হুমায়ূন আহমেদের নাটক যেন তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল, ছোটখাটো চরিত্রেও কী প্রভাবশালী তার অভিনয়, একটু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেলে তো কোন কথাই নেই! অথচ অভিনয়ের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না, সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য...

তার নামটা ভীষণ অদ্ভুত। কোন বাবা-মা কি নিজের সন্তানের নাম 'চ্যালেঞ্জার' রাখতে পারে? পরে জানা গেল, এই নাম হুমায়ূন আহমেদের দেয়া। প্রথিতযশা এই সাহিত্যিকই তাকে আবিস্কার করেছিলেন, তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে তুলে ধরেছিলেন ক্যামেরার সামনে। বছর আটেকের ছোট্ট ক্যারিয়ারে চ্যালেঞ্জার নামের মানুষটা যে আমাদের কত আপন হয়ে উঠেছিলেন, সেটা আমরা জানি। হুমায়ূন আহমেদের নাটকই যেন তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল, ছোটখাটো চরিত্রেও কি প্রভাবশালী তার অভিনয়, একটু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেলে তো কোন কথাই নেই!

তার ভালো নাম তোফাজ্জল হোসেন সাদেক। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয়টা অন্যপ্রকাশ প্রকাশনীর মাজহারুল ইসলামের মাধ্যমে। তার প্রেসে অন্যপ্রকাশের বইয়ের কভার ছাপানো হতো। সেই সূত্রেই হুমায়ূন আহমেদের বাসায় তার যাতায়াত। হুমায়ূন আহমেদ তখন 'ওল্ড ফুলস ক্লাব' নামের একটা বোকা সংঘ খুলে বসেছেন, তার বাসায় ভরপুর আড্ডা হয়। কখনও আবার ক্লাবের সদস্যেরা কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেন, পরচর্চা করেন। সেই ক্লাবের সদস্য হবার প্রথম শর্ত ছিল, উপস্থিত সদস্যদের সামনেই তাদের নামে পরচর্চা করতে হবে। 

সেরকম এক আড্ডাতেই সাদেক নামের মানুষটার সঙ্গে প্রথম দেখা হুমায়ূন আহমেদের। হুমায়ূন ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি, তাকে ঘিরে থাকতো সবাই, যেমন সূর্যকে ঘিরে থাকে বাকী গ্রহ-উপগ্রহগুলো। হুমায়ূনের কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে তার ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন সাদেক, সেবারই প্রথম ভালোভাবে তাকে নোটিশ করেছিলেন গল্পের জাদুকর। 

তোফাজ্জল হোসেন সাদেকের চ্যালেঞ্জার হবার গল্পটাও বেশ মজার। এই নাম দিয়েছিলেন অবসর প্রকাশনার মালিক আলমগীর রহমান। বিশেষ এক তরল পদার্থ গলাধঃকরণের আসর বসেছিল। সেই আসরেই আলমগীর রহমানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সাদেক। আট গ্লাস তরল গিলে বমি করা শুরু করলেন আলমগীর, এদিকে সাদেক তার নবম গ্লাসটা শেষ করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো, যেন এটা কোন ব্যাপারই না! 

অভিনয়ের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তার

সেদিনই আলমগীর রহমান সাদেকের নতুন নাম দিলেন- চ্যালেঞ্জার! আড্ডায় উপস্থিত কেউই হয়তো জানতেন না, এই নামটা দেশের মানুষের কাছে এত বেশি বিখ্যাত হয়ে যাবে যে, মানুষটার আসল নামটা আর কেউ জানার চেষ্টাও করবে না! অথচ একটা সময়ে এই মানুষটার পকেটে টাকা থাকতো না, পড়াশোনাও শেষ করতে পারেননি টাকার অভাবে। ক্ষিদের জ্বালা চাপিয়ে রাখতে ভাই-বোনদের নিয়ে রং চা খেয়ে রাত কাটাতেন, কারণ রং চা খেলে ক্ষিদে নষ্ট হয়ে যায়! 

তিন ভাই দুই বোনের সংসারে তিনি ছিলেন সবার বড়। অভিনয় বা শিল্পচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না সেভাবে, পরিবারের ভার এসে পড়েছিল কাঁধে, সেটা সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করা চ্যালেঞ্জার জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন ১৯৭৮ সালে, আট বছরের প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে জড়িয়ে পড়েন প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে। জীবনভর সংগ্রাম করেছেন মানুষটা, পায়ের নিচে এক টুকরো শক্ত জমিনের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-দেশান্তরে। পরিবারের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে নিরন্তর কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। 

চ্যালেঞ্জারের নাটকে আসার গল্পটা আরও ইন্টারেস্টিং। স্ত্রী ঝর্ণার খুব ইচ্ছে, কিভাবে নাটকের শুটিং হয় সেটা দেখবেন তিনি। চ্যালেঞ্জার তার স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন নুহাশ পল্লীতে, সেখানে 'হাবলঙ্গের বাজার' নামে একটা নাটকের শুটিং করছেন হুমায়ূন আহমেদ। একটা দৃশ্যে অভিনেতা এজাজুল ইসলামের চুল কেটে দেয়ার কথা এক নাপিতের। শট নেয়ার আগে দেখা গেল, নাপিত চরিত্রের কাউকে আনা হয়নি! হুমায়ূন আহমেদের চোখ পড়লো চ্যালেঞ্জারের দিকে, তাকে ডেকে বললেন- 'তুমি তো সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও। এসো, নাপিতের চরিত্রে অভিনয় করো।' 

চ্যালেঞ্জার আকাশ থেকে পড়লেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, 'স্যার, আপনি যা করতে বলবেন তা-ই করব। মাটি খেতে বললে মাটি খাবো। কিন্ত অভিনয় করতে পারব না।' হুমায়ূন আহমেদ জেদি মানুষ, সেই জেদকে উপেক্ষা করার শক্তি চ্যালেঞ্জারের ছিল না, কারোই ছিল না হয়তো। ছোট্ট একটা ক্ষুর নিয়ে তিনি দাঁড়ালেন ক্যামেরার সামনে। চমৎকার অভিনয় করলেন, স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদই মুগ্ধ হয়ে গেলেন চ্যালেঞ্জারের পারফরম্যান্সে! 

চ্যালেঞ্জারকে নিয়ে এক ঘন্টার একটা নাটক বানালেন হুমায়ূন আহমেদ, নাটকের নাম খোয়াবনগর। সেখানে অভিনয় করলেন করলেন হুমায়ূন কন্যা শীলা। শুটিঙের এক ফাঁকে মেয়েকে হুমায়ূন জিজ্ঞেস করলেন, 'বাবা, এই নতুন অভিনেতার অভিনয় তোমার কেমন লাগলো?' শীলা জবাব দিলেন- 'খুবই ভালো।' হুমায়ূন আহমেদ বললেন, 'খুব ভালো কোন কোন কাজের কথা না। আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে তুলনা করো।' শীলা বললেন, 'উনার অভিনয় প্রতিভা কোনোভাবেই আসাদুজ্জামান নূর চাচার চেয়ে কম না।' 

চ্যালেঞ্জারকে ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের নাটক অসম্পূর্ণ মনে হতো

চ্যালেঞ্জারের অভিনয়প্রতিভার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হয়ে আছে 'উড়ে যায় বকপক্ষী' নাটকটা। দোতারা চাচা বা ফজলু মিয়া'র ভূমিকায় তার অনবদ্য অভিনয়টা এখনও চোখে ভাসে। পাগলাটে মানুষটা জানেন তার মাথায় সমস্যা আছে, কিছুক্ষণ তিনি ভালো থাকেন, ক্ষণিক বাদেই আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলেন, ছুটে যান জ্বিনের বাদশা'র খোঁজে। 

বিপরীতমুখী চরিত্রের এই অদ্ভুত ট্রান্সফরমেশনটা দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এই মানুষটা অভিনয়ের কোনরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন। পাগলের সঙ্গে বোনকে সংসার করতে দেবে না- এই যুক্তিতে তার স্ত্রীর আরেক জায়গায় বিয়ে ঠিক হবার সংবাদ শোনার পরে কয়েক মিনিটে তার যে বোবা চাউনি, নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর জোর চেষ্টা- সেটা দেখে কে বলবে এই লোক মেথড অ্যাক্টর নন! দারুচিনি দ্বীপ সিনেমাতেই যেমন তার কোমলতা আর কঠোরতা মিশে থাকা বাবার চরিত্রটা কখনও আমাদের মনে বিরক্তির উদ্রেক করে, কখনও আবার অদ্ভুত এক মায়ার জন্ম দেয়।

ব্যক্তিজীবনে চ্যালেঞ্জার ভীষণ ইমোশনাল মানুষ ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে একবার চীনে ঘুরতে গেছেন স্ত্রীকে নিয়ে, সেখানেই হংকঙের ডিজনিল্যান্ডে গেলেন তারা। ডিজনিল্যান্ডের কাণ্ডকারখানা দেখে চ্যালেঞ্জার বিস্মিত। সবাই বসে আছেন বিখ্যাত 'কার্টুন ক্যারেক্টার শো' দেখবেন বলে। শো শুরু হতেই চ্যালেঞ্জার হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। কারণ জিজ্ঞেস করায় বললেন, 'এত সুন্দর একটা দৃশ্য আমার বাচ্চা দুটি দেখতে পাচ্ছে না। তাদের নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্ত টিকিটের টাকা জোগাড় করতে পারিনি। এই দুঃখে আমি কাঁদছি।' 

চ্যালেঞ্জার কত ভালো অভিনেতা ছিলেন, সেটা হয়তো পরিমাপ করা সম্ভব। কিন্ত তিনি যে অসম্ভব রকমের ভালো একজন মানুষ ছিলেন, সেটার পরিমাপ বের করা সম্ভব না। যে সৎ মায়ের হাতে তিনি অত্যাচারিত হয়েছেন, ভাই-বোনদের নিয়ে ঘর ছেড়েছেন, সেই মহিলাকেই তিনি পরে নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছেন, মায়ের মতো সম্মান করেছেন জীবনের বাকী দিনগুলোতে। স্রষ্টা নাকি ভালো মানুষদের খুব দ্রুত তার কাছে ডেকে নেন। চ্যালেঞ্জারের বেলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বেশ কিছুদিন মস্তিস্কের ক্যান্সারে ভোগার পর মাত্র ৫১ বছর বয়সে, ২০১০ সালের ১৩ই অক্টোবর অন্য ভূবনে পাড়ি জমান তিনি। 

অভিনেতা হিসেবে চ্যালেঞ্জারের অভিষেক যে নাটকে হয়েছিল, সেটার নাম 'হাবলঙ্গের বাজার'। শব্দটা একটা মেটাফোর, এটার মানে 'শেষ বিচারের দিন', বা হাশরের দিন। যেদিন সব পাপ-পূন্যের হিসেব নেয়া হবে। আমি জানিনা চ্যালেঞ্জারের পাপের পাল্লা ভারী হবে, নাকি পূণ্যের। এই মানুষটা আমাকে তার অভিনয় দিয়ে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, মন ভালো করেছেন, মন খারাপও করে দিয়েছেন। তার কাছে আমার খানিকটা ঋণ জমা আছে। যদি সম্ভব হয়, হাবলঙ্গের বাজারে গিয়ে সেই ঋণ আমি শোধ করতে চাই, যদি কোন পূণ্য অর্জন করে থাকি, সেখান থেকে খানিকটা অংশ আমি চ্যালেঞ্জারকে দিয়ে দিতে চাই...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা