বলিউডকে কি থোড়াই কেয়ার করছে রিজিওনাল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
খুবই দরিদ্র এক ইন্ডাস্ট্রি হওয়া সত্বেও মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একের পর এক দুর্দান্ত সিনেমা বানিয়ে সবাইকে চমকে দিচ্ছে। যে কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি'কে অতটা গুরুত্বই দিতো না কেউ, তারা এক 'কেজিএফ' বানিয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছে দেশ-বিদেশ। তামিল, তেলেগু সিনেমাগুলোও আছে সমানতালে। সাউথ ইন্ডিয়া বলি কিংবা নর্থ, আশেপাশের সব জায়গা থেকে সবাই মিলেই এখন ছেঁকে ধরেছে বলিউডকে...
করোনার এই ক্রান্তিকালে আমরা অনেক কিছুর সংজ্ঞা পালটে যেতে দেখেছি। যেসব বিষয়কে ভাবতাম ধ্রুবসত্যি, সেসব বিষয়ের স্বস্থানচ্যুতি হতে দেখেছি। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে- বলিউডের কথা। সবসময়েই দেখেছি, ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মধ্যে বলিউডই মোড়ল। সর্বেসর্বা। সবার উপর ছড়ি ঘোরানোতে তারাই ওস্তাদ। মানের বিষয়ে কথা বলছি না। কারণ, সামগ্রিক বিবেচনায় বলিউডের চেয়েও যে অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির সিনেমার মান অনেক বেশি উন্নত, তা জানতে গেলে ফিল্ম ক্রিটিক হতে হয় না৷ একটু সমঝদার হলেই হয়৷
তবুও মান না থাকা সত্বেও বলিউড ক্রমশ ছড়ি ঘুরিয়েছে। কারণটাও সোজা। সিনেমার সবচেয়ে বড় মার্কেট তাদের দখলে। তবে সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, তাদের এই দখলদারিত্ব ক্রমশ কমছে। আমরা দেখেছি, খুবই দরিদ্র এক ইন্ডাস্ট্রি হওয়া সত্বেও মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একের পর এক দুর্দান্ত সিনেমা বানিয়ে সবাইকে চমকে দিচ্ছে। যে কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি'কে অতটা গুরুত্বই দিতো না কেউ, তারা এক 'কেজিএফ' বানিয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছে দেশ-বিদেশ। তামিল, তেলেগু সিনেমাগুলোও আছে সমানতালে। সাউথ ইন্ডিয়া বলি কিংবা নর্থ, আশেপাশের সবখান থেকেই সবাই মিলে এখন ছেঁকে ধরছে বলিউডকে।
এবং এই ছেঁকে ধরার মিছিলে সবার সামনে আছে সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমাগুলো। সাম্প্রতিক একটা বিষয় হয়তো অনেকেই খেয়াল করেছেন, সাউথের সিনেমাগুলোতে বলিউড স্টারদের নিয়মিত নেয়া হচ্ছে। এস এস রাজমৌলির 'আরআরআর' এ আলিয়া ভাট, অজয় দেবগন যুক্ত হলেন। 'কেজিএফ' এ এলেন সঞ্জয় দত্ত, রাভিনা টেন্ডন। নাগ আশ্বিনের সিনেমাতে এলেন অমিতাভ বচ্চন, দীপিকা। ভারতের এসব প্রদেশের সিনেমাগুলোকে একাধিক ভাষায় মুক্তি দেয়া হচ্ছে। ভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতাদের যুক্ত করা হচ্ছে। নির্মাতাদের এসব করার উদ্দেশ্য একটাই, সিনেমাগুলোর স্ট্যাটাস 'রিজিওনাল' থেকে শিফট করে 'ন্যাশনাল' এ নিয়ে যাওয়া। সেটাই হচ্ছে এখন। 'প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা' হওয়ায় এসব নির্মাণের অডিয়েন্স ক্রমশই বাড়ছে, গণ্ডি ক্রমশই বিস্তীর্ণ হচ্ছে।
মহামারীকালে 'ওটিটি প্ল্যাটফর্ম'গুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। মানুষ ছোট পর্দায় সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত হয়েছে। এই ওটিটির কল্যানে আর কার কোন লাভ হয়েছে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ থাকলেও, স্ট্রিমিং সাইটগুলোর কল্যানে যে সাউথের সিনেমাগুলোর বৈশ্বিক এক জনপ্রিয়তা এসেছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই একবিন্দু। এটা তো ঠিক, ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের সিনেমাগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। প্রশ্ন ছিলো সিনেমাগুলোর সুষম সরবরাহে। ওটিটির কল্যানে সে বালাইও নেই আর৷ 'সি ইউ সুন', 'জোজি', 'কোল্ড কেস', 'মালিক', 'সুরারাই পাত্তারু', 'কুরুঠি' কিংবা 'হোম' এর মতন সিনেমাগুলো নিমেষেই পৌঁছে গিয়েছে অডিয়েন্সের কাছে। সিনেমাগুলো জনপ্রিয় হয়েছে। ব্যবসাও করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- মহামারীর এই সময়ে বলিউডের যেসব সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যেমন- শেরনি, লক্ষ্মী, রাধে কিংবা বেলবটম...এসব সিনেমা তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায় নি। সোজা বাংলায়, হোঁচট খেয়েছে। কাউন্টার লজিক হিসেবে মিমি, লুডু কিংবা শেরশাহ এর মতন বলিউডি সিনেমার কথা বলা যেতে পারে। এসব সিনেমা বেশ ভালো ব্যবসা করেছে৷ কিন্তু, সাফল্যের পরিসংখ্যানে সাউথের সিনেমাগুলোই যে এগিয়ে থাকবে, তাতে কারো কোনো সন্দেহ থাকা উচিত না মোটেও।
কিন্তু এ সাফল্যই শেষ কথা না। এটা জানা ছিলো সবারই, ওটিটি'তে সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্ম একচেটিয়া ব্যবসা করলেও সিনেমাহল খোলার পরে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বলিউডই সবার আগে ফ্রন্টলাইনে আসার চেষ্টা করবে। এবং সেটাই হচ্ছে এখন। মহারাষ্ট্রের সিনেমাহলগুলো খুলে দেয়ার ঘোষণা আসার পর থেকেই বলিউডি সিনেমাগুলোর মুক্তির ঘোষণা দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। যেহেতু মহারাষ্ট্রের সিনেমাহলগুলোতে হিন্দি সিনেমার ৩০%-৪০% দর্শক আসেন, তাই এই সিনেমাহলের খোলার অপেক্ষাতেই ছিলেন বলিউডি রথী-মহারথীরা। প্রেক্ষাগৃহ খোলার সংবাদেই তাই স্টারকাস্ট, স্টার ডিরেক্টর, স্টার প্রোডাকশন হাউজ...সবাই মিলে পঙ্গপালের মতন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
কিন্তু ঠিক এখানেই মঞ্চস্থ হয়েছে আরেকটি অন্যরকম ঘটনা। আমরা আগে বহুবার দেখেছি, সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমাগুলো বলিউডের সিনেমার সাথে ক্ল্যাশে যেতো না। সমঝে চলতো। কিন্তু ঠিক এখানেই এবার এসেছে বৈপরীত্য। সাউথের একাধিক সিনেমা এমন আছে, রিলিজ শিডিউলে যাদের সাথে সরাসরি বলিউডের ক্ল্যাশ হবে। যেমন বলা যেতে পারে- কেজিএফ (চ্যাপ্টার টু) এর কথা। ২০২২ এর এপ্রিল এর চৌদ্দ তারিখে সিনেমাটি আসবে প্রেক্ষাগৃহে। ঠিক একই তারিখে আসবে বলিউডের 'ভেড়িয়া।' আবার এ বছরের ক্রিসমাসে আসবে ফাহাদ ফাসিল- আল্লু অর্জুনের 'পুষ্পা (পার্ট ওয়ান)। ঠিক একই দিনে আসবে রনবীর সিংয়ের সিনেমা 'এইটিথ্রি।' এরকম দ্বৈরথের মুখোমুখি হবে অক্ষয় কুমারের 'রক্ষাবন্ধন' এবং প্রভাসের 'আদিপুরুষ'ও।
আগে এরকম হতো, বলিউডের সিনেমার সাথে মুখোমুখি সংঘাতের উপক্রম হলে সাউথের সিনেমাগুলো পিছিয়ে আসতো। সে ন্যারেটিভ ভেঙ্গে সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমাগুলো এবার বেশ আঁটসাঁট বেঁধেই নেমেছে। রণে যে তারা মোটেও ভঙ্গ দেবে না, তা বোঝা যাচ্ছে এখনই। তাছাড়া ওটিটিতে জনপ্রিয়তা এবং সীমিত আকারে খোলা সিনেমাহলগুলোতে গত ক'মাসে যে ব্যবসা তারা করেছে, তা বিবেচনায়, তারা যে এমন যুদ্ধাংদেহী ও আত্মবিশ্বাসী এক অবস্থানে থাকবে তা একরকম অনুমিতই ছিলো। এবং ঠিক এভাবেই মহামারীর কল্যানে 'বলিউড'এর মোড়লপনাকে থোড়াই কেয়ার করা শুরু করেছে ভারতের অন্যান্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। শুরুটা হয়তো সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মের মাধ্যমেই হচ্ছে। তবে অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিও যে ক্রমশই এ যুদ্ধে সামিল হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই মোটেও। এবং সেটাই হওয়া দরকার। ফাঁকা মাঠে গোল আর কত?