একটা সময় বলিউডে হিট সিনেমার রেসিপিই ছিল রোমান্টিক কমেডি। অথচ এখন আশেপাশের বলিউডি সিনেমাগুলোর দিকে তাকালে ক্রমশই অবাক লাগে। প্রশ্ন জাগে- একসময়ের দাপুটে বলিউডি 'রোমকম' সিনেমাগুলো আজ কোথায়? একসময়ে যে জনরাই ছিলো বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্যাক্টর, সময়ের ফেরে তারাই কেন আজ বেমালুম ব্রাত্য? 

যদি নব্বই দশকের কথা বলা হয় কিংবা বলা হয় 'শূন্য দশক' এর প্রথম দিকের কথা, তখন বলিউডি সিনেমা মানেই রোমান্সের জয়জয়কার। হোক তা রোমান্টিক কমেডি কিংবা রোমান্টিক ট্রাজেডি... সিনেমা মানেই যেন 'প্রেম' নামক অলীক বস্তুর পেছনে যাপিত দৌঁড়ঝাপ! পরবর্তীতে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের সময়কালেও সিনেমাগুলো কমবেশি এমনই ছিলো। এরপর যদিও জেনারেশন চেঞ্জ হয়েছে, কিন্তু তাও প্রেমের সিনেমার আবেদন কমেনি মোটেও। অবশ্য 'রোমান্টিক' জঁরার সিনেমায় তখন 'ট্রাজেডির' বদলে বেশি গুরুত্ব পেতো 'রোমান্টিক কমেডি।' অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে, প্রেমঘটিত তাদের ঘোর, ভ্রম অথবা জটিলতা, সেসব বিড়ম্বনা থেকে নাটকীয় মুক্তি, মধুরেণসমাপয়েৎ... গল্পগুলো ছিলো অনেকটাই একই ফরম্যাটের। কিন্তু গড়ন এক হলেও মুগ্ধতা কমতো না। বরং, সম্পর্কের দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটিগুলো বেশ উপভোগ্য ছিলো বরাবর। কিন্তু, এখন যখন আশেপাশের সিনেমাগুলোর দিকে তাকাই, ক্রমশই অবাক লাগে- 'রোমকম' এর সে প্রবল জনপ্রিয় সিনেমারা আজ আর কেন আসেনা বলিউডে? একসময়ে যে জঁরাই ছিলো বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্যাক্টর, তারাই কেন আজ প্রেক্ষাপট থেকে বেমালুম ব্রাত্য? 

ইমতিয়াজ আলীর সিনেমা মানেই ছিলো চূড়ান্ত রোমান্টিসিজম!  

এ প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। তবে শুরু করা যায় এভাবে- সময় যত গড়াবে, মানুষের রুচি পাল্টাবে, নির্মাতাদের গল্প বলার ধরণ এবং গল্পের বিষয়বস্তু পাল্টাবে। এটা প্রাসঙ্গিকও। এবং সেটা হয়েছেও। বিগত কিছু বছরে ইন্টারনেট এবং স্ট্রিমিংসাইটগুলোর প্রাধান্য বেড়েছে, মানুষের 'বৈশ্বিক নির্মাণ' দেখারও সুযোগ বেড়েছে, নানা বিষয়বস্তুর নির্মাণ দেখতে দেখতে মানুষের টেস্টবাডও পাল্টেছে বিস্তর। সেটার ফলশ্রুতিতেই যদি দর্শকের মনোযোগ তল খুঁজে পায় অন্য আবহের গল্পে এবং তারা যদি মুখ ঘুরিয়ে নেয় 'রোমকম' থেকে, তবে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যাবেও না৷ পাশাপাশি, এও তো ঠিক, যত দিন গড়াচ্ছিলো, বলিউডের এই জঁরার নির্মাণগুলোও হয়ে পড়ছিলো ততই একঘেয়ে। যদি সর্বশেষ দুটি রোমকম- 'অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল' কিংবা 'লাভ আজ কাল টু' এর কথা বলা হয়, তাহলেই সে কথার সত্যতাও মিলবে বিস্তর। যেখানে হলিউডি কিংবা কোরিয়ান রোমকম এখনও বিস্তর পছন্দ করছে ইয়াং জেনারেশন, সেখানে বলিউডি রোমকম ন্যূনতম ব্যবসাই করতে পারছে না... এই বৈপরীত্যের যোগসূত্র কী বলিউডি নির্মাতাদের সময়ের সাথে সাথে 'ক্রাফটস আপডেট' না করার অপারগতা কিংবা একই 'ফর্মুলা'র পুনরাবৃত্তিতেই নিহিত? উত্তর যেটাই হোক, বিষয়টাতে যে ভাবনার খোরাক আছে বিস্তর, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

তবে 'ক্রাফটস আপডেট' করলে যে এই জঁরার এখনও বেশ সম্ভাবনা আছে, সেটা বোঝা গেলো বেশ কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া 'বাধাই দো' সিনেমায়। এ সিনেমায় সমকামী প্রেমকে কেন্দ্র করে যেরকম ছিমছাম এক রোমকম হয়ে গেলো, সেরকমটা দুইজন নারী-পুরুষের মধ্যে কেন বানানো যাচ্ছে না, প্রশ্ন উঠলো ক্ষণেক্ষণেই। 'বাধাই দো' যে শুধুমাত্র 'এলজিবিটিকিউ' ক্যাটাগরির সিনেমা হওয়াতেই দর্শক পছন্দ করছে, এমনও তো না৷ গল্পের বিন্যাসেই এমন কিছু সিচুয়েশনাল কমেডির বিষয় ছিলো, প্রেমঘটিত কিছু অনুষঙ্গ এমনভাবে ক্লিক করেছে, মানুষ তাতে সন্তুষ্টও হয়েছে, এবং সেসবের কারণে বেশ ভালোভাবে উতরেছেও এ সিনেমা। কিন্তু এসব 'ফিল গুড টপিংস' কেন কনভেনশনাল রোমকমে আনা যাচ্ছে না? গেরোটা আসলে কোথায়? প্রশ্ন থাকেই। 'টিপিক্যাল রোমকম' হলে নাহয় মানুষ দেখছে না, কিন্তু তাই বলে একটু ভিন্ন মোড়কে ভাবার চেষ্টা কি করা যায় না মোটেও? 

গভীর রসায়নের সে রোমকম সিনেমাগুলো আজ কোথায়? 

ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। ইদানীং খেয়াল করলে দেখা যাবে- বিশেষ এক 'রোমান্স' কিংবা ভালোবাসার উৎপত্তি ঘটেছে বলিউডে। সেটি হচ্ছে- দেশের জন্যে ভালোবাসা। ইন্ডিয়ান জিঙ্গোইজম। আশেপাশের সাম্প্রতিক নির্মাণগুলোর দিকে যদি তাকানো হয়- হোক তা হিস্টোরিক্যাল ফিল্ম, স্পোর্টস ড্রামা কিংবা এসপিওনাজ থ্রিলার, হোক তা 'আরআরআর', 'এইটি থ্রি' কিংবা 'উড়ি'... এসব সিনেমায় আজকাল দেশপ্রেম এতটাই প্রবল এবং এই ফর্মুলার সিনেমা এতটাই জনপ্রিয় হচ্ছে ক্রমশ, ক্ষেত্রবিশেষে মনে হচ্ছে, 'জাতীয়তাবাদ' কিংবা 'দেশপ্রেম'কে কোনোভাবে নির্মাণে যুক্ত না করলে স্বস্তি হয় না নির্মাতাদের এবং তৃপ্তি আসেনা দর্শকদের! একটা সময় যেখানে বলিউডি হিট সিনেমা মানেই ছিলো ট্রাজিক 'দেবদাস' কিংবা 'মুঘল-ঈ-আজম', সেখান থেকে পরবর্তীতে এলো 'রোমকম' এর রাজত্ব। সেসব টপকে এখন বলিউডি সিনেমা মানেই 'ইন্ডিয়ান জিঙ্গোইজম' আর থ্রিলার-অ্যাকশন। এরপর? এই ফর্মুলার পরের জংশন কী? পাশাপাশি, এটাও উল্লেখ করতে হয়, বলিউডে যেভাবে রিমেকের হিড়িক নেমেছে, পলিটিক্যাল এজেন্ডা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে যেভাবে বানানো হচ্ছে একের পর এক নির্মাণ,  এবং সেসব নির্মাণ যেভাবে বক্স অফিসে ক্লিকও করছে... তাতেও শঙ্কা জাগে, বলিউডি ফিল্মের ভবিষ্যৎ আসলে কতটুকু তমসাময় আর কতটুকু উজ্বল? 

বলিউডে 'রোমান্টিক কমেডি' জঁরার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গিয়েছে, সেটা মোটেও বলছি না। তবে এই জঁরার যে ভবিষ্যৎও খুব অনিশ্চিত, সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই মোটেও। আজকাল মানুষ শুধু এক সাদামাটা প্রেমের গল্পে আর সন্তুষ্ট হয় না। তারা সেই প্রেমের গল্পের মাঝেও সমসাময়িক সামাজিক আখ্যান খোঁজে, যাপিত টানাপোড়েনের রূঢ় অবয়ব দেখতে চায়। যেটা দুই দশক আগেও ছিলো না৷ তখন ট্রেনের কামরায় দু'জন মানুষের আচমকা দেখা হওয়ায় বুকে প্রজাপতির নাচন, প্রিয় মানুষের হাত প্রথমবার ধরে পাওয়া 'সব পেয়েছি'র সুখ কিংবা কাউকে একনজর দেখার জন্যে সাত সমুদ্রের দূরত্ব পার হওয়ার গল্পে যারপরনাই তৃপ্তি পেতো দর্শক! 

কিন্তু আক্ষেপ এটাই, সোজাসাপটা ভালোলাগার সেসব দিন আজ অতীত। এখনকার মানুষ স্বাভাবিকভাবে ভাবেনা। 'ওল্ড স্কুল লাভ'ও আজকাল কাউকে সন্তুষ্ট করেনা। প্রজন্ম পাল্টেছেও বিস্তর। হয়তো সেকারণেই, গিমিক, থ্রিল আর অ্যাড্রেনালিন রাশের চক্করে হারিয়ে গিয়েছে বলপয়েন্টে কলমে লেখা প্রথম প্রেমপত্রের রোমাঞ্চ, যে প্রেমপত্রে লুকোনো থাকতো শুকনো গোলাপ-দেহ, তারা আজ সেকেলেও। সেকেলে তাই গল্পগুলোও। গল্পের নির্মাণগুলোই। এবং এটাই হয়তো 'রোমকম' এর অন্তিম এপিটাফ! হয়তো, এভাবেই ফুরোয় সব! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা