
ব্রেকিং ব্যাড' নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা টিভি সিরিজ। এ বিষয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক হতে পারেনা। সম্ভব না। এবং এটাই শেষ কথা...
যাপিত জীবনের নানা বিতর্কে আমরা প্রতিদিনই অবস্থান নিই ভিন্ন ভিন্ন শিবিরে। রাজনীতি থেকে বিনোদন, ধর্ম থেকে ইতিহাস... আমাদের ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ, পড়াশোনা আমাদের গেঁথে রাখে নির্দিষ্ট সব গণ্ডিতে। বিতর্ক চলতে থাকে। সে সাথে চলতে থাকে আমাদের বাদ-প্রতিবাদ। যেমন এই প্রশ্নটিই ধরা যাক- বিশ্বের সেরা টিভি সিরিজ কোনটি? হলফ করে বলা যায়, এই প্রশ্ন কর্ণকুহরে প্রবেশের সাথে সাথে একেকজন তড়িৎগতিতে ভিন্ন ভিন্ন ছত্রছায়ায় ইতোমধ্যে অবস্থান নিয়ে নিয়েছেন৷ শাণিত করছেন স্বপক্ষের সব যুক্তিবোধ। যাতে তর্ক শুরু হলে আটঘাট বেঁধে প্রস্তুত থাকা যায়।
বিশ্বের সেরা টিভি সিরিজ কোনটি, এই প্রশ্নের একেবারে সোজাসাপটা উত্তর দেয়া খানিকটা শক্ত। কারণ, একেকটা টিভি সিরিজের ন্যারেটিভ স্টাইল, টপিক, ট্রিটমেন্ট স্টাইল ভিন্ন৷ তবে দর্শকদের সন্তুষ্টি, গল্প, চরিত্র, স্ক্রিপ্টের ক্যারিশমা... সবকিছু বিবেচনায় শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হেলে থাকবে ২০০৮ সালে শুরু হয়ে ২০১৩ সালে শেষ হওয়া এক টিভি সিরিজের দিকে। যে টিভি সিরিজ এক রসায়ন শিক্ষকের অথবা এক বাবার অথবা এক ড্রাগ লর্ডের। যে টিভি সিরিজ এক ব্যর্থ প্রেমিকের অথবা এক রগচটা ড্রাগ ডিলারের। হ্যাঁ, ব্রেকিং ব্যাড এর কথাই বলছি।
এমনি এমনি গায়ের জোরে কোনো মন্তব্য আলগোছে ছুড়ে দিচ্ছি না। 'ব্রেকিং ব্যাড'কে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে চূড়ান্ত আসন কেন দিচ্ছে জনগণ, সেটার স্বপক্ষে আছে কিছু যৌক্তিক কারণও।
গল্পের অপ্রত্যাশিত বাঁক
'ব্রেকিং ব্যাড' এর মূল গল্প কিন্তু সাদামাটা, চেকনাই বিবর্জিত। গল্প শুরু হয় কোনো এক স্কুলের এক রসায়ন শিক্ষক কে দিয়ে। যিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। যিনি কিছুদিন পরে মারা যাবেন৷ এমনিতে স্কুল শিক্ষক, লেখাই বাহুল্য, তার যাবজ্জীবন সঞ্চয় বলতে গড়ের মাঠ। বাড়িতে আছে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী, প্রতিবন্ধী ছেলে আর স্ত্রী। তিনি মারা গেলে পরিবার যে অকূলপাথার পড়বে, তা একরকম হলফ করে বলাই যায়৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো। তিনি শুরু করলেন ড্রাগ বানানোর ব্যবসা। যাতে করে মৃত্যুর আগে কিছু টাকা উপার্জন করে পরিবারকে মোটামুটি স্বাবলম্বী করে দেয়া যায়।
এতটুকু পর্যন্ত গল্প কিন্তু সাধারণ গল্পই। এরকম সরাসরি না হলেও কাছাকাছি গল্পের বাংলা সিনেমাও আছে অগুনতি। 'ব্রেকিং ব্যাড' এর গল্প শুরু হয় মূলত গল্পের এই প্রিটাইটেলের পর থেকে। যত বেশি চরিত্র আসা শুরু করে গল্প ততই পেরোতে থাকে, নাটকীয়তা-সাসপেন্স-ক্রাইসিস এবং চমৎকারিত্বের একেকটা সব জংশন।
সিরিজের প্রথম সীজনের প্রথম পর্বে আবির্ভূত গড়পড়তা চেহারার ওয়াল্টার হোয়াইট আর এই মানুষটিই পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয়ে যখন 'হাইজেনবার্গ' হয়ে টাকমাথা আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে আসেন পর্দায়, বোঝা যায়, ব্রেকিং ব্যাড আস্তে আস্তে আস্তিন থেকে বের করতে শুরু করেছে তুরুপের তাস!

নিখুঁত ডিটেইলিং
ঠিক যে দিকটাতে এসে বিশ্ব-নন্দিত 'গেম অব থ্রোন্স', শেষের দুই সীজনে এসে বিশ্ব-নিন্দিত হয়েছে, ঠিক সেই দিকেই বাজিমাত করে দিয়েছে 'ব্রেকিং ব্যাড৷ শেক্সপিয়ারিয়ান 'ফিল্ম নোয়ার' জনরা মাথায় রেখে প্রত্যেকটা সীজন ভাবা, স্ক্রিপ্টে দুই মিনিটের জন্যেও যদি কোনো চরিত্র এসে থাকে, তাকে প্রপার ট্রীটমেন্ট করা, এবং অবশ্যই প্রত্যেকটা ঘটনা, যত তুচ্ছই মনে হোক না কেন আপাতদর্শনে, সেগুলোকে জোড়া জোড়া দিয়ে দিয়ে একটি 'এপিক' বানানোর যে বিশাল কষ্টসাধ্য কাজ, তাতে ভিন্স গিলিগান ও তার টীম যে কতটুকু শ্রম দিয়েছে, তা উপলব্ধি করা যায়।
ডিটেইলিং শুধু গল্পে, চরিত্রে বা ক্যামেরায় থাকবে কেন? ডিটেইলিং আছে এপিসোডগুলোর নামে, বিভিন্ন মেটাফোরে। যেসব চরিত্রগুলো এই টিভি-সিরিজে সেরকম ভূমিকা রাখেনি, তাদের ডায়লগ-মেকআপ, প্রপস... সেগুলোতেও দর্শক লক্ষ্য করেছে ডিটেইলিং এর তীব্র আধিপত্য।
চরিত্র বিশ্লেষণ
'ব্রেকিং ব্যাড' এর সবচেয়ে অভিনব বিষয়, এই টিভি সিরিজের চরিত্রেরা। হাইজেনবার্গ, জেসি পিঙ্কম্যান, স্কাইলার, মেরি, হ্যাঙ্ক, গাস ফ্রিং, মাইক এরমান্ট্রাউট, সল গুডম্যান... প্রত্যেকটা চরিত্র আলাদা করে মনে গেঁথে যায়। এরকম আর কয়টা টিভি সিরিজ আছে, যেখানে চরিত্রগুলোকে এত পারফেক্টলি ইউটিলাইজ করা হয়েছে? ব্রেকিং ব্যাড এর প্রত্যেকটা চরিত্রের ব্যাকস্টোরি আছে। চরিত্রগুলোর স্বকীয়তা আছে৷ চরিত্রগুলোর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম প্যারাডাইমও আছে।
হাইজেনবার্গ ঠাণ্ডা মাথার ম্যানিয়াক। পিঙ্কম্যান মাথাগরম যুবক। স্কাইলার নিজের সংসারের জন্যে যেতে পারে যেকোনো দূরত্বে। যাপিত জীবনে ম্যারি নানা বিড়ম্বনায় বিপর্যস্ত। 'ড্রাগ লর্ড'দের ধরার জন্যে ডিআইএ এজেন্ট হ্যাঙ্ক মরিয়া এক মানুষ। গাস ফ্রিং এর অসম্ভব শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্ব। মাইক এরমান্ট্রাউট এর শীতল চাহনি। সল গুডম্যানের কমিক রিলিফ! এগুলোর পেছনে কত খাটুনি আর কতটা যত্নের মিশেল আছে, সেটা চরিত্রগুলোকে একবার স্টাডি করলেই ধরতে পারার কথা।
দ্বন্দ্বমুখর বাস্তবতা
সত্যি কথা বলতে 'ব্রেকিং ব্যাড' এর হিরো হওয়া উচিত ছিলো- স্কাইলারের। এই লাইন পড়ে অনেক 'ব্রেকিং ব্যাড' ফ্যান চমকে উঠতে পারেন। চমকানোর কথাও। কিন্তু, এ কথার স্বপক্ষে কারণ আছে। কারণ, তিনিই সেই মহিলা, যিনি তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে হেন কোনো কাজ নেই যা করেননি। স্বামীর পেছনে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন। স্বামীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে গর্ভবতী হয়েও সিগারেট খেয়েছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যে পেটে বাচ্চা নিয়ে বাইরে কাজ করেছেন। হাইজেনবার্গ যাতে তার ও সন্তানদের জীবন থেকে চলে যায়, এজন্যে অফিসের বসের সাথে শুয়েছেন। স্বামীর নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। হাইজেনবার্গকে ঘরে নিষিদ্ধ করেছেন। যদিও আমরা, দর্শকেরা, হেগেলের 'কনফ্লিক্ট থিওরি' মেনে এই মহিলার কাজকর্মে বিরক্ত হয়েছি। চড়াও হয়েছি। ক্ষুব্ধ হয়েছি। অথচ, তিনি যা করেছিলেন, সেটাই নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে র্যাশনাল স্টেপ। সেটাই ছিলো প্রাসঙ্গিক।

অথচ, হাইজেনবার্গ যখন 'মেথ' বানিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দেশ থেকে বিদেশে, আমরা খুশি হচ্ছি। তিনি যখন গলার রগ ফুলিয়ে ঘোষণা দিচ্ছেন-
I am not in danger, I am the danger.
আমরা তখন হাততালি দিতে দিতে হাত অবশ করে ফেলেছি। অথচ তিনি কী হিরো? তিনি আপাদমস্তক এক ভিলেন। মানলাম, তিনি পরিবারের জন্যে এসব করছেন। কিন্তু, তিনি যা করছেন, সেটা তো ক্রাইম। অথচ আমরা এই মানুষটির জন্যে উল্লসিত হচ্ছি।
শুটার মাইকের মৃত্যুতে আমরা কষ্ট পাচ্ছি। গাস ফ্রিং এর অ্যাকশনে হাততালি দিচ্ছি। অথচ তারা সবাই-ই ক্রিমিনাল।
এই বিষয়টা 'ব্রেকিং ব্যাড' এর আরেক তুরুপের তাস। দর্শকের 'মোরাল কনসায়েন্স'কে এই টিভি সিরিজ এমন এক প্যান্ডোরার বক্সে ফেলে দেয়, আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। কাকে সাপোর্ট করা উচিত বা উচিত না, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। দর্শকের 'পালস' নিয়ে ছেলেখেলা করার এরকম আরেকটা টিভি সিরিজ দেখাতে পারবেন কেউ? এরকম লম্বা সময় ধরে, দর্শকের 'স্নায়ুদ্বন্দ্ব' বুঝে এভাবে ব্রিলিয়ান্ট ফিনিশিং লাইন টানা আর কোন কোন টিভি সিরিজের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, একটু জানাবেন।
স্রোতের বিরুদ্ধাচারণ
আমি 'ব্রেকিং ব্যাড' দেখা শেষের পরে রীতিমতো অনেকদিন ধরে নিরলস পড়াশোনা করেছি এই টিভি সিরিজ নিয়ে। প্রত্যেকটা চরিত্রকে আলাদা আলাদা করে সূক্ষ্মভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি। এবং আশ্চর্য হলেও লক্ষ্য করেছি, সিজন ফাইভে এসেও চরিত্রগুলোর যে পরিমানে কন্টেন্ট ছিলো, অনায়াসে আরো কয়েক সিজন চালিয়ে দেয়া যেতো।
নাম না বলেই বলছি, আশেপাশে অসংখ্য নামি-দামি টিভি সিরিজের ফ্রাঞ্চাইজি আছে, যারা ছোট ছোট গল্পকে চুইংগামের মতন বড় করে টেনে নিয়েছেন সিজনের পর সিজনে। মানুষজন বিরক্ত হয়েছে। তাও তারা চালাচ্ছে অন্তবিহীন পথ চলা।
'ব্রেকিং ব্যাড' টীম এখানেও দেখিয়েছে অদ্ভুত সংযম। দর্শকদের তুমুল চাহিদা থাকার পরেও মাত্র পাঁচ সীজনে, বাষট্টি পর্বেই শেষ করেছে এই অসাধারণ যাত্রা। কোনো একজন বিখ্যাত লেখক বলেছিলেন,
একজন ভালো লেখকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, সে জানে, কোথায় গিয়ে থামতে হবে।
'ব্রেকিং ব্যাড' এর ডিরেক্টর ভিন্স গিলিগানও বলেন একই কথা। বলেন,
এই টিভি সিরিজ যেখানে শেষ হওয়ার সেখানেই শেষ করেছি। শুধু শুধু লম্বা করার কোনো কারণ ছিলো না। করিওনি৷
চাইলে আরো অনেকগুলো কারণ যুক্ত করা যায় 'ব্রেকিং ব্যাড'কে সর্বকালের সেরা টিভি সিরিজ বলার পেছনে৷ 'বিবি'র গোটা টীম যে কী পরিমাণ মেধাবী ও সময়ের চেয়ে এগিয়ে ভাবতে পারদর্শী, সেটার এক অদ্ভুত প্রদর্শনী 'ব্রেকিং ব্যাড।'

এবার আসি, অন্য এক প্রসঙ্গে। আশেপাশে অনেকেকেই দেখি, যারা 'ব্রেকিং ব্যাড' এর এক-দুই সিজন দেখার পরে আর দেখতে চান নি। স্লো-পেসড ন্যারেশনই তাদের হতাশার কারণ। আমি নিজেও এটা স্বীকার করি, 'বিবি'র প্রথম দুই সীজন ছিলো বেশ ভালোভাবেই স্লো-পেসড। 'লা কাসা ডে পাপেল' এর মতন শুরু থেকেই রোলার কোস্টার গতি নিয়ে এগোয়নি ব্রেকিং ব্যাড৷ কিন্তু যদি আমরা কালজয়ী মাস্টারপিসগুলোর দিকে তাকাই, সেটা 'ওয়্যার অ্যান্ড পিস' হোক অথবা 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' বা 'আন্না কারেনিনা।' এগুলোর প্রত্যেকটারই শুরু শ্লথগতিতে। এবং এই মাস্টারপিসগুলো একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করার পরেই পাঠক/দর্শককে আস্তে আস্তে গ্রাস করা শুরু করে। একজন পাঠক/দর্শকের সক্ষমতার লিটমাস টেস্টও এখানে। আপনি এসব কালজয়ী নির্মাণগুলোর ক্ষেত্রে যদি ধৈর্য ধরে কিছুদূর যান, এমন অসাধারণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন, যেটা কল্পনার অতীত।
'ব্রেকিং ব্যাড' ঠিক এই জনরার। শুরু থেকেই 'ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস' স্পিড পেতে চাইলে, এই টিভি সিরিজ দেখার দরকার নেই। 'ব্রেকিং ব্যাড' এর জন্যে দর্শককে দিতে হবে সক্ষমতার পরীক্ষা। সক্ষমতার পরীক্ষাটুকু উতরে গেলে, বাকিটুকু অদ্ভুত সুন্দর এক অভিজ্ঞতা৷ এবং যদি কেউ পুরো যাত্রাপথটা অতিক্রম করে ফেলে, সেও স্বীকার করতে বাধ্য হবে-
ব্রেকিং ব্যাড'ই নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা টিভি সিরিজ। এ বিষয়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক হতে পারেনা। সম্ভব না। এটাই শেষকথা।