
ওয়েস্টার্ন জনরাকে রিজিওনাল লেভেলে পিচ করার 'বলি'র এই আইডিয়াটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। পেঁজা তুলোর মেঘ, অলস সমুদ্রতট, সেখান দিয়ে ছুটে যাওয়া তেজী ঘোড়ার খুরের গর্জন কিংবা পিস্তল হাতে মুখোমুখি ডুয়েল লড়াই- এসব টুকরো টুকরো দৃশ্যে আমরা যারা ছোটবেলায় লুকিয়ে ওয়েস্টার্ন সিরিজ পড়েছি, তারা যে খানিকটা হলেও নস্টালজিক হবো, তা তো একরকম নিশ্চিতই ছিলো। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এটাই, এই নির্মাণ ওয়েস্টার্ন থ্রিলারকে ক্ষণেক্ষণে মনে করালেও এখানের কোনো উপাদানই ঠিক আরোপিত না। বরং স্বকীয় আবহে উজ্জ্বল...
এইটা ছেঁড়াদিয়া, এখানে হিম্মত ভাঁজ কইরা আলমারির ভিতরে গুছাইয়া রাখতে হয়...
স্ট্রিমিং সাইট হইচই এর জন্যে নির্মিত শঙখ দাশগুপ্তের ওয়েব সিরিজ 'বলি'কে একবাক্যে প্রকাশ করতে চাইলে, উপরের লাইনটির চেয়ে যথার্থ কোনো শব্দগুচ্ছ আর আছে কী না, তা নিয়ে বিস্তর বচসা হতেই পারে। যদিও ওয়েব সিরিজের গল্প কোনদিকে কিভাবে ঘুরবে, তা জানা নেই কারোরই। তবে 'বলি'র টিজার এবং ট্রেলারে যেরকম গল্পের আঁচ পাওয়া গেলো, তাতে রগরগে ওয়েস্টার্ন থ্রিলারের ভয়াল এক আবহই পেলাম। ক্ষণেক্ষণে চমকে উঠলাম। বাংলাদেশের কোনো নির্মাতার এরকম কাজ দেখে অনেকটা গর্ববোধও হলো।
ছেঁড়াদিয়া নামের এক দ্বীপকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া এই গল্পে ছেঁড়াদিয়াকে যে কালার টোনে ন্যারেট করা হলো, তা দুর্দান্ত। ছেঁড়াদিয়া দ্বীপের একটাই পরিচয়- এই দ্বীপ নৃশংস। বীভৎসতাই এখানের আইন। এখানে যে সর্বশ্রেষ্ঠ পিশাচ, শুধু সে-ই টিকে থাকবে এ ভূখণ্ডে। এটাই আইন। এটাই নিয়তি। এরকমই এক থমথমে ভূখণ্ডে শুরু হয় 'বলি'র গল্প। দুই মাফিয়ার লড়াই দিয়ে শুরু হওয়া শোণিত উপাখ্যানে গর্জে ওঠে রাইফেল, পদতলে চমকায় বুলেটের খোসা। সোহরাব কোম্পানি এবং মজিদ কোম্পানির দ্বৈরথ দিয়ে শুরু হওয়া জিঘাংসার উপাখ্যানে ক্রমশ যুক্ত হয় আরো কিছু চরিত্র। সোহরাবের সাঙ্গোপাঙ্গ, রুস্তম, বেশ্যাপল্লীর নারী, অজ্ঞাতকুলশীল তরুণী...সবাই মিলেমিশে ধীরে ধীরে প্রকট করে এমন এক ছেঁড়াদিয়াকে, যে ছেঁড়াদিয়ার সাথে অনুরাগ কাশ্যপের 'গ্যাংস অব ওয়াসিপুর' এর হিংস্রতার আছে তীব্র মিল।
'বলি'তে 'তাকদীর' এর জনপ্রিয় জুটি চঞ্চল- সোহেল'কে আবার ফিরতে দেখাটা বেশ দারুণ এক বিষয়। যদিও এবার তারা মুখোমুখি। বর্বরতার সম্মুখ সমরে একজন আরেকজনকে কতটুকু আক্রমণ করবে, সেদিকে তাই আলাদা নজরই থাকবে। পাশাপাশি সালাউদ্দিন লাভলু, ইরেশ যাকের, নাসিরউদ্দিন খান, জিয়াউল হক পলাশ, সোহানা সাবা, সাফা কবিরের সপ্রতিভ উপস্থিতিও নজর ফেরাতে বাধ্য করেছে তাদের দিকে। এরা সবাই সাম্প্রতিক সময়ে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। এরকম মোমেন্টামে 'বলি'তে তারা যে হাততালি পাওয়ার মতনই পারফর্ম করবেন, সেটা আশা করাই তাই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি তানজীর তুহিনের টাইটেল ট্রাকটাও বেশ দারুণ। সিনেম্যাটোগ্রাফী, বিজিএম তো রইলোই।

তবে, এসবকে ছাপিয়ে, ওয়েস্টার্ন জনরাকে রিজিওনাল লেভেলে পিচ করার 'বলি'র এই আইডিয়াটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। পেঁজা তুলোর মেঘ, সমুদ্রতট, সেখান দিয়ে ছুটে যাওয়া তেজী ঘোড়ার খুরের গর্জন কিংবা পিস্তল হাতে মুখোমুখি ডুয়েল লড়াই... এসব টুকরো টুকরো দৃশ্যে আমরা যারা ছোটবেলায় অঙ্ক বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে ওয়েস্টার্ন সিরিজ পড়েছি, তারা যে খানিকটা হলেও নস্টালজিক হবো, তা তো একরকম নিশ্চিতই ছিলো। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এটাই, এই নির্মাণ ওয়েস্টার্নকে মনে করালেও এখানের কোনোকিছুই ঠিক আরোপিত লাগছে না। বরং সব উপাদানই আশ্চর্য সাবলীলতায় অবস্থান করছে পাশাপাশি। এখানের কুশীলবেরা ক্ষণেক্ষণে ওয়েস্টার্ন সিরিজের চরিত্রগুলোকে মনে করাচ্ছে, কিন্তু তারা মোটেও ওয়েস্টার্ন ধরাচূড়াকে পুরোপুরি আঁকড়ে ধরছে না। বরং নিজস্বতাকে বেশ স্বকীয়ভাবেই স্পষ্ট রেখেছে তারা। এই যে অন্য কিছুকে ইঙ্গিত করেও নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার চমকপ্রদ অভিনবত্ব, এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য এক বিষয়। ট্রেলার দেখেই মূল নির্মাণের সিনেম্যাটোগ্রাফী কেমন হবে, তা বলা কষ্টের। তবে যতটুকু বোঝা গেলো, সিনেম্যাটোগ্রাফীতেও যে বিস্তর চমক থাকবে, তাতেও 'যদি-কিন্তু'র সুযোগ নেই অতটা।

স্ট্রিমিং সাইট 'হইচই' যেভাবে একের পর এক দুর্দান্ত কন্টেন্ট নিয়ে আসছে, তাতে দর্শকদের এখন চক্ষু চড়কগাছ হবারই দশা। কয়দিন আগে মুক্তি পাওয়া 'মন্দার' নিয়ে প্রশংসাবাক্য এখনও ফুরোয়নি। এরইমধ্যে 'বলি'র ট্রেলার। যেভাবে আগ্রাসী হয়ে এই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিচ্ছে, তাতে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর আলাদা করে কিছু করার বা বলারও নেই। আশা থাকবে, শঙখ দাশগুপ্তের 'বলি', হইচই কাঁপানো পূর্ববর্তী নির্মাণ 'তাকদীর' কিংবা 'মহানগর'কেও ছাপিয়ে যাবে। 'বলি' নিয়ে নিয়মিত প্রশংসাবাক্য বলাবলি হবে, এটাই এখন তাই একমাত্র প্রত্যাশা।