইপের বশীভূত হয়েই ছুটে যান সিনেমাহলে, মূলত এসব আচরণই দিনশেষে স্পষ্ট হয় পার্থক্য। এসবই নির্ধারণ করে কোনো একটি সিনেমার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা। একসাথে সবগুলো চলকই এখানে রাখে উল্লেখযোগ্য অবদান।