পঙ্কজ ত্রিপাঠী: অভিনেতা, ঋষি কিংবা দার্শনিক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তিনি যখন 'ক্রিমিন্যাল জাস্টিস' এর ধুরন্ধর উকিল হচ্ছেন, আমরা সে উকিলকে মেনে নিচ্ছি। আবার সেই একই মানুষ যখন 'মির্জাপুর' এর ভয়াল গডফাদার হচ্ছেন, একবিন্দু বিচ্যুতি ছাড়াই তিনি মিশে যাচ্ছেন সে খাপেও। 'মিমি' সিনেমার চতুর গাড়িচালক হিসেবেও তাকে 'উচ্ছেদ' করা যাচ্ছে না৷ হৃদয়ে স্থায়ী ঘাঁটি গাড়ছেন 'লুডু' সিনেমার সেই খ্যাপাটে মাস্তান হয়েও...
জাপানের বিখ্যাত লেখক হারুকি মুরাকামির একটা বইয়ে পড়েছিলাম, তিনি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ কফি বানান, রেডিও অন করেন, এরপর লিখতে শুরু করেন। মাত্র দুই পৃষ্ঠা লিখেই কলমের খাপ বন্ধ। আর এক শব্দও অতিরিক্ত লেখেন না। দুই পৃষ্ঠা লেখালেখির কাজ শেষে তিনি এরপর ফিরে যান নিজের অন্যসব কাজে। এরকম অদ্ভুত সংযমে তিনি প্রতিদিন মাত্র দুই পৃষ্ঠাই লেখেন। সপ্তাহের ৭ দিন। বছরের ৩৬৫ দিন।
প্রতিদিনের অভ্যাসমত মুরাকামি এরকমই একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন, ধোঁয়াওঠা কফির কাপ নিয়ে বসে বসে লিখছেন, হঠাৎ রেডিওর দিকে কান গেলো। ঘোষক জানাচ্ছেন- আজ জাপানের বিখ্যাত লেখক হারুকি মুরাকামির জন্মদিন। খবরটায় খানিকটা চমকে গেলেন তিনি। নিজের জন্মদিন, নিজেই ভুলে গিয়েছেন, অথচ মনে রেখেছে গোটা দেশ! মুচকি হাসলেন। খানিকটা লজ্জাও পেলেন। সলজ্জ মুরাকামি এরপর কলম হাতে নিলেন আবার। দুই পৃষ্ঠা শেষ হতে তখনও খানিকটা বাকি। থেমে যাওয়া লেখা শুরু করলেন। খসখস করে এগোতে লাগলো কলম।
হারুকি মুরাকামির মতন এরকম আরেকজন মানুষ আছেন ভারতে। যিনি পেশায় অভিনেতা, কিন্তু যার কথাবার্তায় তাকে মনে হয় দার্শনিক, প্রচুর বই পড়েন, মনোযোগ দিয়ে আশেপাশের মানুষ দেখেন, তাদেরকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। ভারতের এই মানুষটিও নিজের জন্মদিন ভুলে যান মাঝেসাঝে। নিজের জন্মদিন পালন নিয়ে বিব্রত হন। লজ্জা পান। কেউ জন্মদিনের কথা মনে করিয়ে দিলে একগাল হেসে বলেন,
জন্মদিন মনে রেখে কী হবে? জন্মদিনে মানুষের শুভেচ্ছাবার্তার বিনিময়ে কিই বা বলবো? এসব আনুষ্ঠানিকতায় আমি অভ্যস্ত না। জন্মদিনে একটু নিভৃতে থাকবো, পরিবারকে সময় দেবো, এটাই প্রশান্তির। তৃপ্তির।
জন্মদিন নিয়ে নিষ্পৃহ থাকা ভারতের এ অভিনেতার নাম পঙ্কজ ত্রিপাঠী। সারা পৃথিবীতে অজস্র 'ফ্যান' তার৷ অবশ্য তিনি 'ফ্যান' শব্দটির ঘোরতর বিরোধী। তিনি বলেন, 'ফ্যান' শব্দটির বদলে 'যারা আমাকে ভালোবাসে' এই শব্দটি বেশি কাছের, বেশি আপন। যিনি মনে করেন, তার অভিনয় দিয়ে তিনি যদি কাউকে হাসাতে পারেন, সামান্য হলেও শান্তি দিতে পারেন, এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। পরম সার্থকতা। এবং এ কাজে সিদ্ধহস্ত হওয়ার জন্যে তিনি খুব যত্ন করে খেয়াল করেন সবার কথাবার্তা, আচরণ, খুঁটিনাটি। মানুষের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যকে তিনি নিপুণ শিল্পীর মত যুক্ত করেন নিজের অভিনয়েও। স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়েও দুয়েকটি কাজ এমন করেন, মানুষ মুগ্ধ হয়। কতটুকু অভিনয় আর কতটুকুই বা বাস্তব, তার ভারসাম্যে বিব্রত হয় মানুষ, জটিল গোলকধাঁধায় নাকাল হয় সাধারণ সবাই৷
কোথায় জন্ম তার, বিহারের কোন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর চেষ্টায় তিনি যুক্ত হলেন অভিনয় পেশায়, কিভাবে স্ত্রী মৃদুলার সাথে একত্রে কায়ক্লেশের জরাজীর্ণ জাহাজের নাবিক হলেন, সে গল্প সবারই জানা। এ গল্প এমনই বিষাদমাখা, অকারণেই চোখ আর্দ্র হয়। ত্রিপাঠীর জীবন-আখ্যান নিয়ে সিনেমা বানানো হলে সে সিনেমা যে কল্পনার চেয়েও বেশি নাটকীয় হতো, তা ধ্রুবসত্যি৷ এত এত ধাক্কা, এত এত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন বলেই হয়তো মানুষটি ক্রমশ রূপান্তরিত হলেন অন্য কাঠামোতে। কয়লা যেমন প্রবল চাপে অবয়ব পায় হীরকখণ্ডের, তেমনটি উপলব্ধি করি ত্রিপাঠীর ক্ষেত্রেও। যিনি খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা অবস্থাতেও ভোলেন না নিজের অতীত, যার মস্তিষ্কের অনেকটা জুড়েই বিরাজ করে নিজের জৌলুশহীন বাবা-মা, যিনি নিজের স্মৃতি-দেরাজে সযত্নে তুলে রাখেন সেই বিশেষ ট্রাক্টরকেও, যে ট্রাক্টর কেনা হলে পঙ্কজের আজ বলিউডের শীর্ষসারির অভিনেতা হওয়া হতো না৷ হয়তো তিনি থেকে যেতেন বিহারে, হয়তো হয়ে যেতেন ধূলিধূসর পৃথিবীর নিবিড় প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপি। কে জানে!
ত্রিপাঠীর একটা বিশেষ গুণ আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য৷ খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনি যখন 'ক্রিমিন্যাল জাস্টিস' এর সস্তা, ধুরন্ধর উকিল হচ্ছেন, আমরা সে উকিলকে মেনে নিচ্ছি। আবার সেই একই মানুষ যখন 'মির্জাপুর' এর ত্রাসময় গডফাদার হচ্ছেন, একবিন্দু বিচ্যুতি ছাড়াই তিনি মিশে যাচ্ছেন সে খাপেও। 'মিমি' সিনেমার সেই চতুর গাড়িচালক হিসেবেও তাকে 'উচ্ছেদ' করা যাচ্ছে না৷ হৃদয়ে স্থায়ী ঘাঁটি গাড়ছেন 'লুডো' সিনেমার সেই খ্যাপাটে মাস্তান হয়েও৷ একজন অভিনেতা কতটা সম্মোহনী ক্ষমতা নিয়ে এলে এভাবে খাপ খেতে পারেন সব আকৃতিতে, অভিনয়ের আঁকশি দিয়ে আটকাতে পারেন ছেলে-বুড়ো সবাইকে, তার খুব জ্বলজ্বলে এক নিদর্শন পঙ্কজ ত্রিপাঠী। বলা হয়, প্রয়াত বলিউড মায়েস্ত্রো ইরফান খানের চোখ কথা বলতো! পঙ্কজ ত্রিপাঠীর ক্ষেত্রে বিষয়টা আরেকটু সরেস। তার চোখ-নাক-মুখের পাশাপাশি ঘাড়ও কথা বলে। ঘাড় নাচিয়ে কথা বলার যে ট্রেডমার্ক স্টাইল এখন তার অন্যতম জনপ্রিয় সিগনেচার স্টাইলও!

পঙ্কজ ত্রিপাঠীর সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স নিয়ে অজস্র শব্দ দেদারসে ব্যয় করা যাবে। তবে এটাও হয়তো ঠিক, ব্যক্তি পঙ্কজ ত্রিপাঠী ঢের বেশি বর্ণময় রূপোলী পর্দার পরাক্রমশালী পঙ্কজ ত্রিপাঠীর তুলনায়। ত্রিপাঠীর যেকোনো ইন্টারভিউ দেখলে বোঝা যায়, জীবনকে তিনি কতটা ভিন্ন চোখে দেখেন৷ তিনি বলেন, তার করা প্রতিটি চরিত্রই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা রেখে যায় তার মধ্যে। তিনি যখন কোনো চরিত্রে অভিনয় করা শেষ করেন, সে চরিত্র বের হয়ে যাওয়ার পরের শূন্যস্থান তাকে ভোগায় অনেকদিন৷ চরিত্রগুলোর ইট-কাঠ-কঙ্কালকে তিনি এমনভাবে আঁকড়ে ধরেন বলেই চরিত্রগুলো পর্দায় এলে আমরা আর ভ্রম-বিভ্রমের বিভেদের সমীকরণে হাঁটতে পারি না।

এরকম সাবলীল অভিনয় যার, নির্মাতারা তাকে বেশি বেশি চাইবেন, এটাই নিয়তি। পঙ্কজ ত্রিপাঠী ভীষণ কর্মব্যস্ত এ জীবনে এসে তাই খানিকটা আক্ষেপও করেন, স্বগতোক্তি করেন- কেন এত বেশি কাজের চাপ! কেন এভাবে তড়পাচ্ছেন তিনি! তিনি আশা করেন, হাতের কাজগুলো শেষ হবে খুব তাড়াতাড়ি। তিনি আবারও ডুব মারবেন নিজের ভীষণ ব্যক্তিগত জীবনে। এমনিতেও ব্যক্তিজীবন এবং পেশাগত জীবনের মধ্যে একটা সাম্যাবস্থা রাখার চেষ্টা করেন তিনি বরাবরই। তবে বেশকিছু বছর ধরে এই সাম্যাবস্থায় খানিকটা তারতম্য হচ্ছে। বাস্তবতা বুঝে সে বিষয়টি মেনেও নিয়েছেন তিনি। তবুও খানিকটা চাপান-উতোর রয়েই যায়। যে মানুষ হাতে দুই একদিন ছুটি পেলেও কোথাও ঘুরতে চলে যান, ডুবে যান প্রিয় লেখকের কোনো বইয়ে, তার জন্যে এই নিরন্তর কর্মযজ্ঞ খানিকটা অস্বস্তিরও।
ত্রিপাঠীকে অনেকেই মাঝেসাঝে জিজ্ঞেস করেন,
আচ্ছা, আপনাকে যদি মানুষজন ভুলে যাওয়া শুরু করে কখনও, আপনার ভয় লাগবে না?
তিনি এসব প্রশ্নে সবসময়ই হেসে হেসে বলেন-
জীবনের এক বড় অংশে আমাকে কেউ চিনতো না৷ এখন অনেকেই চেনে। হয়তো কয়েক বছর পরে আবার সবাই ভুলে যাবে। এগুলো ভেবে তাই মনখারাপ কেন করবো? মানুষের মনকে তো আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। আমার দায়িত্ব ভালো কিছু কাজ করে যাওয়া। আমি সেটাই করবো। আমি আমার কাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এটুকুই আমার ক্ষমতা।
এরকম নিখুঁত, ছিমছাম চিন্তাভাবনা যার, তার যদি অভিনয়ের ভক্তও কেউ না হয়, তবুও তার চিন্তাচেতনার বিমুগ্ধ সমর্থক হওয়াই যায়। যিনি সবসময়েই বলেন,
আমি প্রতিযোগিতার কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পৃথিবীতে আসিনি। আমি কাজ করতে এসেছি। কাজ করে মানুষকে খুশি করবো, নিজেও দু'মুঠো খাবো। এটুকুই আমার লক্ষ্য।
এরকম বিনা শর্তে, বিনা দাবি-দাওয়ায়, বিনা সঙ্কোচে কিংবা বিনা প্রত্যাশায় জীবনের বৈচিত্র্যকে যিনি গ্রহণ করতে পারেন, সে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর জন্যে মন থেকে ভালোবাসা আসা স্বাভাবিক, এবং স্বয়ংক্রিয় সে অনুভূতি প্রকাশ্যে চলে এলে, তাকে যথোপযুক্ত খাতিরে মর্যাদা না দেয়াও অন্যায়।

এ গুণী অভিনেতার পয়তাল্লিশতম জন্মদিনে তাই গুণমুগ্ধ প্রশংসা ও ভালোবাসা রইলো। পর্দার 'কালিন ভাইয়া' কিংবা 'অনুপ সাক্সেনা'রা নিয়মিত ভিন্ন ভিন্ন অবতারে আসুক দর্শকের সামনে, তাদের কর্মকাণ্ড স্থায়ী, গভীর ছাপ ফেলুক ব্যস্ত করোটিতে, এটাই প্রত্যাশা। সে সাথে এটাও প্রত্যাশা, এক জীবনের মোড়কে বহু জীবন যাপন করা ধ্যানী এই মানুষটি সফলতার বিভিন্ন-বিচিত্র জংশনে নিয়মিত এগোনোর মনোবল রাখুক। 'পঙ্কজ' নামের সমার্থক হিসেবে সরোবরের পদ্মফুলের মতনই রাজত্ব হোক তার, 'অভিনয়' নামক শিল্পের নিখুঁততম শিল্পী হিসেবে নিজের যে মান, সেটাও বজায় থাকুক...নিরন্তর প্রার্থণা সেগুলোও।