নায়ক হতে হলে গায়ের রঙ উজ্জ্বল হতে হবে, লম্বাচওড়া, পেশিবহুল হতে হবে; নায়িকা হতে হলে চুল বড় হতে হবে, ডাগর ডাগর চোখ থাকতে হবে... অজস্র সব অর্থোডক্স সংস্কারে বহুদিন বুঁদ হয়ে ছিলো বলিউড। পরবর্তীতে মাধুরী, প্রিয়াঙ্কা, রাজকুমাররা এলেন, এবং ক্রমশই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করলেন এ প্রথাগত কুসংস্কার...

একটা সময় পর্যন্ত উপমহাদেশের সিনেমা-মাধ্যমের চল এমনই ছিলো, নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য মেনে এখানে অভিনয়শিল্পীর রকমফের হতো। বিশেষ করে- সিনেমার লিড রোলে যারা থাকবেন, তাদের ক্ষেত্রে অর্থোডক্স কিছু মাপকাঠি এমনভাবেই মেনে চলা হতো, 'পান থেকে চুন খসা'র বিন্দুমাত্র ঝুঁকিও নেয়া হতোনা মোটেও। নায়ক হতে হলে গায়ের রঙ উজ্জ্বল হতে হবে, লম্বাচওড়া, পেশিবহুল হতে হবে। নায়িকা হতে হলে চুল বড় হতে হবে, ডাগর ডাগর চোখ থাকতে হবে... বহু বায়নাক্কা। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, বহুকাল আগে থেকে চলে আসা এ প্রশ্নবিদ্ধ মাপকাঠি এখনও কমবেশি বহাল উপমহাদেশে। যদিও এই মাপকাঠিকে উপেক্ষা করেও এমন সব তারকার জন্ম হয়েছে কালে কালে, যারা অভিনয় দিয়েই উপেক্ষা করেছেন আদ্যিকালের এসব ক্রাইটেরিয়াকে। এরকম কিছু তারকাকে নিয়েই আজকের চর্বিতচর্বন৷ 

১. মাধুরী দীক্ষিত 

যে মাধুরী দীক্ষিতের সৌন্দর্য-অভিনয়-নৃত্যশৈলীর ভক্ত সবাই, সেই মাধুরী দীক্ষিতের অভিষেক সিনেমার পরপরই রব উঠেছিলো - এই নায়িকা বেশিদিন টিকতে পারবেনা বলিউডে। এমনও বলা হয়েছিলো- তার চেহারার মধ্যে 'নায়িকা' বিষয়টিই নেই। 'নায়িকা' হওয়ার জন্যে যে যে গুণ লাগে, তা তার নেই। আটপৌরে চেহারা তার। চেহারায় কোনো জৌলুশ নেই। যদিও এই মাধুরী দীক্ষিতই পরে করেছেন একের পর এক দুর্দান্ত সিনেমা। হয়েছেন ফ্যাশন আইকন। সুপারস্টার। বহুকিছু। 'দ্য ফেম গেম' এর বরাতে সম্প্রতি তিনি পা রেখেছেন ওটিটিতেও।

মাধুরী দীক্ষিত

২. প্রিয়াঙ্কা চোপড়া

যে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া 'বলিউড' থেকে ক্রমশ নিজের গণ্ডি বাড়াতে বাড়াতে পৌঁছে গিয়েছেন হলিউডেও, সেই 'গ্লোবাল ফেনোমেনন' প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকেও শুরুর সময়টাতে শুনতে হয়েছে নানারকম বিদ্রুপ। গাত্রবর্ণ নিয়ে কটাক্ষ তো ছিলোই। সে আদতেই 'অভিনয়' বোঝে কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন ছিলো অনেকের। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া 'ধীরে চলো' নীতিতে এগিয়ে উত্তর দিয়েছেন সব প্রশ্নেরই। নিজের মত করে। 

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া

৩. রনবীর সিং

'রনবীর সিং' এর অভিনয়-দক্ষতা নিয়ে বোধকরি এখন কারোরই কোনো সংশয় নেই। কিন্তু যখন তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছেন, তখন সংশয় ছিলো প্রায় সবারই। এমনকি আদিত্য চোপড়ার মত মানুষও ঠারেঠোরে জানিয়েছিলো, এই চেহারা নিয়ে রনবীর সিং খুব বেশিদিন বলিউডের খরস্রোতে স্থির থাকতে পারবে না৷ যদিও রনবীর সিং শুধু 'স্থির'ই থাকেননি, দিনদিন বাড়িয়েছেন জনপ্রিয়তাও। 'মেথড অ্যাক্টিং'কেও নিয়ে গিয়েছেন ভিন্ন এক লেভেলে।

রনবীর সিং

৪. বিদ্যা বালান

বলিউডের যে ক'জন নারী অভিনেত্রীর অভিনয় বরাবরই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখা যায়, অভিনেত্রীদের সে তালিকার শীর্ষের দিকে 'বিদ্যা বালান' বরাবরই থাকবেন। যদিও বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই, এই অভিনেত্রীকেও ক্যারিয়ার শুরুর পর, এমনকি, স্টারডম পাওয়ার পরেও বহুদিন শুনতে হয়েছে শ্লেষাত্মক বাক্য। 'বডিশেমিং' থেকে শুরু করে 'অভিনয়-দক্ষতা' নিয়ে সংশয়... শুনতে হয়েছে বহুকিছুই। অবশ্য, সেসবকিছুই আজ অতীত। পুরোপুরি অতীত। 

বিদ্যা বালান

৫. রাজকুমার রাও

বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমাগুলোকে উপেক্ষা করে যে পথচলা রাজকুমার রাও এর, তা বোধহয় মুগ্ধ করে সবাইকেই। কিন্তু এই অভিনেতাকেও বহুবার শুনতে হয়েছে কটুবাক্য। বারবার হতে হয়েছে বৈষম্যের স্বীকার। প্রথম প্রথম যখন অডিশন দিতেন কোনো সিনেমার জন্যে, এমন বহুবারই হয়েছে, অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন তিনি কাস্টিং ডিরেক্টরকে, কিন্তু গায়ের রঙ এবং দুবলাপাতলা স্বাস্থ্যের জন্যে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে শেষমেশ। এরকম বিশ্রি অভিজ্ঞতা বহুবার হয়েছে তার সাথে।

রাজকুমার রাও

৬. নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী

'নায়ক' এর সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েই বলিউডে আসা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর৷ এবং আসার পরেই জনরোষের মুখোমুখি হওয়া। গায়ের রঙ, চেহারা কিংবা স্বাস্থ্য... কোনোদিক থেকেই তাকে নায়কসুলভ মনে হয় না। সুতরাং, জনরোষ ওঠা স্বাভাবিকও। তাছাড়া, তার ছিলোনা কোনো ফিল্ম কানেকশনও। অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে এবং তথাকথিত 'নায়ক' এর সংজ্ঞা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন হয়ে বলিউডে এসে যেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি, তা যেন হার মানায় রূপকথাকেও! 

নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী

৭. আনুষ্কা শর্মা 

পনেরো বছর বয়স থেকে মডেলিং শুরু তার। এবং শুরু সমালোচকদের ঝাঁপি খুলে সমালোচনাও। অজস্রবার তাকে বিজ্ঞাপন থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। 'মডেলিং' এর কন্ট্রাক্ট থেকে না জানিয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে তার অংশে বারবার রিপ্লেসমেন্ট এসেছে৷ আবার যখন বিজ্ঞাপনগুলো সম্প্রচারিত হয়েছে, তখন দর্শক হেসে কুটিকুটি হয়েছে। এরকমই যাপিত নানা প্রতিবন্ধকতা টপকে শেষমেশ তিনি থিতু হয়েছেন। জনপ্রিয় হয়েছেন। সুপারস্টার হয়েছেন। 

আনুষ্কা শর্মা

৮. তাপসী পান্নু

তাপসী পান্নু সাম্প্রতিক সময়ে যে কাজগুলোই করেছেন, প্রতিটিই দর্শকপ্রিয় হয়েছে। গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে কাজগুলো উতরেও গিয়েছে। এবং, বলা বাহুল্য, তার অভিনয়ও হয়েছে চমৎকার। এবং, এটা দ্ব্যর্থকন্ঠেই বলা যায়, নির্মাণ যেরকমই হোক, তাপসী পান্নু সেখানে সর্বোচ্চটাই দেয়ার চেষ্টা করেন সবসময়। যদিও এই অভিনেত্রীকেই ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অভিনয়-জনিত কারণেই শুনতে হয়েছে নানাবিধ বক্রোক্তি। 'নায়িকা'সুলভ গ্লামার নেই, অভিনয় ভালো না, ডায়লগ থ্রোয়িং ভালো না... এরকম নানা কথাই ক্রমশ শুনতে হয়েছে তাকে। যদিও অভিনয় দিয়েই সেসব প্রশ্নের ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর দিয়েছেন তিনি।

তাপসী পান্নু

'Don't Judge a Book By It's Cover' নামক নীতিবাক্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করে বলিউডি অডিয়েন্স, চেহারা কিংবা বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়েই বহুকাল বিচার করে এসেছে নায়ক-নায়িকার শ্রেষ্ঠত্বকে। অবশ্য, সময় পাল্টেছে। আজকাল, একজন অভিনেতার গুণগতমান বিচার হয় 'অভিনয়' দিয়েই। যদিও, এই বিষয়টা হওয়া উচিত ছিলো অনেক আগে থেকেই৷ অবশ্য, এখন যে হচ্ছে,এও বা কম কি! কারণ, এটা তো সবারই জানা-

Better Late Than Never. 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা