স্বস্তি এটাই, পর্দার সামনের কুশীলবদের নিয়েই আমরা যেখানে বরাবরই চিন্তিত, সেখানে পর্দার পেছনের মানুষদের নিয়ে কিছু লেখার সুযোগ হলো আজ। নির্মাণের উৎকর্ষতার পেছনে পর্দার নেপথ্যের কুশীলবদেরই যে প্রধানতম ভূমিকা, সেটুকু স্মরণ করে তাই এটুকুই রইলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের নৈবেদ্য।  

যদি সাম্প্রতিক ভারতের ওটিটি কন্টেন্টগুলো কেউ  খেয়াল করেন, দেখবেন, সেখানে নারীদের বেশ সরব ও সপ্রতিভ উপস্থিতি। ক্ষেত্রবিশেষে যা এটাও ভাবাবে, ওটিটির এরকম রমরমা সময় না এলে হয়তো এভাবে প্রকাশিত হতেন না নারীরা। মাধুরী দীক্ষিতের 'ফেম গেম', রাভিনা টেন্ডনের 'আরণ্যক' কিংবা সুস্মিতা সেনের 'আরিয়া' যার স্বপক্ষে শক্তপোক্ত উদাহরণ হিসেবেই কাজ করবে। যদিও এখানে খানিকটা খচখচানিও আছে। স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে নারী কুশীলবদের উত্থান হচ্ছে প্রায়শই, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই, কিন্তু, মূদ্রার উল্টোপিঠে, কেন যেন সেরকম কোনো নারী পরিচালক নেই ওটিটি'র এই মঞ্চে। অথচ যদি বলিউডি সিনেমার দিকে তাকাই, সেখানে হয়তো নারী অভিনেত্রীরা খানিকটা ব্যাকফুটে, কিন্তু নারী পরিচালকদের আবার সেখানে রমরমা অবস্থা। ভালো সিনেমা তো তারা বানাচ্ছেনই। পাশাপাশি, সেসব সিনেমায় এমন কিছু চরিত্রও জন্ম নিচ্ছে, যুগের পর যুগ পার হয়েও যারা থেকে যাচ্ছে অমলিন। বলিউডি সিনেমার এরকম কিছু পরিচালক ও তাদের নির্মিত দুর্দান্ত চরিত্রই আজকের উপজীব্য।

১. সোনালী বোস

সোনালী বোসের 'মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র' হয়তো অনেকেই দেখেছি আমরা, যেখানে দুই নারীর মধ্যবর্তী প্রেম ও প্রেমজনিত অন্তরঙ্গতা দেখানো হয় দুর্দান্ত মুন্সিয়ানায়। এ সিনেমার 'লায়লা কাপুর' চরিত্রতে অভিনয় করেন কালকি কোচিন। চরিত্রটি এমন, সে এক নারীকে ভালোবাসে, এবং একই সাথে সে সেরেব্রাল পালসিতেও আক্রান্ত। এই দোটানার চরিত্রটি লেখাও হয়েছিলো যেমন দারুণভাবে, কাল্কি করেছিলেনও তেমন দুর্দান্ত অভিনয়। এবং হয়তো ঠিক সে কারণেই, চরিত্রটিও পাকাপাকিভাবে রয়ে গিয়েছে মনে।

সোনালী বোস

২. দীপা মেহতা

দীপা মেহতাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই চলে আসে তার বহুল আলোচিত নির্মাণ 'ফায়ার' এর কথা। এটাই বলিউডের প্রথম সিনেমা যেখানে সমকামীতাকে প্রকাশ্যে দেখানোর সাহস করা হয়েছিলো। এবং শুধু তাই না, এ সিনেমায় শাবানা আজমী এবং নন্দিতা দাসের 'রাধা' ও 'সীতা' চরিত্রদ্বয়ও মুগ্ধ করেছিলো বিস্তর।

দীপা মেহতা

৩. গৌরী সিন্ধে

'ইংলিশ ভিংলিশ' সিনেমায় শ্রীদেবীর কামব্যাক হয়েছিলো যেমন দুর্দান্ত, তেমনি, গৌরী সিন্ধের পরিচালনাও মুগ্ধ করেছিলো বেশ। 'ভাষা' যে জীবনের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারেনা মোটেও, এ আপ্তবাক্যের পাশাপাশি এ সিনেমা উপহার দিয়েছিলো 'শশী গডবলে'র মত আইকনিক এক চরিত্রকেও। 

গৌরি সিন্ধে

৪. মীরা নায়ার

নির্মাতা মীরা নায়ারের নির্মাণগুলোর মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য যে থাকে, তা সর্বজনবিদিত। খাট্টামিঠা স্বাদের 'দ্য মুনসুন ওয়েডিং' দেখলেই অবশ্য বুঝতে পারার কথা তা৷ পাঞ্জাবি হিন্দু বিয়ের জোগাড়যন্তরের মাঝখানে কিছু খুনসুটি, সম্পর্ক, কিছু বিচিত্র চরিত্রের আনাগোনা...সব মিলিয়ে, 'দ্য মুনসুন ওয়েডিং' এতই অনবদ্য, যতই দেখি, পুরোনো হয় না। 

মীরা নায়ার

৫. অপর্ণা সেন

যখন আঁধার ঘনায়, তখন যাপিত মানব অনুভূতির কী হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই হয়তো অপর্ণা সেন বানিয়েছিলেন 'মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস আইয়ার।' কঙ্কনা সেনশর্মা এবং রাহুল বোস অভিনীত এই অনবদ্য সিনেমায় যেভাবে নানাবিধ মনুষ্যত্বের বহুরূপী আলো-আঁধার ফুটে উঠেছে, তা বিস্মিত করার মতন। চমকের মতন। নির্মাণে বহুকিছুর পাশাপাশি চরিত্রদুটিও হয়েছিলো দুর্দান্ত। 

অপর্ণা সেন

৬. মেঘনা গুলজার

গুলজার-রাখীর মেয়ে মেঘনা গুলজারও যে বিস্তর প্রতিভাবান হবেন, তাতেও ছিলোনা সন্দেহ। ফিলহাল, ছাপাক কিংবা তালভারে তিনি তার প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেনও। তবে সবকিছু ছাপিয়েও আমার বিশেষ প্রিয় তার নির্মিত 'রাজি' সিনেমা। এই সিনেমার মূখ্য 'রাজি' চরিত্রে আলিয়া ভাট করেছিলেনও মনে রাখার মতন অভিনয়।

মেঘনা গুলজার

৭. কিরন রাও

'ধোবি ঘাট' সিনেমা দেখে স্থানু হয়ে বসেছিলাম বহুক্ষণ। বলিউডে যেসব সিনেমা দেখে আমরা বরাবরই অভ্যস্ত, সেসব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই নির্মাণ ভাবিয়েওছিলো বিস্তর। চারটি চরিত্র, তাদের ভিন্ন ভিন্ন গল্প, সে সব গল্পে গভীরতার একেক ক্ষেত্র... নিজের অভিষেক সিনেমাতেই কিরন রাও যে এরকম দুর্দান্ত এক নির্মাণ নিয়ে হাজির হবেন, তা ভেবেছিলো কেউ?

কিরন রাও

৮. জোয়া আখতার

বলিউডি নারী নির্মাতাদের নিয়ে কথা উঠলে জোয়া আখতারের কথা আসবে না, তা কিভাবে হয়? জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা, দিল ধাড়াকনে দো, গালি বয় সহ দুর্দান্ত অনেক নির্মাণের সাথেই যুক্ত তার নাম। তবে, আমার বিশেষ পছন্দ হিসেবে থাকবে 'জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা।' ছিমছাম সুন্দর জীবনবোধের গল্প, পাশাপাশি, চরিত্রগুলোর দুর্দান্ত অভিনয়... অজস্র কারণেই এ সিনেমা বিশেষ প্রিয়।

জোয়া আখতার


৯. ফারাহ খান

'ওম শান্তি ওম' কিংবা 'ম্যায় হু না'র মত মেইনস্ট্রিম বলিউড সিনেমার মেকার যিনি, তাকে উপেক্ষা করা যাবেও বা কিভাবে? ফারাহ খান ঠিক এভাবেই প্রাসঙ্গিক। যিনি মাস অডিয়েন্সকে কানেক্ট করে গল্প বলতে জানেন। যিনি মাস অডিয়েন্সের জন্যে গল্প বলতে জানেন। 

ফারাহ খান

এদের বাইরেও রয়ে গেলো আরো প্রিয় কিছু নির্মাতার নাম। রীনা দাস, রেবতী কিংবা তনুজা চন্দ্র, অথবা, হালের কঙ্কনা সেনশর্মা... তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ নির্মাণে সৃজনশীল। যত্নশীল। আজ পারিনি, তবে, হয়তো অন্য কোনো একদিন লিখবো তাদের নিয়ে। যদিও স্বস্তি এটাই, পর্দার সামনের কুশীলবদের নিয়েই আমরা যেখানে বরাবরই চিন্তিত, সেখানে পর্দার পেছনের মানুষদের নিয়ে কিছু লেখার সুযোগ হলো আজ। নির্মাণের উৎকর্ষতার পেছনে পর্দার নেপথ্যের কুশীলবদেরই যে প্রধানতম ভূমিকা, সেটুকু স্মরণ করে তাই এটুকুই রইলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের নৈবেদ্য।  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা