অর্থ-বিত্ত-প্রভাব নয়, 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এ গুরুত্ব দেয়া হয় সিনেমাকে, সিনেমার পেছনের প্রেরণা-আবেগ-মস্তিষ্ক'কে। ঠিক সে কারণেই 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এত প্রাসঙ্গিক, এত জনপ্রিয়, এত বছর ধরে ঠিক এই কারণেই কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল টিকে আছে স্ব-মহিমায়...

সাল ১৯৩২। ভেনিসে শুরু হয় বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এই চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীবাসী লক্ষ্য করে, সিনেমার আড়ালে পেশিশক্তির নগ্ন প্রদর্শনী চলছে এখানে। যত সময় গড়ায়, ফ্যাসিস্ট এবং নাৎসি প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর বড়সড় এক মঞ্চে রূপান্তরিত হয় এই চলচ্চিত্র উৎসব; যার সর্বাগ্রে থাকেন দুই কুখ্যাত মহারথী- হিটলার ও মুসোলিনি। তারা ঠিক করে দিতেন উৎসবে কোন সিনেমা দেখানো হবে এবং কোন সিনেমা পাবে পুরস্কার‍। এই চলচ্চিত্র উৎসবে 'জুরি বোর্ড' নামে এক বস্তু থাকলেও, তার কাজ মূলত 'শোপিস' হিসেবে শোভাবর্ধনেই সীমাবদ্ধ। 

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দর্শকদের একাংশ! 

স্বাভাবিকভাবেই এই রামরাজত্ব পছন্দ হয় না বিশ্বের বিভিন্ন দেশের  সিনেমাবোদ্ধাদের। আড়ালে ফিসফিস,  চাপান-উতোর বাড়তে থাকে ক্রমাগত। ১৯৩৮ সালের 'ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল' এ এই অসন্তোষ পৌঁছে যায় চরম পর্যায়ে৷ খুব ন্যাক্কারজনকভাবে সে বছর, হিটলার ও মুসোলিনি মিলে প্রতিযোগিতার প্রধান দুটি পুরস্কার এমন দুটি সিনেমাকে দেন, যে সিনেমা দুটি নগ্ন দলকানা ও পক্ষপাতদুষ্ট'র নির্লজ্জ ও প্রকট উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত হয় সব মহলে। এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট হয় উৎসবে আসা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। 'ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল' বয়কট করেন ফ্রান্স, আমেরিকা ও ব্রিটেনের জুরিরা। তারা এটাও জানিয়ে দেন, এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আর ফিরবেন না তারা! 

না ফেরার সিদ্ধান্ত তো জানালেন। কিন্তু এবার কী করা যায়! ফ্রান্স সিদ্ধান্ত নেয়, তারা তাদের দেশে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুরু করবে৷ ফ্রান্সের ন্যাশনাল এডুকেশন মিনিস্টার তখন জিন জে। তিনি দেশের আরো কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সহায়তায় এবং ইতিহাসবিদ ফিলিপ এরলেঙ্গার এবং ফিল্ম জার্নালিস্ট রবার্ট ফেভরে লে ব্রেট কে সাথে নিয়ে শুরু করলেন 'ইন্টারন্যাশনাল সিনেম্যাটোগ্রাফিক ফেস্টিভ্যাল' নামক এক উদ্যোগের তোড়জোড়। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায় ব্রিটেন এবং আমেরিকা। ফ্রান্সের 'কান' শহরকে নির্ধারণ করা হয় বিশেষ এই সিনেম্যাটোগ্রাফী উৎসবের ভেন্যু হিসেবে। 

এই শহরকে ভেন্যু হিসেবে নির্ধারণ করার পেছনে বেশ কিছু কারণও ছিলো। কান শহর নৈসর্গিক দিক থেকে পর্যটকদের বেশ প্রিয়। তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়, এই চলচ্চিত্র উৎসবের জন্যে তারা শহরের একটি বিশেষ স্থান পুরোপুরি উৎসর্গ করে দেবে৷ সমুদ্রতট ও আশেপাশের স্থানের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী, পর্যটকদের মিলনমেলা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নানাবিধ প্রলোভনে 'কান' হয়ে যায় 'ইন্টারন্যাশনাল সিনেম্যাটিক ফেস্টিভ্যাল' বা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হওয়া 'কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল' এর পার্মানেন্ট ভেন্যু। 

হঠকারিতায় ভরা 'ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'কে উপেক্ষা করার বেশ শক্তপোক্ত এক মঞ্চ তৈরী হয়েছে। 'কান' এর মত দৃষ্টিনন্দন জায়গাকে করা হয়েছে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক সমর্থনও পেয়ে গিয়েছে এ উৎসব...সবকিছু মিলিয়ে বেশ আশাব্যঞ্জক এক ব্যাপার। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৩৯ এর সেপ্টেম্বর মাসে পর্দা উঠবে এই উৎসবের। সিনেমা বাছাই করা শুরু হয়। আমেরিকা থেকে সিনেমা আসে। সোভিয়েত রাশিয়া থেকেও আসে  সিনেমা। বাদ যায় না পোল্যান্ড এবং ব্রিটেনও। সবই অনুকূলে। কিন্তু বিপত্তি হয় অন্যখানে। উৎসব যেদিন শুরু হবে, সেদিনই হিটলার আক্রমণ করে বসে পোল্যান্ডকে। যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের ডামাডোলে মাত্র একটা সিনেমা দেখানোর পরেই স্থগিত হয়ে যায় 'ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল' এর প্রথম উদ্যোগের কর্মসূচি। এই ঘটনার দুইদিন পরেই ফ্রান্স এবং ব্রিটেন, জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফুঁসে ওঠে তাবড় বিশ্ব। 

টানা ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ এ ফ্রান্সের প্রাদেশিক সরকার আবার উদ্যোগী হন চলচ্চিত্র উৎসব মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে। সে বছরে আবার পর্দা ওঠে কান চলচ্চিত্র উৎসবের। আঠারোটি দেশ (সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে; কেউ কেউ বলেন একুশটি দেশ) থেকে বহুরকমের নির্মান আসে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার আলোক ঝলমলে এ মঞ্চে। আয়োজকেরা নির্মানগুলোর মধ্যবর্তী হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের বদলে জোর দেন ভালো নির্মানকে উৎসাহ দেয়ার ব্যাপারে। ফলে ছেচল্লিশ এর উৎসবে নয়টি সিনেমাকে দেয়া হয় এই উৎসবের সর্বোচ্চ খেতাব- গ্রান্ড প্রিক্স দু ফেস্টিভ্যাল! 

ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকটের জন্যে আটচল্লিশ এবং পঞ্চাশ সালে 'চলচ্চিত্র উৎসব' স্থগিত থাকে। তবে কালের নানা চলকে বহু চড়াই-উতরাই পার হওয়ার পরেও এ উৎসব থেমে থাকে না৷ যত সময় গড়ায়, 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এ নানারকম অনুষঙ্গ যুক্ত হতে থাকে, সে সাথে বিশ্বব্যাপী সিনেমাপ্রেমী দর্শক, কুশীলব, নির্মাতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থায়ী আসন দখল করে নেয় এই উৎসব! সময়ের আবর্তে পরিবর্তিত হয় এই চলচ্চিত্র উৎসবের গঠনও। প্রথমদিকে যেমন হাতে গোনা দুয়েকটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয়া হতো এই উৎসবে নমিনেশন পাওয়া সিনেমাগুলোকে, সেখানে এখন অনেকগুলো বিভাগ। আঁ সাতেঁ রিগা, আউট অফ কম্পিটিশন, স্পেশ্যাল স্ক্রিনিংস, মিডনাইট স্ক্রিনিংস, ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট, কান ক্লাসিক, সিনেফোন্ডেশন...নানাবিধ পর্ব। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গুণী নির্মাতা তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' দেখানো হয়েছিলো ২০০২ এর কান চলচ্চিত্র উৎসবের 'ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট' বিভাগে। আবার তরুণ তুখোড় নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহম্মদ সাদ এর সাম্প্রতিক 'রেহানা মরিয়ম নূর' প্রতিযোগিতা করছে 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর এবারের পর্বের 'আঁ সাতেঁ রিগা' বিভাগে। 

'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এ 'রেহানা মরিয়ম নূর' টিম! 

'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর টাইমলাইন যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার, এই চলচ্চিত্র উৎসবের জন্ম, তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ 'ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব' এর বৈষম্যের এক কড়া জবাব দেয়ার জন্যে৷ সুতরাং নিরপেক্ষ থাকার আকাশসম দায় যেমন 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর ছিলো, তেমনি উৎসবের মান বজায় রাখা এবং দেশ-বিদেশের শ্রেষ্ঠ নির্মানগুলোকে পুরস্কৃত করার এক গুরুভারও ন্যস্ত ছিলো তাদের উপরে। এবং সে দায়িত্বে তারা যে পুরোপুরিই সফল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষজন পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চটাই দেখান বরাবর। পক্ষপাতদুষ্ট কোনো কাজ করে নিজেদের উৎসবের গ্রহনযোগ্যতার সাথে আপোষ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তাদের। এই পেশাদারিত্বের কারণেই শুরুর বছরগুলোতে বিস্তর হোঁচট খাওয়ার পরেও তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে আজ চলচ্চিত্র উৎসবের গৌরবজনক এক প্রতিষ্ঠান।

মাঝখানের বছরগুলোতে কিছু স্ক্যান্ডালের সাথে নাম জড়িয়েছে 'কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।' তবে সেগুলোকে সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথেই সামলেছেন তারা। ২০২০ সালে ফ্রান্সে করোনার প্রকোপ তীব্র থাকায় তারা সরাসরি উৎসবের আয়োজন করতে পারেন নি। প্রতিকূল সেই সময়েও তারা থেমে থাকেননি, ফেস্টিভ্যালের অনলাইন ভার্সনের দ্বারস্থ হয়েছেন। গত বছর বছরে করোনার প্রকোপ একেবারে উবে না যাওয়ার পরেও কঠোর পরীক্ষানিরীক্ষা করে এই উৎসবের চুয়াত্তরতম পর্ব সরাসরি মঞ্চস্থ করেছেন তারা। সবাইকে বিস্তর নিরীক্ষা করে এরপর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উৎসবের মূলস্রোতে।

যদিও সেই উৎসবের কয়দিন আগে গুজব উঠেছিলো, কান চলচ্চিত্র উৎসবে  করোনা রোগী পাওয়া গিয়েছে! এই গুজব মিথ্যে প্রমাণ করার জন্যে আয়োজকেরা তিন দিনে নয় হাজার মানুষের করোনা আছে কী না, টেস্ট করিয়ে আকাশকুসুম সে গুজবকে মিথ্যে প্রমাণ করেছেন। সময়ের সাথে এরকম উদ্ভট সমস্যা যত এসেছে , আয়োজকেরা সেগুলো সামলেছেন তুমুল পেশাদারিত্ব নিয়ে। যে পেশাদারিত্ব দেখলে তাদের প্রতি মুগ্ধতা বেড়ে যায়, মুগ্ধতা বাড়াই যেখানে স্বাভাবিক। 

আলোর রোশনাই ঠিকরে পড়ে এ উৎসবে! 

'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর শুরু থেকে যে লক্ষ্য- বিশ্বের ভালো ভালো নির্মানকে সমর্থন দেয়া, এসব নির্মানের প্রচার ও প্রসারের জন্যে চেষ্টা করা, বিশ্বব্যাপী পরিচালক-প্রযোজক-পরিবেশকদের মধ্যে এক সংযোগসেতু ঘটিয়ে দেয়া- সেই লক্ষ্য এখনও অটুট রেখেছে এই উৎসবের সাথে যুক্ত মানুষজন। নিন্দুকেরা প্রায়শই অভিযোগ করেন, 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' শুধুমাত্র বানিজ্যিক উদ্দেশ্যেই সিনেমাগুলোর প্রচারণা চালায়... এ কথাটিও খুব একটা ধোপে টেকেনা। মূল ধারার প্রতিযোগিতার বাইরেও পিছিয়ে পড়া ভালো নির্মান, নতুন নির্মাতাদের দুর্দান্ত শর্ট ফিল্ম- এসবকে উৎসাহিত করার জন্যে এই চলচ্চিত্র উৎসবের বিশেষ একাধিক বিভাগও রয়েছে।

তাছাড়া, সিনেমাপ্রেমীদের জন্যেও তারা নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে বরাবর। ২০১৯ সালের উৎসবে সাধারণ দর্শকদের সাথে তারকাদের মেলবন্ধনের জন্যে এক অভিনব পর্বের আয়োজন করে বিশ্বখ্যাত এই চলচ্চিত্র উৎসব। এছাড়াও উৎসবে আসা দর্শকদের জন্যে সিনেমার মাস্টারক্লাস, এক্সিবিশন, ট্রিবিউট সেকশন রাখা হয়। কান চলচ্চিত্র উৎসব শুধুমাত্র সাম্প্রতিক ও বর্তমান সিনেমা নিয়েই ভাবে না। অতীতের কালজয়ী মাস্টারপিসগুলোও তাদের 'হল অব ফেম' এ স্থান পায় নিয়মিত৷ 

আগত দর্শকদের জন্যেও বিশেষ সব সেগমেন্ট রাখে 'কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল!' 

শেষ করি, 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ কী, সেটা জানিয়ে৷ এই চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত সিনেমার ক্রমবিন্যাস যদি কেউ গভীরভাবে লক্ষ্য করেন, দেখবেন, প্রতি বছরেই 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' তাদের গঠনকে খোলনলচে ভাঙ্গে। সময়ের সাথে সাথে নির্মাতা, দর্শক, চলচ্চিত্রের রকমফের অনুযায়ী শিল্পের নন্দনতত্ত্ব, সৌকর্য ও সুকুমার বৃত্তির যে রূপান্তর; সেটিকেই তুলে ধরে 'কান চলচ্চিত্র উৎসব।' এই উৎসবে কোনো স্বল্পোন্নত দেশের অজপাড়াগাঁ'তে নির্মিত সিনেমাকে দেখানো হয় যে উৎসাহে, ঠিক একই উৎসাহে দেখানো হয় উন্নত কোনো দেশের ঝাঁ চকচকে সিনেমাকে। অর্থ-বিত্ত-প্রভাব না, এই চলচ্চিত্র উৎসবে গুরুত্ব দেয়া হয় সিনেমাকে, সিনেমার পেছনের প্রেরণা-আবেগ-মস্তিষ্ক'কে। ঠিক সে কারণেই 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' এত প্রাসঙ্গিক, এত জনপ্রিয়, এত বছর ধরে ঠিক এ কারণেই 'কান চলচ্চিত্র উৎসব' টিকে আছে স্ব-মহিমায়।  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা