কোনো একটা কন্টেন্ট বানানোর আগেই আমার মাথায় যদি ভাবনা চলে আসে- এটা কি সেন্সরে কেটে দেবে, বা, এটা কি অমুকের অনুভূতিতে আঘাত দেবে, বা, এটা করলে আমি কি কোনো পলিটিক্যাল ঝামেলায় পড়বো, বা, কোনো রিলিজিয়াস ঝামেলায় পড়বো না তো...এসব ভাবনা থাকলেই আমার গল্প আর আসবে না। এবং গল্প বা নির্মাণের শুরুতেই এই ভাবনাগুলো হচ্ছে বলেই, আমাদের ভালো কন্টেন্ট তৈরী হচ্ছে না। হয়ে উঠছে না...

লেখার শুরুতেই মনে পড়ছে সেলিম আল দীন স্যারের কথা। উনি যখন আমাদের ক্লাস নিতেন, আমাদের সাথে নানারকম গল্প করতেন। স্যার যেহেতু সেন্সর বোর্ডেও ছিলেন, সেখানকার নানা অভিজ্ঞতাও গল্পের মধ্যে চলে আসতো। তখন সে গল্পগুলোকে একরকম ইন্টারেস্টিং লাগতো। কিন্তু পরে যখন নাটক-সিনেমায় কাজ করতে আসি, মিডিয়ায় আসি, আস্তে আস্তে কাজ করতে থাকি, তখন স্যারের বলা সেই 'সেন্সর বোর্ড' ব্যাপারটাই আমার কাছে ক্রমশ ঘোলাটে হতে থাকে। ক্রমশই প্রশ্ন আসে মনে, সেন্সরশিপ আসলে কি জিনিস? এটা কেন? এটা কিভাবে কাজ করে?

একটা কন্টেন্ট আমি বানাতে চাই, কিন্তু সে কন্টেন্ট বানাতে যাওয়ার মুহূর্তেই আমাকে ভাবতে হচ্ছে- এই কন্টেন্ট কি আমি বানাতে পারবো? এই কন্টেন্ট বানাতে গেলে কী কী প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি আমাকে হতে হবে? এই কন্টেন্টের প্রতিক্রিয়ায় কারো কোনো অনুভূতিতে কি আঘাত লাগবে? বা, আমি কন্টেন্ট যে এত কষ্ট করে বানাবো, সেই কন্টেন্টকে তো আল্টিমেটলি যেতে হবে 'সেন্সর বোর্ড' নামের অদ্ভুত এক জায়গায়, যেখানে কিছু অদ্ভুত মানুষ বসে থাকবে, যারা ধুপধাপ করে কাঁচি চালিয়ে দেবে, ব্যান করে দেবে, যা খুশি করে দেবে। কেন করে দেবে? তারা কি সিনেমাবোদ্ধা? তারা কি আসলে সিনেমার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা বোঝে? তারা কি ততটুকু কোয়ালিফাইড, যতটুকু হলে একটা শিল্পের গুরুত্ব অতল থেকে বোঝা যায়? 

এরকম এক আক্ষেপের জায়গা থেকেই সে প্রশ্ন উঠে আসে বারবার। কেন 'সেন্সর বোর্ড' নামের একটা জিনিস থাকবে? এবং সেই জিনিসটা কেন শিল্প ও শিল্পীদের উপর কাঁচি চালাবে? বা, প্রশাসন ও প্রশাসনিক আমলারা কেন শিল্পের উপর কাঁচি চালাবে? 

আমার মনে হয়, শিল্পী ও শিল্পচর্চার জায়গাটুকু হওয়া উচিত স্বাধীন। আমার যদি ইচ্ছে হয়, আমি যদি এই রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো খুঁত নিয়ে একটা গল্প লিখতে চাই, নাটক বানাতে চাই, সেটা করতে গেলে আমার মাথায় স্বাধীনতার বিষয়টা থাকতে হবে। আমার মাথায় আগে থেকেই যদি ভাবনা চলে আসে- এটা কি সেন্সরে কেটে দেবে, বা, এটা কি অমুকের অনুভূতিতে আঘাত দেবে, বা, এটা করলে আমি কি কোনো পলিটিক্যাল ঝামেলায় পড়বো, বা, কোনো রিলিজিয়াস ঝামেলায় পড়বো; এসব ভাবনা থাকলেই আমার গল্প আর আসবে না। এবং গল্প বা নির্মাণের শুরুতেই এই ভাবনাগুলো হচ্ছে বলেই, আমাদের ভালো কন্টেন্ট তৈরী হচ্ছে না। হয়ে উঠছে না।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে- 'সাহস' সিনেমার কথা। এ সিনেমা করতে গিয়ে সেন্সর বোর্ডের কাছ থেকে যে পরিমাণ প্রবলেম ফেস করতে হলো, তার প্রতিক্রিয়ায় আমার শুধু এটুকুই মনে হয়েছে - আমি আর সেন্সর বোর্ডের কাছে যেতে চাই না। আমি শিল্পচর্চা স্বাধীনভাবে করতে চাই। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন। এই স্বাধীন শিল্পচর্চা কি আমি করতে পারছি? আমরা কেউ করতে পারছি?  'শনিবার বিকেল' এর মত একটা সিনেমা বহু দিন ধরে আটকে আছে সেন্সর বোর্ডে। অনেক ভালো ভালো সিনেমা এভাবে আটকে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড। আমি যত দূর জানি, এনামুল করিম নির্ঝরেরও একটা সিনেমা, যেটা বহু দিন আগে বানানো, সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে। কেন এসব সিনেমা আটকে রাখা হবে? কেন 'সেন্সর বোর্ড' ছবি আটকাবে? কোন অধিকারে আটকাবে?

শনিবার বিকেল আটকে আছে সেন্সর বোর্ডে

বরং 'সেন্সর বোর্ড' এর বদলে 'সার্টিফিকেশন সিস্টেম' থাকতে পারে। কোনো একটা সিনেমাকে সার্টিফিকেট দেয়া হবে- এ সিনেমা অমুক বয়সের মানুষ দেখবে। অথবা, দেখবে না। সার্টিফিকেট এবং কন্টেন্টেই লিখে দেয়া থাকবে- এ কন্টেন্টে সেক্স, ভায়োলেন্স, ন্যুডিটি আছে কিংবা নেই। কারা এ কন্টেন্ট দেখবে অথবা না, সেটা একান্তই নির্ভর করবে দর্শকের উপরে। কিন্তু সেটা না করে আপনি আপনার ইচ্ছেমত আটকে দেবেন, তাহলে তো হবে না। আপনি বলবেন স্বাধীনতা, অথচ দেবেন না, তাহলে কিভাবে হয়? 'শিল্প'র গণ্ডি কি আপনারা নির্ধারণ করবেন? 

আবার 'সেন্সর বোর্ড' যদি চায়, যেকোনো সিনেমার যেকোনো দৃশ্য কেটে দিতে পারে, নাহলে, রিশ্যুট করতে বলতে পারে। এবার প্রশ্ন আসে- এই রিশ্যুটের জন্যে সেন্সর বোর্ড কি টাকা দেবে? একটা সিনেমা এভাবে আটকানোর ফলে ডিরেক্টর, প্রোডিউসার, হল মালিকের যে সমস্যা হয়, তা কি 'সেন্সর বোর্ড' দেখবে? যদি না-ই দেখে, তাহলে কেন এ বিড়ম্বনা? 

তাছাড়া, যদি বাংলাদেশের 'সেন্সরশিপ আইন' এর কথা বলি, এ আইনটা ১৯৬৩ সালের আইন। অর্থাৎ, পাকিস্তানি আমলের আইন। পাকিস্তান পালটে বাংলাদেশ তো হয়েছে সেই কত আগে! তাহলে, পাকিস্তান আমলের সে আইন কেন এখনও থাকবে? সে আমলে শিল্প ও শিল্পীদের উপরে যে ধরপাকড়, নির্যাতন চলতো, তা যদি এখনও চলে, তাহলে শিল্প ও শিল্পীর সম্মান রইলো কোথায়? স্বীকৃতি কোথায়? এভাবে কি টিকবে কিছু? 

সুতরাং এটাই বলতে চাই, ২০২২ সালের বর্তমান এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে 'সেন্সর বোর্ড' থাকার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করিনা৷ এর বদলে 'সার্টিফিকেশন সিস্টেম' থাকা উচিত।  এবং সেটা থাকা উচিত সমস্ত ক্ষেত্রে। শুধু সিনেমা না। সিনেমা, থিয়েটার, নাটক, ওটিটি, চারুকলা, কারুকলা- সব শিল্পেই সার্টিফিকেশন সিস্টেম থাকা উচিত। এবং সেখানে এমন মানুষজন থাকা উচিত, যারা যোগ্য, যারা ক্যাপাবল। যারা শুধুমাত্র আমলা না। যারা শুধুমাত্র হাত কচলাবে না। এরকম মানুষজন থাকা দরকার, যারা শুধুমাত্রই সরকারকে খুশি করার জন্যে থাকবে না। যারা শিল্পের জন্যে থাকবে।

এরকম অবস্থা যদি হয়, তাহলে হয়তো সুদিন ফিরবে। এবং ঠিক এজন্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারী অনুদানের সিনেমাগুলো হলে চলতে হবে। হল-মালিকদের ব্যবসার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলায় একটা করে সিনেপ্লেক্স থাকতে হবে। 'এফডিসি' নাটকের কথা শুনলে নাক কুঁচকায়। একটা মাধ্যম আরেকটা মাধ্যমকে অবজ্ঞা করে। এসবের তো দরকার নেই। সবাই একসাথেই কাজ করতে হবে। নাহয়, পরিস্থিতি পাল্টাবে না মোটেও।

সে কারণেই মূলত তাই বলতে চাচ্ছি এটাই, বর্তমানের যে সময়, যে গ্লোবাল কনটেক্সট, এ সময়ে দাঁড়িয়ে 'সেন্সর বোর্ড' এর আপেক্ষিকতা এখন আর নেই৷ মোটেও নেই। আমাদের যে কন্টেন্ট আছে, তা দিয়ে পৃথিবী জয় করা সম্ভব। সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে৷ সঠিক মানুষও আমাদের আছে। তাদেরকে স্ব স্ব জায়গায় আনতে হবে। সবাইকে ইউনাইটেড হতে হবে৷ ইন্ডাস্ট্রি বানাতে হবে। প্রফেশনালিজমের জায়গা তৈরি করতে হবে। স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। এবং স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্যে এজেন্সি থাকতে হবে। প্রফেশনাল এজেন্সি টিম থাকতে হবে। নাহলে শিল্পের বিশ্বমানের সাথে পাল্লা দেব কিভাবে আমরা?

আমাদের এফডিসি দেখলেই বোঝা যায়, 'আমরা কেন পারি না'

ক্রেন, ক্যামেরা, এডিটিং প্যানেল, রেইন মেশিন, ডিরেক্টর, প্রোডিউসার, স্কিলড মানুষজন দরকার আমাদের। কী দারুণ দারুণ সব জিনিস নিয়ে কাজ হয় বাইরে। অথচ আমরা? আমরা এখনো সেই মান্ধাতার আমলের জিনিস নিয়ে পড়ে আছি। আপনি বোম্বের ফিল্ম হাউজের দিকে যান, দেখবেন সেখানে আর্ট হাউজ, প্রপস হাউজ, রেইন মেশিন স্টোর, ক্রেইন স্টোর, কস্টিউম হাউজ সব আছে। একটা সিনেমার জন্যে যা যা দরকার, সবই আছে তাদের। অথচ, আপনি এফডিসিতে যান; দেখবেন, মাছের বাজার, চালের আড়ত, রেললাইন, আবর্জনা, এসব। এসবের মধ্যে শিল্প চর্চা হবে কিভাবে? বাইরের ওরা ফিল্ম সিটির মধ্যে পুরো সিনেমার সেট বানাতে পারে। অথচ, আমরা পারি না।

আবার, এখানে যারা কাজ করে, তারা অনেকক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে ওয়াকিবহাল না। তাদের দিয়ে আধুনিক কাজ হয় না। ঠিক এরকম পর্যায়ে দাঁড়িয়েই তাই আমাদের স্কিলড মানুষ লাগবে৷ আর্ট টিম লাগবে। প্রফেশনালিজম বাড়াতে হবে। এসব দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞার দিকে মনোযোগ দিলে হবে না৷ নিষেধাজ্ঞা পরিত্যাগ করে শিল্প ও শিল্পীর মুক্তি হতে হবে। সেটাই দরকার। আমাদের শিল্প ও শিল্পীদের নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে হবে। ভালো কাজ হতে হবে। এবং এসব যদি হয়, আমাদের সিনেমা যদি এভাবেই পজেটিভিটির চর্চা করতে পারে, বিশ্বমানের হতে পারে, তাহলে এটা বলতেই পারি- এ দেশের কন্টেন্ট একদিন পৃথিবী জয় করে দেখাবে। সুতরাং, প্রার্থনা এটাই, আমাদের স্বাধীনভাবে ভাবতে দিন, বলতে দিন, লিখতে দিন। কথা দিচ্ছি, আমরাও হতাশ করবো না৷ 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা