নারীকেন্দ্রিক সিনেমা: যে গল্পগুলো বলায় বলিউড বরাবরই পারদর্শী
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মাদার ইন্ডিয়া থেকে গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি... নারী চরিত্রেরা প্রোটাগনিস্ট থেকেও যে সিনেমাকে করতে পারে সুপারহিট, এ নির্মাণগুলোই সে বাক্যের স্বপক্ষে জ্বলজ্বলে প্রমাণ। অবশ্য যেখানে জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে পুরুষের সাথে, সেখানে সেলুলয়েডেও জনপ্রিয়তার নিরীখেও যে নারীরা টক্কর দেবে সমানে সমানে- তাতে আর আশ্চর্যও বা কী?
যেখানে ‘উপমহাদেশের সিনেমা’ মানেই ধরে নেয়া হয়, নায়কের একচেটিয়া প্রাধান্য, সেখানে নায়িকা-নির্ভর সিনেমা বানানো যে কতটা ঝক্কির কাজ, তা সচেতনমাত্রেরই জানা। তবুও যুগে যুগে, কালে কালে অজস্র সিনেমাই এমন হয়েছে যেখানে ‘ফিমেল ক্যারেক্টার’ই হয়েছে প্রোটাগনিস্ট, দেখিয়েছে চমক। যে তালিকার সাম্প্রতিক উদাহরণ- গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি। যে সিনেমা নায়িকা-সর্বস্ব হয়েও বক্সঅফিসে দারুণ ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তবে যারা সিনেমা নিয়ে মোটামুটি ধারণা রাখেন, তারা পাশাপাশি এও জানেন, ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’র আগেও এরকম বলার মত আরো সিনেমা হয়েছে, যেসব সিনেমা বক্সঅফিসে যেমন সাড়া ফেলেছে, তেমনি ক্রিটিকদের কাছেও হয়েছে সমাদৃত। সেরকম কিছু সিনেমাই আজকের উপজীব্য।
১. মাদার ইন্ডিয়া
হিরোইন-সেন্ট্রিক বলিউডি সিনেমার কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই প্রথমে চলে আসে নার্গিস দত্তের ‘মাদার ইন্ডিয়া’র কথা। ১৯৫৭ সালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ সিনেমা যেন ‘প্যারাডাইম শিফট’ এর নজিরই দেখিয়েছিলো দারুণভাবে। ‘রাধা’ নামের এক গ্রাম্য নারী, যিনি স্বীয় কর্মকান্ডের সুবাদেই রূপান্তরিত হয়েছেন গ্রামবাসীর আশা-ভরসার প্রতীকে, তিনি কিভাবে নানা প্রতিকূলতার ডামাডোলেও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় থেকেছিলেন অনড়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে তিনি হয়েছিলেন খড়গহস্ত, সেটাই উপজীব্য ‘মার্ডার ইন্ডিয়া’র।
২. ব্যান্ডিট কুইন
দস্যুরানী ‘ফুলন দেবী’র জীবন-আখ্যান অবলম্বনে সিনেমা, যেখানে নামভূমিকায় সীমা বিশ্বাস, যে সীমা বিশ্বাসও ‘ফুলন দেবী’র মতই একবার গিয়েছিলেন জেলে! এরকম দুর্দান্ত রাজযোটক চরিত্রদ্বয়ের মিলন ঘটলো শেখর কাপুরের ‘ব্যান্ডিট কুইন’ সিনেমায়। যারা ‘ফুলন দেবী’কে নিয়ে ছিঁটেফোটাও জানেন, তারা সকলেই অবগত, কতটা বর্ণময় ছিলো এ চরিত্র। পুরুষ-শাসিত সমাজকে থোড়াই-কেয়ার করে কিভাবে এ চরিত্র বিস্তার করেছিলো তার রাজ্যপাট। সেই রহস্যময়, দুর্ধর্ষ ফুলন দেবী’র নানাবিধ গল্প-অগল্প কিংবা মিথেরই আশ্চর্য এক সংকলন দুর্দান্ত এ সিনেমা।
৩. কাহানি
সুজয়-বিদ্যা জুটির ‘কাহানি’তে বহুকিছুর পাশাপাশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো মাতৃমূর্তির স্বরূপও। কলকাতার দূর্গাপূজার প্রেক্ষাপটে এগোনো এক মিস্ট্রি থ্রিলার, সেখানে ‘মা দূর্গা’র মমতাময়ী মাতৃসত্তার সাথে যেভাবে সাটলভাবে ব্লেন্ড করা হলো বিদ্যা ভিনসেন্টের মাতৃত্বের সংগ্রামকে, গল্প জমে গেলো ঠিক সেখানেই। এবং শেষে এসে এই মাতৃ-সত্তাকে কেন্দ্র করে যেভাবে এলো অন্যরকম এক টুইস্ট...অনবদ্য। পুরো সিনেমায় চুটিয়ে অভিনয়ও করলেন বিদ্যা বালান।
৪. ইংলিশ ভিংলিশ
লেডি সুপারস্টার শ্রীদেবী এ সিনেমায় ‘শশী গডবলে’ চরিত্রে যে অভিনয় করেছেন, তা চোখে লেগে থাকবে অনেক সিনেমাপ্রেমীরই। এক গড়পড়তা গৃহিনী, যিনি শুধুমাত্র ইংরেজীতে দূর্বল হওয়ার কারণে ক্রমশ অপদস্থ হন স্বামী-সন্তানের কাছে, সেই তিনিই শেষে এসে কিভাবে পালটে ফেলেন অবতার... তা নিয়েই গৌরী সিন্ধের সিনেমা ‘ইংলিশ ভিংলিশ।‘ সাদামাটা অথচ অর্থবহ গল্প, সাথে শ্রীদেবীর দুর্দান্ত অভিনয়... এ সিনেমা নিয়ে আলাদ করে আর বলার কিইবা আছে?
৫. কুইন
মফস্বলের এক তরুণী ‘রানী’, গড়পড়তা যেকোনো মেয়ের মতই যার চোখে অজস্র স্বপ্ন, সেই স্বপ্নগুলোই একদিন আচমকা হয়ে যায় ফিকে। বিয়ের একদিন আগে জানা যায়, রানীর হবু বর এই বিয়েতে আর রাজি নয়। বলাবাহুল্য, বিয়ে ভেঙ্গে যায়। রানী নিজেও ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু পরে এসে নিজেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে আর নয়। রানী নেমে পড়ে পথে। শুরু হয় অন্যরকম এক রানীর গল্প। ছিমছাম ঘটনাপ্রবাহ, সাথে কঙ্গনা রানাউতের দুর্দান্ত অভিনয়... ‘কুইন’ ঠিক এভাবেই হয়ে পড়ে প্রাসঙ্গিক।
৬. মারদানি
‘মারদানি’র পুরোটাজুড়েই পুলিশ অফিসার শিবানী রায়, যিনি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র এবং শিশু পাচারকারীদের গ্যাং’কে বামালসুদ্ধ ধরার জন্যে যেতে থাকেন একের পর এক মিশনে। প্রাসঙ্গিক টানটান গল্প, লিড রোলে রানী মূখার্জি এবং তার প্রাসঙ্গিক অনবদ্য অভিনয়... সবিকিছুর মিলিত মিশেলেই বেশ জনপ্রিয় হয় নারীপ্রধান এ সিনেমা।
৭. নিরজা
প্যান এএম ফ্লাইট ৭৩ তে ঘটে যাওয়া রুদ্ধশ্বাস হাইজ্যাকের সত্যঘটনাকে উপজীব্য করে নির্মিত এ সিনেমার মূ্ল আখ্যান আবর্তিত হয় ফ্লাইট পারসার নিরজা ভানোতকে কেন্দ্র করেই, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে শেষতক রক্ষা করেছিলেন শতাধিক যাত্রীকে। ভারতবাসীর খুব শ্রদ্ধার ‘নিরজা’ চরিত্রে সোনম কাপুর অভিনয়ও করেন দারুণ। ফলশ্রুতিতে, যাপিত পাদপ্রদীপের আলোও নিজের দিকে টেনে নেন অনায়াসে।
৮. মম
শ্রীদেবীর আরেক ‘ওয়ান ওম্যান শো’ এর নাম ‘মম’, যেখানে তিনি অভিনয় করেন এমন এক মায়ের চরিত্রে, সন্তানের ধর্ষণ ও হত্যারহস্য উদঘাটনের জন্যে এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার জন্যে যে মা নিজেকে পালটে ফেলেন খোলনলচে। যে মা নিজে নেমে পড়েন রূঢ় রাস্তায়। গড়পড়তা এক মা থেকে টার্নওভার করে যেরকম চরিত্রে রূপান্তরিত হন শ্রীদেবী, ক্যারেক্টারের এরকম ইউটার্ণ হয়তো তার পক্ষেই সম্ভব ছিলো শুধু।
৯. পিঙ্ক
‘নো মিনস নো’ নামের এ বাক্য যে কতটা অর্থবহ, সেটা ‘পিঙ্ক’ সিনেমাতে প্রকট হয়ে উঠেছিলো দারুণ প্রাসঙ্গিকভাবে। সম্পর্কের যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো বিষয়ে অনুমতির ভূমিকা যে কতটা প্রকট, অনুমতি ব্যতিরেকে যেকোনো কিছুই যে অন্যায়... গালে চপেটাঘাতের মত করেই এ তিতকুটে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো এ সিনেমা। সিনেমায় যদিও অমিতাভ বচ্চন ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এক ক্যারেক্টারে, তবুও, পাশাপাশি নারী চরিত্রগুলোর অভিনয়ও ছিলো দুর্দান্ত।
১০. অর্থ
স্বামীর অনৈতিক সম্পর্কের কথা জানতে পারলেন স্ত্রী, জেনে এরপর তিনি কি করলেন? অভিযোগ ও কান্নাকাটির পসরা সাজিয়ে বসে একসময়ে মেনে নিলেন সব? যদি এমনটাই ভেবে থাকেন কেউ, তাহলে তার টনক নড়াবে যে সিনেমা, সে সিনেমার নাম- অর্থ। মহেশ ভাটের এ সিনেমায় বেশ দুর্দান্তভাবেই উঠে আসে সে প্রেক্ষাপট, যেখানে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী স্বামীকে উপেক্ষা করে স্ত্রী আস্তে আস্তে নিজেই নিজের জীবনের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এবং হয়ে ওঠেন স্ব-নির্ভরশীল।
কলমের ডগায় উঠে আসা সিনেমাগুলো ছাড়াও খোদ বলিউডেই আরো অজস্র এমন সিনেমা আছে যেখানে ক্রমশই দেখতে পাওয়া গিয়েছে নারীচরিত্রের জয়গান। এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই, এসব সিনেমা নায়িকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হওয়া সত্বেও বক্সঅফিসে প্রভাব পড়েনি তিলমাত্র। মাদার ইন্ডিয়া থেকে গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি...এ বাক্যের স্বপক্ষেই জ্বলজ্বলে প্রমাণ। অবশ্য যেখানে জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে পুরুষের সাথে, সেখানে সেলুলয়েডেও জনপ্রিয়তার নিরীখেও যে নারীরা টক্কর দেবে সমানে সমানে... তাতে আর আশ্চর্যও বা কী?