'বঙ্গ বব' এর দ্বিতীয় সিজনের প্রথম গল্পে সম্পর্কের জটিলতার যে সুলুকসন্ধান এসেছে, পারিবারিক অবিশ্বাস থেকে সম্পর্কের নাভিশ্বাসকে যেভাবে এ নির্মাণ কানেক্ট করেছে, হালকা বয়ানে, সহজ-সরল বর্ণনায় সেটুকু দেখার জন্যে হলেও এই টেলিফিকশন রেকোমেন্ডেড থাকবে দর্শকের জন্য।

স্ট্রিমিং সাইট 'বঙ্গ' গত ঈদে 'Based on Books' নামের সাত পর্বের যে অ্যান্থোলজি সিরিজ নামিয়েছিলো, সেটা সবদিক বিবেচনাতেই ছিলো দুর্দান্ত একটা কাজ। সাহিত্যের সাথে ভিজ্যুয়াল কন্টেন্টের মেলবন্ধন যদি হয়, তা তো ইতিবাচক লাগেই। পাশাপাশি, যে গল্পগুলো বাছাই করা হয়েছিলো গতবার, সে গল্পগুলোও চমৎকার ছিলো। উপরিপাওনা হিসেবে নতুন কিছু লেখককেও চিনেছিলাম এই প্রজেক্টের সুবাদে। সবমিলিয়ে,  ভালো লেগেছিলো বিষয়টা। ভালো কিছু গল্পের অ্যাডাপ্টেশন এবং নতুন কিছু লেখকের সাথে পরিচয়... একটা প্রজেক্ট থেকে যদি এরকম দারুণ কিছু পাওয়া যায়, তাহলে মুগ্ধ হতেই হয়। মুগ্ধ হয়েছিলামও ঢের। এবং ঠিক সে কারণেই, যখন শুনলাম, 'বঙ্গ বব' এর দ্বিতীয় সিজন আসবে, বেশ আগ্রহী হয়েছিলাম।

যথারীতি, 'বঙ্গ বব' এর দ্বিতীয় সিজন এলো। সিজনের প্রথম নির্মাণও এলো। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ছোটগল্প 'অপরাহ্নের গল্প' অবলম্বনে নুর ইমরান মিঠু 'একটি অলৌকিক বিকেলের গল্প' বানালেন। মনে পড়লো, গত বছরের 'বেজড অন বুক' প্রজেক্টও শুরু হয়েছিলো নুর ইমরান মিঠুর নাটক 'শহরে টুকরো রোদ' দিয়ে। খ্যাতিমান লেখক শাহাদুজ্জামানের ছোট গল্প অবলম্বনে সে নির্মাণ ভালোও লেগেছিলো। হয়তো সে কারণেই নুর ইমরান মিঠুর এবারের নির্মাণ নিয়ে প্রত্যাশা বেশি ছিলো। এবং, মূলত, সে প্রত্যাশাই বিড়ম্বনা হয়েছে। কিভাবে বিড়ম্বনা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসি। এর আগে বরং শুরু করি, মূল গল্পের 'অ-আ-ক-খ' দিয়ে। 

এক অলৌকিক বিকেলের গল্প

গল্প শুরু হয় অজ্ঞাতকুলশীল এক বাসে। যে বাসে সওয়ার হয়ে গল্পের অক্ষরেরা শুরু করে যাত্রা। সিলেটের বিশেষ এক এলাকা দিয়ে যে বাস যেতে থাকে অজানা এক গন্তব্যে। দু'পাশে পর্ণমোচী গাছ, বিস্তীর্ণ চা-বাগান, নাতিদীর্ঘ জঙ্গল, ঝিঁঝিঁপোকা আর সেসবের মাঝখান দিয়ে চকচকে সর্পিলাকার রাস্তা... বাসের সাউন্ড সিস্টেমে শোনা যায় বাংলা সিনেমার পুরোনো গানও- 

জীবনের গল্প, শুরু হলো এইতো! 

'জীবনের গল্প' শুরু হতে না হতেই বাসের গল্প শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ, রাস্তার মধ্যেই বিগড়ে যায় বাস।  বাসের যাত্রীরা নেমে আসেন৷ আশেপাশে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েন। ছড়িয়ে পড়েন মুড়ির মত। এবং ঠিক এ পর্যায়েই, নির্মাণের মূখ্য চরিত্ররা আসেন প্রকাশ্যে। এরাও বাসের যাত্রী। এক নারী, যিনি তার কন্যাসন্তানকে নিয়ে যাচ্ছেন কোথাও, আর এক পুরুষ, যিনি লেখক, যার স্ত্রী মারা গিয়েছে দু'বছর আগে... এই দুই মানব-মানবী গল্পের হাল ধরেন। তাদের মধ্যে খানিক কথাবার্তা হয়। হালকা রসায়নও বোধহয় হয়। অথবা, হওয়ার উপক্রম হয়।

ঠিক এমন সময় প্রেক্ষাপটে উপস্থিত হন তৃতীয় এক চরিত্র। অদ্ভুতুড়ে একজন মানুষ। বজ্রপাতে ঝলসে যাওয়া মুখ আর অদ্ভুত ভবিষ্যৎবাণী করা যার স্পেশালিটি। তবে তার সবচেয়ে স্পেশাল দিক, তিনি মানুষের অতীত এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যা বলেন, তার পুরোটাই নির্ভুল। কিভাবে কিভাবে যেন সবার ঠিকুজিকোষ্ঠী নিয়েই নির্ভুল ধারাভাষ্য দিতে পারেন তিনি। যে ধারাভাষ্যের মুখোমুখি পড়ে এ দুই প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টারও। অদ্ভুত অলৌকিক বিকেলের মরে যাওয়া আলোয় বসে সেই বজ্রাহত মানুষটি বলতে থাকেন অন্যরকম দুটি গল্প। যে গল্পের সাথে নির্মাণের চরিত্রেরা জড়াতে থাকে প্রত্যক্ষভাবে। 

শতাব্দী ওয়াদুদও সেভাবে পেলেন না অভিনয়ের স্কোপ

নির্মাণের মূল যে গল্প, অর্থাৎ, 'অপরাহ্নের গল্প', সে গল্প যদিও অনেকটাই প্রেডিক্টেবল, তবে চাইলে, এই প্রেডিক্টেবল গল্পকে নিয়েও অনেক কিছু করা যেতে পারতো। গল্পবয়ানে খানিকটা চমক রাখা যেতে পারতো। যেভাবে ভিজ্যুয়ালি স্টানিং এক সিনারিও'র মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো নাটক, সে হিসেবে তাই মনেও হচ্ছিলো, নাটক হয়তো জমে যাবে। কিন্তু যে মুহুর্তে বাস থামলো, আয়রনি হিসেবে থেমে গেলো গল্পের চমকও। ক্যামেরার কাজই বলি কিংবা নাটকের কুশীলবদের পরিণতি... সেসব যেভাবে এলো, তা খুব একটা আগ্রহ জাগাতে পারলোনা সেভাবে। পাশাপাশি, প্রচণ্ড স্লো-বার্নিং গল্প হওয়ায়, এই গল্পের সাথে টিকতে গেলে, যে পরিমান ধৈর্য থাকতে হবে, সেটাও বা কয়জন দর্শক রাখতে পারবেন, প্রশ্ন রইলো সেখানেও। 

সর্বসাকুল্যে ৩৫ মিনিটের এ নাটকে চাইলে মেইন ক্যারেক্টারদের আরেকটু স্টাবলিশ করা যেতে পারতো। ফজলুর রহমান বাবু, ফেরদৌস হাসান নেভিল, শতাব্দী ওয়াদুদ, তানজিকা আমিন... এরা প্রত্যেকেই গুণী শিল্পী। কিন্তু তাদের কাউকেই সেভাবে পাওয়া গেলোনা। বিশেষ করে বলতে হয়, ফজলুর রহমান বাবুর কথা। তিনি আরেকটু স্ক্রিনটাইম এবং আরেকটু ভালো স্ক্রিপ্ট পাওয়ার অবশ্যই দাবিদার। তার প্রতিভার সিকিভাগও ঠিকঠাক এলোনা এ নির্মাণে। আসসোস রইলো। আক্ষেপও। 

ফজলুর রহমান বাবু অভিনয়ের স্কোপ পেলেন কম

তবে, এত কিছুর পরেও 'এক অলৌকিক বিকেলের গল্প' দেখা যেতে পারে। সম্পর্কের জটিলতার যে গল্প এ নির্মাণে এসেছে, পারিবারিক অবিশ্বাস থেকে সম্পর্কের নাভিশ্বাসকে যেভাবে এ নির্মাণ কানেক্ট করেছে, হালকা বয়ানে, সাদামাটা বর্ণনায় সেটুকু দেখার জন্যে হলেও 'এক অলৌকিক বিকেলের গল্প' রেকোমেন্ডেড। যদিও সবমিলিয়ে, এ নির্মাণকে নড়বড়েই বলবো। তবে, আশা থাকবে, সামনের নির্মাণগুলো খুব শক্তিশালী হবে। প্রাথমিক নির্মাণজনিত আক্ষেপ ঘোচাবে। শুভকামনা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা