হাস্যরস নিয়ে তো অনেকেই সিনেমা করেছে, রঙ্গশালার নায়ক তো অনেকেই, তবে চার্লিকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? কারণ চার্লি একই সাথে হাসিয়েছেন এবং কাঁদিয়েছেন। শুধু হাসিয়ে কেও চার্লি হতে পারে না, আমরা চার্লির হাসির কথা মনে রাখলেও তার সিনেমার বেদনার দিকটা যেন ভুলে না যাই, কারণ এই একটা জিনিসই চার্লিকে বাকি সবার থেকে আলাদা করেছে...

১৮০০ শতকের লন্ডন।

লন্ডনের ইস্ট লেনের থিয়েটার হলটা সন্ধ্যার পরই অসংখ্য মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয় প্রতিদিন। শ্রমিক, ভবঘুরে বা মদ্যপ প্রকৃতির মানুষের ভিড়ই এখানে বেশি দেখা যায়। সারাদিনের ক্লান্তি থেকে একটু দূরে থাকতে, একটু আনন্দে সময় কাটাতে এখানে ছুটে আসে তারা। থিয়েটার হলের নর্তকীদের নাচ বা গানই তাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। নিজেদের কষ্টের পয়সার বিনিময়ে একদম নিখাদ বিনোদন চায় তারা, কোন কারণে নর্তকী না গায়িকা একটু ব্যর্থ হলেই তার আর রক্ষে থাকতো না, চেঁচামেচি আর বিকৃত স্বরে অপমান চলতে থাকতো। থিয়েটারের হলে সেদিন গান গাচ্ছিলেন হানা চ্যাপলিন নামের এক মহিলা যিনি তার সুন্দর কণ্ঠের জন্য ইতিমধ্যেই দর্শকদের কাছে অনেক বেশি পরিচিত। হানা একা আসেন নি সেদিন, সঙ্গে করে তার পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, ছেলের বায়না ছিল সে নিজের মায়ের গান দর্শকদের সাথে উপভোগ করবে।

হানা শুরু করলেন। অদ্ভুত সুন্দর সেই গানের গলা। সকলে একদম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। কারো জানা ছিল না, এই সুন্দর কণ্ঠকে প্রতিদিন কতটা যুদ্ধ পাড়ি দিয়ে আসতে হত।মদ্যপ স্বামীর সাথে প্রতিদিন ঝগড়া হত তার। স্বামী মদ খেয়ে এসে বলতেন- আমার দ্বারা সংসারের কোন খরচ দেয়া সম্ভব না। এর সাথে চলত সমানে খিস্তি খেউর। হানা বরাবরই চুপ থাকতেন, কিন্তু নিজের ভেতরে ক্রমেই জমতে থাকা এই কষ্ট তাকে যে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিল- সেটা তিনি অনেক পরে জানতে পারেন। ল্যারেনজাইটিস নামক এক গলার রোগে ততদিনে বেশ ভালভাবেই আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। খুব বেশিক্ষণ গান করলে বা খুব বেশি টান দিয়ে গলায় এতটাই ব্যথা শুরু করে, সেই গলা দিয়ে আর কোন ধরনের স্বর বের হয় না।

সেটাই হল সেদিন, সুন্দর কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেল! গলা থেকে স্বর বের করার অনেক চেষ্টা করেও পারলেন না হানা। সারাদিন বহু কষ্টে জোগাড় করা পয়সা দিয়ে টিকেট কিনে বিনোদন না পেয়ে মানুষগুলো আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো। নিজদের বসে থাকা চেয়ারে বারবার থাবা দিয়ে কুকুর বিড়ালের ডাক অনুকরণ করতে লাগলো। লজ্জা আর অপমানে হানা কাঁদতে কাঁদতে স্টেজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ম্যানেজার এসে দুই হাত তুলে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ততক্ষণে জুতার বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে।ম্যানেজার মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েই উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হানার পাঁচ বছরের ছেলের সাথে ধাক্কা খেলেন। হানার সাথে পরিচয়ের সূত্রে ম্যানেজার জানতেন, হানার এই ছেলে বয়সে ছোট হলেও, ইতিমধ্যেই নাচ গান আর মূকাভিনয় রপ্ত করে ফেলেছে সে। পাঁচ বছরের ছেলেটি কিছু বোঝার আগেই তাকে অনেকটা জোর করে স্টেজের মাঝে নিয়ে যাওয়া হল আর ম্যানেজার বললেন- আপনারা থামুন! আপনাদের পয়সা বৃথা যাবে না, এই ছেলেটিই এখন আপনাদের গান গেয়ে শোনাবে!

পাঁচ বছরের ছেলে যার মা কিছুক্ষণ আগেই গলার তীব্র যন্ত্রণায় স্টেজ ত্যাগ করেছে আর যারা বাবা এতটাই মদ্যপ যে তারসাথে তার বাবার প্রায় দেখাই হয়না, সেই ছেলেটার হঠাৎ করে স্টেজে আসার ব্যাপারটা বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল, কিন্তু সাহস হারায়নি ছেলেটি। তার মা যেই গানটি গাইছিল, সেই “জ্যাক জোন্স” গানটিই সে গাওয়া শুরু করল। শুধু গানে তার ভাল লাগছিল না সম্ভবত, গানের সাথে নাচও শুরু করে দিল। ইস্ট লেনের থিয়েটারের দর্শকেরা কখনও পাঁচ বছরের কোন ছেলেকে শরীর দুলিয়ে নাচতে আর গাইতে দেখে নি এর আগে এভাবে! মুগ্ধ দর্শকেরা সমানে তালি দিতে থাকল, সেই তালিতে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড় সবার! আর সেই সাথে খুশি হয়ে তারা পয়সা ছুঁড়তে লাগলো মঞ্চের উপরে, পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটি গানের আর নাচের তালের সাথে সাথেই পয়সা কুঁড়োতে থাকল। সেদিনের সেই মানুষগুলো জানত না, আগামি প্রায় ৬০ বছর এই পাঁচ বছরের ছেলেটি তাদের একই সাথে আনন্দের আর দুঃখের সাগরে ভাসাবে।

১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল সেই পাঁচ বছরের ছেলের জন্ম। বাবা মা দুইজনেই ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা। মা হানা চ্যাপলিন পূর্বে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন, সেই ঘরে একটি সন্তান ছিল যার নাম ছিল সিডনি। আর যেই পাঁচ বছরের ছেলের কথা বলছি, নিঃসন্দেহে তার নাম চার্লি চ্যাপলিন। পুরো নাম স্যার চার্লস স্পেন্সার চার্লি চ্যাপলিন। ১৮৮৯ সালটি অনেক অদ্ভুত রকমের একটি সাল। চার্লির জন্মের চারদিন পরে লন্ডন থেকে প্রায় হাজার মাইল পূর্বে জার্মানিতে চার্লির মতই দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন আরেক শিশু, যার নাম হিটলার। আবার এই বছরই আমেরিকায় টমাস আলভা এডিসন ফিল্মের ক্যামেরা তৈরি করলেন-এইসব কাকতালীয় ঘটনা কেন বলছি, সেই কারণে যথাসময়ে ফেরত আসা হবে। আপাতত আমরা চার্লি চ্যাপলিনের ছোটবেলায় ফিরে যাই। 

চার্লি চ্যাপলিন

চার্লির বাবা চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র উচ্ছৃঙ্খল ও মদ্যপ ছিলেন, এরপরেও তিনি প্রায় সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। নিজে গান লিখতেন আবার নিজেই সেই গানে সুর দিয়ে গাইতেন। কিন্তু শুধু গান গেয়ে সংসার চালানোর মত আর্থ সামাজিক অবস্থা তখনকার ইংল্যান্ডের মানুষের ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই চার্লস তার সব টাকা উড়াতেন মদের আড্ডায়। চার্লির বয়স যখন ছয়, তখন তার বাবা লিভার সিরোসিস এর মত কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন। যেই ধরনের জীবন তিনি যাপন করতেন, তাতে এই রোগে আক্রান্ত হওয়াতে কেও অবাক হয়নি! টমাস হাসপাতালে ভর্তি করা হল বটে, কিন্তু বাবার অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকল।

নিজের চোখের সামনে নিজের বাবার এত কষ্ট ছোট চার্লির সহ্য হল না। তার বাবার বিছানার পাশের জানালার নিচে সারারাত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। লন্ডনের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা আর রাতের ঘন অন্ধকারের মাঝে ছোট্ট একটি বাচ্চা সারারাত না ঘুমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু বাবার রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছে আর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে- এই দৃশ্য হয়ত যেকোনো পাষাণের চোখেও পানি নিয়ে আসবে। কিন্তু কোন কিছুতে লাভ হল না শেষ পর্যন্ত, সকালের আলো ফোটার পর নার্সের কাছ থেকে সে জানতে পারল, তারা বাবা মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই তাদের ত্যাগ করে অনেক দূরে চলে গেছেন যেখান থেকে তিনি আর ফিরবেন না। খবরটা শোনার পর থেকে চার্লি আর কাঁদতে পারেননি, দুঃখ শোক আর সামনের দিনের অনিশ্চয়তায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং সম্ভবত নিজেকে বলেছিলেন- প্রার্থনায় কোন কাজ হয়না।

বাবার মৃত্যুর পর চার্লি আর তার সৎভাই সিডনিকে একটি অনাথ আশ্রমে পাঠানো হল। কিন্তু অনাথ আশ্রম থেকে কিছুদিন পরেই বের হয়ে দুই ভাই রাস্তায় আর বিভিন্ন মিউজিক হলে নাচ গান আর অভিনয় করে পয়সা উপার্জন শুরু করল। মাকে দুই ভাইই প্রচণ্ড ভালোবাসতো, সবসময় মাকে আগলে রাখত, সম্পর্ক ‘সৎভাই” হলেও, নিজেদের মধ্যে তাদের সম্পর্ক আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভাল ছিল। তবে ভাগ্যদেবীর হাত থেকে তাদের মাও রেহাই পান নি। কঠিন একটি অসুখ ছিল তার যার কারণে তিনি মাঝে মাঝে সাময়িক সময়ের জন্য পাগল হয়ে যেতেন। হানা চ্যাপলিন যখন হাসপাতালে সময় কাটাতেন, তখন দুই ভাই রাস্তায়, পার্কে, বাজারে ভিখারি বা ভবঘুরেদের মত জীবন কাটাতে বাধ্য হতেন। দারিদ্র্যের কঠোর আর পৈশাচিক রূপটি অনেক ছেলেবেলাতেই চার্লি দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে, ফিল্মের ভাষায় যাকে বলে একদম “ক্লোজ শট” থেকে। সারাদিন না খেয়ে রাস্তায় ঘুরছেন, অনেকসময় নাচ গান করেও পয়সা জুটছে না, কুকুর বিড়ালের মত আওয়াজ করেও লাভ হচ্ছে না। ডাস্টবিনের ফেলে দেয়া খাবার খাচ্ছেন, অনেকসময় কুকুরের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে খাবার খাচ্ছেন- এমন অদ্ভুত কষ্টেই কেটেছে চার্লির শৈশব আর কৈশোর।

এরমাঝে চার্লির পরিচয় হয় ফ্রেড কার্নোর সাথে ১৯০৫ সালে। ফ্রেড কার্নো সেই সময়ের একজন নামকরা অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক ছিলেন। ভাই সিডনির মাধ্যমেই এই পরিচিত ঘটেছিল। প্রায় সাত বছর চার্লি কার্নোর দলে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে ১৯১০ সালে আমেরিকাতে আসেন। আমেরিকাতে আসা চার্লি এবং আমেরিকা- দুইজনের জন্যই সৌভাগ্যের প্রতীক ছিল বলতে গেলে। এই বছরের অক্টোবরের তিন তারিখে নিউইয়র্কের কলনিয়াল থিয়েটারে প্রথম নিজের অভিনয় প্রতিভার মাধ্যমে দর্শকদের মুগ্ধ করেন চার্লি। চার্লির চাহিদার কারণে তার বেতন ততদিনে বেশ ভাল করেই বাড়ছিল, ৫০ ডলার প্রতি সপ্তাহে। তিন বছর আমেরিকায় থেকে ইংল্যান্ডে চলে আসলেন তিনি ১৯১৩ সালে।

এই বছরই গ্রীষ্মে তিনি আবার আমেরিকাতে আসলেন। বিখ্যাত পরিচলক ডি ডব্লিউ গ্রিফিথের ছাত্র পরিচালক ম্যাক সেনেটের সাথে তার পরিচয় হল। তিনি চার্লিকে সিনেমাতে অভিনয়ের আমন্ত্রণ জানালেন। সাথে এও বললেন, টাকার অঙ্কে তিনি লন্ডনের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাবেন ম্যাকের কিস্টোন কোম্পানিতে কাজ করলে, প্রায় তিনগুন বেশি। অর্থের পরিমাণ বেশি সেটা ঠিক আছে, কিন্তু “সিনেমা” জিনিসটা সম্পর্কে তার কোন আইডিয়া ছিল না, মাত্র না জন্ম তখন সিনেমা নামের শিশুর! এই শিশুকে সামলাতে পারবেন তো তিনি? ভবিষ্যৎ নিশ্চিত থাকবে তো? সেই পুরনো কার্নো দলের ম্যানেজারের সাথে আলাপ করলেন তিনি, ম্যানেজার তাকে আশ্বস্ত করলেন আর বললেন আমেরিকাতে চলচ্চিত্রে কাজ করতে। কিন্তু তখনও কার্নো কোম্পানির সাথে চার্লির কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়নি। তিনগুণ পারিশ্রমিকের কথা শুনে চার্লি তার পুরনো কোম্পানিকে ভুলে যাননি। ১৯১৩ সালের ২৮ নভেম্বরে কার্নো কোম্পানির সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ করেই তিনি রওনা দিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে, কিস্টোন কোম্পানির সাথে কাজ করতে। একদিকে তখন তরুণ চার্লির মনে কার্নো কোম্পানিকে ছেড়ে আসার দুঃখ, অন্যদিকে অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বেশ কিছুটা চিন্তার রেশ।

এই চিন্তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। চার্লি চ্যাপলিন মাত্র কয়েক বছরের মাঝে যেই পরিমাণ জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহল থেকে অর্জন করেছিলেন, তার অর্ধেক বেশিরভাগ শিল্পী সারা জীবনেও অর্জন করতে পারেন না। চার্লির ক্রমাগত বাড়ন্ত পারিশ্রমিকের একটা ছোট্ট নমুনা দেখা যাক-

১৯১৩ – ৫০ ডলার প্রতি সপ্তাহে

১৯১৪- ১৭৫ ডলার প্রতি সপ্তাহে

১৯১৫- ১২৫৫ ডলার পরতি সপ্তাহে এবং ১০০০০ ডলার বোনাস

১৯১৬- ৫০০০ ডলার প্রতি সপ্তাহে

১৯১৬-১০০০০ ডলার প্রতি সপ্তাহে এবং ১৫০০০ ডলার বোনাস

১৯১৮- ১০০০০০০ ডলার প্রতি সপ্তাহে এবং এবং ১৮ মাসের জন্য সঙ্গে ১৫০০০ ডলার বোনাস

চার্লি চ্যাপলিনের গড়পড়তা আয় ছিল তখন বছরে ৬৬৭০০০ ডলার। শুধু এই কয়েকবছরে না, চার্লির এই দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা ছিল পরবর্তী দুই দশক ধরে। আরেকটা মজার তথ্য শেয়ার করি, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বেতন পেতেন চার্লির পারিশ্রমিকের সাত ভাগের এক ভাগ! নিউইয়র্কে একটি সিনেমা হল ছিল যার নাম ক্রিস্টাল হল, ১৯১৪ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত এই হলে আর কারো সিনেমা চলেনি- শুধু চার্লি চ্যাপলিনের জন্য বরাদ্দ ছিল এই সিনেমা হল- এই ছিল তার জনপ্রিয়তার ছোট্ট একটি নমুনা।এক জরিপে দেখা যায়, চার্লি চ্যাপলিনের যেকোনো একটি সিনেমার দর্শক সংখ্যা সারা পৃথিবীতে তিন কোটি তিন লক্ষ। চ্যাপলিনের সিনেমা সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশে কোন না কোন সময় প্রদর্শিত হয়েছে। সারা পৃথিবী চার্লির দর্শক, সারা পৃথিবীর মানুষকে তিনি ছুঁতে পেরেছেন এক আশ্চর্য জাদুবলে। শতবার দেখলেও এই জাদুর মায়া কাটে না। কিন্তু কীভাবে আসলো এই জনপ্রিয়তা? কি এমন ছিল তার মাঝে? ফেরা যাক সেই গল্পে।

১৯১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মেকিং এ লিভিং নামের সিনেমার মুক্তির মাধ্যমে চার্লির ফিল্ম ক্যারিয়ারের শুরু হয়। ব্যবসায়িকাভাবে সিনেমাটির অবস্থা তেমন ভাল না হলেও, চার্লির অভিনয়ের তুমুল প্রশংসা হয়েছিল, পত্র পত্রিকায় তাকে নিয়ে অনেক লেখা বেরিয়েছিল। তখনকার কিস্টোন কোম্পানির সিনেমাতে পাত্র পাত্রীদের নাম উল্লেখ করা হত না সিনেমা দেখানোর সময়, এই কারণে পত্র পত্রিকা চার্লির নাম উল্লেখ করতে গিয়ে কেও লিখল চ্যাপম্যান, কেও চ্যাটলিন, আবার কেও এডগার ইংলিশ। কিস্টোন কোম্পানির ৩৫ টি সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন চার্লি, ১৩টিতে অভিনয় করেছিলেন নিজের পরিচালনায়, পাঁচটিতে তিনি যুগ্মভাবে পরিচালক ছিলেন আর ১৭টি ছিল তার নিজস্ব রচনা আর পরিচালনায়।

তার অভিনীত দ্বিতীয় সিনেমা কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস সিনেমাতে প্রথমবারের মত তিনি তার সেই বিখ্যাত ভবঘুরে সজ্জায় পর্দায় উপস্থিত হলেন। এই সিনেমার জন্য তাকে উদ্ভট সাজসজ্জা করতে বলা হয়েছিল। চার্লি পড়েছিলেন বগি ট্রাউজারস, খুলে পড়বে বলে কোমরে বেঁধেছিলেন দড়ি, মাথায় বাউলার হ্যাট, গায়ে রোগা এক অভিনেতার কোট চাপিয়েছিলেন যেটা তার শরীরে আঁটসাঁট হয়ে চেপে বসেছিল। সহকর্মীর লম্বা জুতা উল্টো করে অর্থাৎ বাম পায়েরটা ডানে আর ডান পায়েরটা বামে পরেছিলেন যাতে খুলে পড়ে না যায়, নাকের নিচে টুথব্রাশের আঁশের মত এক চিমটি মোচ আর হাতে সারাক্ষণ ঘুরতে থাকা একটি ছড়ি। কেন এভাবে সেজেছিলেন, কীভাবে তার মাথায় এই আইডিয়া আসল- এগুলা কেও জানে না, চার্লি নিজেও না সম্ভবত! নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন- I had no idea of the character. But the moment I was dressed, the clothes and the make-up made me feel the person he was. I began to know him, and by the time I walked onto the stage he was fully born.

বলা বাহুল্য, তার এই অদ্ভুত সাজ তার গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা আর আয় বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে। চার্লি যা করে তাই ভাল লাগে, চার্লির মোচ আর ছড়ি চরম জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। চার্লির সিনেমা মানেই প্রেম ও করুণার আধার। চার্লি ভবঘুরে হয়েও স্বপ্ন দেখে, কিন্তু প্রতিবার সেই স্বপ্ন বাস্তবের রুঢ় আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যায়- আর এই সব কিছু চার্লি দেখান অদ্ভুত হাস্যরসের মাধ্যমে। চার্লি স্বপ্নবিলাসী ও সংবেদনশীল। সে মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাঙ্গাল এবং দিনশেষে সে বড় একা। চার্লির এই ভবঘুরে দর্শনের জন্য তার প্রায় সিনেমাতে তার বেশ কিছু দৃশ্য বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, এসেছে বেশকিছু চরিত্র ও।মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত জীবন যখন হাসতে আর স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিল, তখন চার্লি যেন ত্রাণকর্তা রুপে তাদের মাঝে এলেন। মধ্যবিত্ত জীবনের সহজ সরলতা ছুঁতে পেরেছিলেন বলেই হয়ত সবাই তাকে এত ভালোবাসতো। চার্লি বলেছিলেন- I have faith, that people want simplicity. Complexity is not truth.

অনেকের চোখেই তিনি সর্বকালের সেরা অভিনেতা

হাস্যরস নিয়ে তো অনেকেই সিনেমা করেছে, রঙ্গশালার নায়ক তো অনেকেই, তবে চার্লিকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? কারণ চার্লি একই সাথে হাসিয়েছেন এবং কাঁদিয়েছেন। শুধু হাসিয়ে কেও চার্লি হতে পারে না, আমরা চার্লির হাসির কথা মনে রাখলেও তার সিনেমার বেদনার দিকটা যেন ভুলে না যাই, কারণ এই একটা জিনিসই চার্লিকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে। কান্না হাসির দোলায় আমাদের যেভাবে তিনি দোল খাইয়েছেন, সেই কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। চ্যাপলিন লিখেছেন- আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে রোজ ভেড়া দলে দলে নিয়ে যাওয়া হয় কসাইখানায়। তো একদিন হঠাৎ একটি ভেড়া দলচ্যুত হয়ে গেল, সে কি হইচই! লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে মজা দেখতে, ভেড়ার মালিকের অবস্থা খারাপ ভেড়া ধরতে গিয়ে, কিন্ত ভেড়া তো আর এত সহজে ধরা দেয় না। এসব দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম আমি, অনেক হাসি আসছিল। একসময় ভেড়া ধরা পড়ল, পড়তেই হবে, ভেড়া তো ভেড়াই, মানুষের সাথে সে কি আর পারবে? তাকে কাঁধে করে একজন কসাইখানার দিকে ছুটল। হঠাৎ আমার মন খারাপ হয়ে গেল প্রচণ্ড ভেড়াটার পরিণতির কথা ভেবে। একটু আগে যাকে দেখে হাসছিলাম, তার পরিণতি এখন মৃত্যু। আর থাকতে পারলাম না, ঘরের ভেতর ছুটে গিয়ে মাকে বললাম, মাগো, ওমা, অরা ভেড়াটাকে মেরে ফেলবে মা! একই সাথে দুটি ছবি, একটি আনন্দ, একটি বেদনার, দুটি পাশাপাশি, কেও কারো কাছ থেকে দূরে নয়। আমার মনে হয় ছোটবেলায় আমার মাথায় ঢুকে যাওয়া এই ঘটনাটি আমি যেই ধরনেই সিনেমা করি সেটি তৈরিতে বেশ বড় একটা ভুমিকা পালন করেছিল। এটা আমার চিন্তার জগতকে ঘিরে রেখেছে, এটাই আমার অনুভুতির মিশ্রণ।

চার্লির সিনেমাগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।

১৯১৫ সালে নির্মিত দ্যা ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে সিনেমাটি করার পর চার্লির জনপ্রিয়তা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। এতিকে তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শেষ দৃশ্যে চার্লির কষ্টে দর্শকদের মন চাপা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

১৯১৭ সালের ১৭ জুন ২০ মিনিট ৮ সেকেন্ডে দুই রীলের দ্যা ইমিগ্রান্ট সিনেমাটি প্রথম প্রদর্শিত হয়। এই সিনেমার দৈর্ঘ্য ১৮০৯ ফিট, কিন্তু সিনেমার জন্য চ্যাপলিন ৪৪০০০ ফিট কাঁচা ফিল্ম খরচ করেছিলেন। এই ছোট্ট একটি ঘটনা প্রমাণ করে সিনেমা সম্পাদনা ব্যাপারে চার্লি কি পরিমাণ খুঁতখুঁতে, নির্মম ও সচেতন ছিলেন। এই সিনেমাতে আমেরিকাকে চার্লি কোন দৃষ্টিতে দেখেন তার সুক্ষ ক্লু দেয়া আছে। আমেরিকা এমন এক শহর যেখানে দীর্ঘদিন বাস করার পরেও যেন সবাই প্রবাসী হয়েই থাকে, কেও কখনও আমেরিকার নাগরিক হতে পারে না, আমেরিকা অন্য কাওকে শেষ পর্যন্ত আপন করে নেয় না। তার কাছে বাকি সবাই ইমিগ্রান্ট। এখানে সবাই যার যার দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত, এখানে এক মুহূর্তের সংবেদনশীলতা দেখানোকে দুর্বলতা ভাবা হয়।আমেরিকার কাছ থেকে কম পাননি চার্লি, বিনিময়ে তিনি নিজেও আমেরিকার সিনেমাকে কম দেননি। তবে এই আমেরিকা পরবর্তীতে তাকে কষ্টও কম দেয়নি। ৩৯ বছর থেকেও তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব নেন নি, আমেরিকাও তাকে আপন করে নেয়নি। বিচিত্রভাবে তাকে নাস্তানাবুদ করে তার কাছ থেকে প্রবেশাধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে তার মাতৃভূমিতে বিতাড়িত করেছে।

১৯১৮ সালে নির্মিত অ্যা ডগস লাইফ সিনেমাতে একটি দৃশ্য ছিল এরকম- চার্লি আর একটি কুকুর একটি দোকানের সিঁড়িতে বসে আছে আর কিছু দূরে একটি দুধের বোতল পড়ে আছে। কুকুরের পক্ষে যেহেতু বোতল থেকে দুধ খাওয়া সম্ভব না, সেহেতু চার্লি তার লেজটি বোতলের মধ্যে ঢুকিয়ে দুধ দিয়ে ভিজিয়ে দেয় আর কুকুরটি সেই ভিজা লেজ চেটে চেটে খেতে থাকে। কুকুরের এই খাদ্য সংগ্রহ আর খাওয়ার পদ্ধতির মাঝে দরিদ্র মানুষের খাওয়ার পদ্ধতির যে কোন পার্থক্য নেই এটা চার্লির চেয়ে মনে হয়না আর কেও এত সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন।

১৯২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রদর্শিত হল দ্যা কিড সিনেমাটি। চার্লির নাম উচ্চারিত হলে যেই কয়েকটি সিনেমার নাম উচ্চারিত হয় তার মাঝে একটি হল দ্যা কিড। হাসি ও করুণ রসের এই সিনেমাটি একই সাথে দর্শকদের হাসায় ও কাঁদায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকার এক বাস্তবচিত্রের আখ্যান পাওয়া যায় এই সিনেমাতে। বিশেষ করে হাজার হাজার অনাথ শিশুর ভাগ্যে কি ঘটেছিল এবং দারিদ্র্যের কারণে কীভাবে তাদের মায়েরা তাদের নাড়ি ছেড়া সন্তানকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছিল তার একটি প্রামাণ্য দলিল হল দ্যা কিড। পুরো এক বছর ধরে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন চার্লি। পথের মাঝে খুঁজে পাওয়া জ্যাকি কুগানকে দিয়ে অসাধারণ অভিনয় করিয়েছেন। সেই সময়ে দ্যা কিড নির্মাণ করতে তিন লাখ ডলার ব্যয় হয়েছিল, চার্লি এই সিনেমার সত্ত্ব বিক্রি করেছিলেন ছয় লাখ ডলারে। সিনেমাটি সর্বজনসমাদৃত হয়, অল্প কয়দিনেই কোম্পানি ২৫ লাখ ডলার আয় করে সিনেমাটি থেকে। দ্যা কিড নির্বাক ছবি, কোন কথা নাই, শুধু গতি আর শুধু অভিনয়। এই সিনেমা দেখে দর্শক যেমন প্রাণখুলে হেসেছে তেমনি আবার কেঁদেছেও অনেক। দ্যা কিড আসলেই A picture with a smile, Perhaps a tear.

অনেকদিন সিনেমা করার পরে চার্লির অবস্থান যখন শিখরে, তখন হঠাৎ তার নিজের শিকড়ের কথা মনে পড়ল। ১৯২১ এ তিনি ইউরোপ ভ্রমণে বের হলেন। বিপুল গণসংবর্ধনা আর ভালোবাসায় মানুষ তাকে গ্রহণ করলো। মাত্র সাত বছর আগে যেই দেশে তিনি প্রচণ্ড কষ্টে দিন কাটিয়েছেন, বর্তমানে নিজের ভাল অবস্থানে আসার পরে নিজের দেশে পুনরায় ফিরে এসে তিনি নিজের অতীত জীবনকে ভুলে গেলেন না। প্রথমেই ছুটে গেলেন লন্ডনের সেই বস্তিতে যেখানে তিনি জীবন কাটিয়েছেন, সেখানকার মানুষদের সাথে আপনজনের মত মিশলেন, যাকে যেভাবে পারলেন অকাতরে সাহায্য করলেন। সারাদিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় ছুটে গেলেন সেই সেন্ট টমাস হাসপাতালে যেখানে নিজের বাবাকে তিনি হারিয়েছিলেন। হয়ত আশা ছিল তার প্রচণ্ড খারাপ অবস্থার মাঝে তার বাবা তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তার প্রচণ্ড ভাল অবস্থায় তার বাবা হয়ত আবার তার কাছে ফিরে আসবেন!

চার্লির এই যে জনপ্রিয়তা, এটা কি এত সহজে এসেছিল? তার ক্ষেত্রে কি “এলাম, দেখলাম, জয় করলাম” ফর্মুলা কাজ করেছিল? না, এত সহজে তিনি দর্শকের হৃদয় ছুঁতে পারেন নি, বাঁধা কম আসেনি তার ক্যারিয়ারে, তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করার লোকের অভাব ছিল না। তার প্রতিযোগীরা কম চেষ্টা করেনি তাকে দাবিয়ে রাখতে, তবে শেষ হাসিটা চার্লিই হেসেছিলেন। বিজয়ীর হাসি তিনি হেসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজের অমোঘ আকর্ষণই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল! তখনকার বেশিরভাগ অভিনেতা চার্লির গোঁফ, লাঠি এমনকি হাঁটার কায়দা নকল করে প্রতিযোগিতায় নেমে গেল। এরকম একটি প্রতিযোগিতার গল্প অনেক প্রচলিত লোকমুখে- একবার চার্লি সাজার একটি প্রতিযোগিতায় নিজের নাম গোপন করে চার্লি অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি নাকি সেই প্রতিযোগিতায় থার্ড মতান্তরে সেকেন্ড হন! এমনই ছিল চার্লির আকর্ষণ!

বিলি রিচি, বিলি ওয়েন আর বিলি ওয়েস্ট- এই তিন বিলি মিলে চার্লির নাম নিয়ে, চার্লির সিনেমা অনুকরণ করে একই ধরনের সিনেমা বানাতে লাগলেন। এদের মাঝে রিচি ছিলেন এককাঠি সরেস, তিনি বললেন- আমি চার্লিকে নকল করি না, সেই আমাকে নকল করে বেহায়ার মত খেয়ে পরে আছে! মেক্সিকোয় সেই সময় এক অভিনেতা ছিলেন, নাম তার চার্লস আমাডার। তিনি নিজের নাম পাল্টে রাখলেন চার্লস অ্যাপলিন। জার্মান এক অভিনেতা ঘোষণা করলেন, তার আসল নাম হল চার্লি কলিন। একটা সময় সহ্য করতে না পেরে চার্লি আমাডার এর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন এবং বিজয়ী হন। চার্লির অনুকরণকারীরাও একসময় বুঝতে পারে, অনুকরণ করে হয়ত কিছুদিনের জন্য চার্লির বাজার দখল করা যায়, কিন্তু চিরজীবনের জন্য চার্লি চ্যাপলিন হওয়া যায় না!

১৯২১ সালে ইউরোপ ঘুরে এসে চার্লির বানালেন তার অন্যতম বিখ্যাত সিনেমা দ্যা গোল্ডরাশ। দেড় বছরের পরিশ্রম আর ছয় লক্ষ ডলারের ফলাফল হল ১৯২৫ সালের ২৬ শে জুন প্রথম প্রদর্শিত হওয়া দ্যা গোল্ডরাশ। দর্শক আর সমালচকেরা বলেন, গোল্ডরাশ চার্লির শ্রেষ্ঠ সিনেমা। চ্যাপলিন নিজেও বলেন, গোল্ডরাশের মাধ্যমে আমি স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাই। এই সিনেমার শুটিং হয়েছিল আলাস্কার বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে। ১৮৯৮ সালের স্বর্ণ অভিযানের সত্যি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন চার্লি। আলাস্কা ও তার আশেপাশের এলাকায় স্বর্ণ পাওয়া যাচ্ছে- এমন একটি গুজবের ভিত্তিতে দলে দলে মানুষেরা সেখানে সোনার সন্ধানে গিয়েছিলেন। ১৫০ জন অভিযাত্রীর মাঝে মাত্র ১৮ জন নিজের প্রাণ নিয়ে ফেরত আসতে পেরেছিলেন। তারা সঙ্গীদের মৃতদেহের মাংস, কুকুরের মাংস এমনকি নিজেদের জুতো পর্যন্ত সিদ্ধ করে খেয়েছিলেন। এমন বীভৎস ও করুণ একটি সত্যি কাহিনীকে চার্লি হাসির সিনেমায় রূপান্তরিত করলেন।

তিনি প্রায়ই বলতেন- ভয়ঙ্করলে ভয় পেয় না, ঐসব মুহূর্তেও তোমাকে হাসতে হবে, তা নাহলে তুমি পাগল হয়ে যাবে! তার অন্যান্য সিনেমাতেও আসলে তিনি এই কথাটা বারবার প্রমাণ করতে চেয়েছেন। মানুষের লোভ, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের অদম্য ইচ্ছা- এইসব কিছু হল গোল্ডরাশ সিনেমার মূল কথা। এই সিনেমাতে ক্ষুধার জ্বালায় চার্লির জুতো সিদ্ধ করে খাওয়ার দৃশ্যটি সিনেমা ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক দৃশ্য! সিনেমাটি শেষ করার পর একটি ধারনাই মনে ও মননে কঠিনভাবে গেঁথে যায় আর তা হল- স্বর্ণ পাওয়াতে যেই পরিমাণ সুখ, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ সুখ হল মানুষের ভালোবাসা পাওয়াতে।

পর্দায় যেই মানুষটি এভাবে ভালোবাসার কথা তুলে ধরছিলেন, তার ব্যক্তিগত জীবনের ভালোবাসার অবস্থা কিন্তু মোটেও এত সুন্দর ছিল না। চার্লির প্রথম স্ত্রীর নাম Mildred Harris । মেয়েটির বয়স যখন ১৪, তখন থেকেই চার্লির সাথে তার পরিচয়। সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য সে সবসময় চার্লির আশেপাশে ঘুরত। একসময় সে এই মিথ্যা রটাল যে সে গর্ভবতী আর তার সন্তানের জনক স্বয়ং চার্লি। বাধ্য হয়ে ১৯১৮ সালে চার্লি তাকে বিয়ে করেন এবং বিয়ের পর জানতে পারেন তার প্রথম স্ত্রী মোটেও গর্ভধারণ করেন নি। দুবছর পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। বিচ্ছদের আরেকটি কারণ সম্ভবত ১৯১৯ সালে তাদের জন্ম নেয়া প্রথম সন্তান (যার ডাকনাম হিসেবে চার্লি ঠিক করেছিলেন 'The Little Mouse') সেই সন্তানটি জন্মের মাত্র তিনদিনের মাথায় মারা যায়। ১৯২৪ সালে চার্লি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন, স্ত্রীর নাম লিটা গ্রে। এবারও শান্তি পেলেন না চার্লি, লিটার কারণে তার জীবন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অশান্তিতে কেটেছে। মাত্র তিন বছর ছিল তাদের দাম্পত্যজীবন। চার্লির বিরুদ্ধে লিটা একসময় মামলা করেন। রক্ষণশীল কিছু মানুষ চার্লি আর লিটাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই ভাষায় বদনাম করতে থাকলেন। চার্লির গোল্ডরাশ নিয়ে যখন পুরো ইউরোপ আমেরিকাতে প্রশংসা চলছে, ঠিক তখনই লিটা এই সিনেমার সমস্ত সত্ত্ব নিজের বলে দাবি করে বসলেন। শোকে দুঃখে পর্দার বোবা চার্লি যেন বাস্তবেই একদম বোবা হয়ে গেলেন।

এত প্রতিকূল পরিস্থিতে তিনি একটি সিনেমার কাজে হাত দিলেন, নাম দ্যা সার্কাস। নাহ, গোল্ডরাশের মত এত বিখ্যাত সিনেমা নয় দ্যা সার্কাস, তবে গোল্ডরাশের চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ১০ লাখ ডলার খরচ করলেন তিনি এই সিনেমার পেছনে। প্রকৃত সার্কাস সেট এবং সেই সেটে আসল চিড়িয়াখানা বসানো- খরচ তো হবেই! ১৯২৭ সালে বিচ্ছেদ হল লিটার সাথে, আর ১৯২৮ সালে জানুয়ারির ৬ তারিখ রিলিজ পেল দ্যা সার্কাস। এই সিনেমাতে চার্লি শিল্পকে নিয়ন্ত্রণকারীদের মুখোশ খুলে দিলেন। শিল্প ও শিল্পীদের প্রতি যে এদের কোন মায়া নেই, টাকা রোজগারই এদের একমাত্র উদ্দেশ্য- এটাই এই সিনেমাতে দেখানো হয়েছে। এই সিনেমাটি একটি কারণে খুব স্পেশাল কারণ এটিই চার্লির শেষ নির্বাক সিনেমা। এরপরেই সবাক সিনেমার যুগ শুরু হয়ে যায়। ঐ বছরই আমেরিকাতে অস্কার দেয়ার বিষয়টি চালু হয় এবং চার্লি দ্যা সার্কাস সিনেমার লেখক, প্রযোজক , অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে বিশেষ অস্কার পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত হন।

এত প্রাপ্তির পরেও ১৯২৮ সাল চার্লির জীবনে অন্যতম কষ্টের বছর ছিল। এই বছর তা মা মারা যান। নিজের মাকে খুশি করার জন্য চার্লি সবসময় সাদ্ধমত সব কাজ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তার মা যখন মানসিক রোগ থেকে সেরে উঠেন, তখন তিনি তার সেক্রেটারিকে পাঠান তার মাকে নিজের কাছে রাখার জন্য। তার নিজের বাড়িটা যেহেতু বলতে গেলে এক ধরনের ফিল্ম স্টুডিও ছিল, তাই এখানকার হৈচৈ তার মায়ের অসুবিধার কারণ হতে পারে এই ভেবে তিনি সেন্ট মনিকো বীচের কাছে তার মায়ের থাকার জন্য একটি সুন্দর বাড়ি কিনেছিলেন। মাকে দেখাশুনার জন্য নিজের খরচে এক দম্পতিকে সেখানে রেখেছিলেন। তার মায়ের সাথে সর্বক্ষণের জন্য একজন নার্স থাকতো আর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একজন ডক্টর তো ছিলেনই। মা পিয়ানো বাজাতে ভালোবাসতেন, তিনি পিয়ানো কিনে এনেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের সব সিনেমা চার্লি তার মাকে দেখিয়েছেন, সিনেমা হলে মুক্তি পাবার আগে সবসময় সবার আগে নিজের মাকে সিনেমাটি দেখাতেন।

১৯৩১ সালে চার্লির বয়স যখন ৪২ বছর, তখন তিনি নির্মাণ করলেন এক মিষ্টি প্রেমের সিনেমা। তখন সবাক সিনেমার যুগ শুরু হয়ে গেছে কিন্তু চার্লি এই সিনেমাতে আবহসঙ্গীত ছাড়া আর কোন সংলাপ যোগ করলেন না। সেই আবহসঙ্গীতও আবার তার নিজের লেখা। সিনেমাতে কথার সংযোজনকে চার্লি তখনও সহজভাবে নিতে পারেননি। দীর্ঘ তিন বছর ধরে প্রায় এক হাতে তিনি এই সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন। মনের মত অভিনয় পাননি বলে সিনেমার মাঝপথে হেনরি ক্লাইভকে বাদ দিয়ে হ্যারি মেয়ারকে নিয়েছেন। প্রধানতম সহকারী পরিচালক হ্যারি ক্রুকারকে বাদ দিয়েছেন। চার্লির জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বলে বিবেচিত সিটি লাইটস। মুক্তির দিন বিখ্যাত অভিনেতা আর অভিনেত্রীরা ছাড়াও সিনেমাটি দেখতে আসেন স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন আর তার স্ত্রী। এতসব বড় মাপের মানুষদের দেখতে সেদিন এত বেশি মানুষ এসেছিল যে ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই সিনেমা দেখে আইনস্টাইন চার্লিকে বলেছিলেন- কে বলে আপনি সিনেমার কমেডিয়ান? আপনি তো মশাই একজন চৌকস অর্থনীতিবিদ!

এই সিনেমার পর চার্লি আবার বেড়িয়েছিলেন বিশ্বভ্রমণে। লন্ডন, জাপান, মিশর, আলজেরিয়া, প্যারিস- সহ আরও অনেক জায়গা ঘুরে তিনি এক বছর পর আবার হলিউডে আসলেন। অনেকের সাথে তার দেখা হল এই এক বছরে, অনেকের সাথে সিনেমা আর শিল্প নিয়ে কথা হল। অনেকের সাথে মতের মিল হল, আবার অনেকের সাথে মতের অমিল হল। লন্ডনে জর্জ বার্নাড শ এর সাথে দেখা হয়েছিল তার এই সময়ে। শো বলেছিলেন- সাহিত্য আর সংস্কৃতিতে “বিশদ্ধ” আর্ট ফর্ম বলে কিছু নেই, আর্টের যদি বক্তব্য আর শিক্ষা না থাকে, উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে আর্ট তার দিশা খুঁজে পায় না। কিন্তু চার্লি এই মতকে সমর্থন করলেন না। আর্টে কোন উদ্দেশ্য সংযোজন করাটাই অহেতুক, সেটা করতে গেলেই বরং আর্টের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। আমার সিনেমাতে আমি কলার খোসায় আছাড় খেয়ে পড়ি প্রায়ই, এটার পেছনের যদি এখন আমাকে উদ্দেশ্য আর বক্তব্য লাগাতে হয়, তাহলে আমার দ্বারা আর সিনেমা করা সম্ভব হবে না!

এবার চার্লি যেই সিনেমাটি বানালেন, সেটি ১৯১৪ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত তার বানানো ৭৫ টি সিনেমার মাঝে একদম ব্যতিক্রম একটি সিনেমা এবং সম্ভবত এই সিনেমার পর থেকেই তার প্রতি ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর ঘৃণার জন্মের শুরু হয়। দুই বছরের পরিশ্রম আর ১৫ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মিত, ১৯৩৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রদর্শিত হওয়া ৯ রীলের এই সিনেমার নাম মডার্ন টাইমস। এই সিনেমার নায়িকা চরিত্রে অভিনয়কারী পলেট ছিলেন চার্লির তৃতীয় স্ত্রী। নাহ, এই বিয়েও বেশিদিন টিকেনি- ১৯৪২ সালে বিচ্ছেদ হয় তাদের।

এই সিনেমাতে যন্ত্রচালিত আধুনিক সমাজে ধনী আর গরীবের পার্থক্য দেখানো হয়েছে। যেইসব শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকের এই সমাজ গড়ে উঠেছে, তারা আসলে কতটা নিগৃহীত আর নিপীড়িত, সেটাই চার্লি তার স্বভাবসুলভ স্টাইলে দেখিয়েছেন। এই সিনেমা করেই চার্লি একইসাথে অভিনন্দন আর নিন্দা দুটোই একসাথে পেয়েছেন। পুঁজিবাদীরা দেখে বুঝলনে এটি শুধু মজার সিনেমা নয়, বরং এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কড়া বিদ্রুপ। চার্লিকে তারা কমিউনিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করলো। সিনেমা দেখে এই তারা বললেন- চার্লি কিশোরী মেয়েদের সাথে এ কি নষ্টামি শুরু করেছে সিনেমাতে? তাকে সাবধান করা হোক। মজার ব্যাপার হল, এই সিনেমা দেখে কমিউনিস্টরাও খুশি হননি। এই সিনেমাতে যন্ত্রকে বিদ্রূপ করা হয়েছে কিন্তু যন্ত্রের অবদানকে বড় করা হয়নি। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্ঘবদ্ধতা সম্পর্কে কোন ধরনের ইঙ্গিত নেই এই সিনেমাতে! সিনেমার শেষে নায়ক নায়িকা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়- এভাবে চলে যাওয়া মানেই কি সমস্যার সমাধান?! অভিযোগের শেষ নেই চার্লির বিরুদ্ধে! চার্লিও সব অভিযোগের উত্তর দিলেন, আমি কমিউনিস্ট না, আমি কোন দোল করি না। আমি সঙ্ঘবদ্ধতার কোন সিনেমা তৈরি করিনি, করতে চাই নি, আমি তৈরি করেছি সুখের আর দুঃখের সিনেমা। দেখার মত একটি সিনেমা। সোভিয়েত সিনেমার পরিচালক সার্গেই আইজেন্সটাইন বলেছেন- এই সিনেমা আধুনিক যুগের ট্র্যাজেডির উৎকৃষ্টরূপ।

যতদিন চার্লি নিরীহ ভাঁড় সেজেছিলেন, ততদিন তিনি ছিলেন নিরাপদ প্রাণী। কিন্তু যেইমাত্র চার্লি তার সিনেমার সাহায্যে সমাজের অন্যায়ের দিকে মানুষের চোখ ঘুরালেন, যেই তিনি আরও পরিণত হয়ে উঠতে চাইলেন, তখনই তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠতে লাগলো তুমুলভাবে। তার ব্যক্তিগত চরিত্রের উপরে তীব্র আক্রমণ আসলো। একাধিক বিয়ে করার জন্য তাকে বাদী পক্ষের উকিল 'কামুক ষাঁড়' এবং লন্ডনের এক খচ্চর লম্পট বলে অভিহিত করলেন। কিন্তু চার্লি এসব কিছুকে তোয়াক্কা করলেন না, এমনকি আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণেও অস্বীকৃতি জানালেন। “আমি পৃথিবীর নাগরিক, কোন নির্দিষ্ট দেশের নই”- এই ছিল তার বক্তব্য।

এতসব ঝামেলার মাঝেই মডার্ন টাইমসের চার বছরের চার্লি তার জীবনের আরেকটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর এর কাজ শুরু করলেন। মডার্ন টাইমস এর তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল যার মূল হোতা ছিলেন জার্মানির ফ্যাসিবাদী শাসক হিটলার। এই মানুষটাকে এবং তার কাজকর্মকে আঘাত করার জন্যই চার্লি দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি করলেন এবং সবাইকে জানিয়ে দিলেন- আমার পরবর্তী আর কোন সিনেমাতে আপনারা আর সেই মজাদার ভবঘুরে চরিত্রটিকে দেখতে পারবেন না। আমি আমার সেই চরিত্রকে আরও বেশি ধারাল করে তুলছি, সুতরাং আপনারা সেভাবেই মনস্থির করুন। চার্লি এই সিনেমার সংলাপের উপরে বিশেষ জোর দিলেন, অনেক কাজ করলেন সংলাপ নিয়ে। নিজে স্বয়ং অভিনয় করলেন দুটি ভিন্ন চরিত্রে। একটি চরিত্রে ইহুদী নাপিতের, আরেকটি ছিল হিটলারের অনুকরণে নির্মিত কাল্পনিক এক ফ্যাসিবাদী নেতা যার নাম তিনি দিয়েছিলেন “হিস্কেল”। এই সিনেমার সময় হিটলারের মত সাজতে গিয়ে চার্লি সরস অভিযোগ করেন- আমি না, হিটলারই আমার নকল গোঁফটি চুরি করে ব্যবহার করেন।

এক বছর এক মাস আর ২০ লক্ষ ডলারের ফসল হল দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর। চ্যাপলিনের ছেলে বলেছেন- এই সিনেমা করার আগে বাবা হিটলার বিষয়ক প্রচুর প্রামাণ্যচিত্র আর নথিপত্র নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। সিনেমা বানানোর পরে ইহুদী হত্যার যেই নিষ্ঠুর সত্য উন্মোচিত হয়েছে, তা দেখে চার্লি বলেছেন- আগে জানলে এই সিনেমা এভাবে মজা করে বানাতাম না, আরও গভীরে প্রবেশ করতাম দ্যা গ্রেট ডিক্টেটরের। এই সিনেমা দেখেও হিটলার চার্লির বিরুদ্ধে তেমন কিছুই বলেননি। তিনি চার্লির ফ্যান ছিলেন না, উল্টো তার কাছে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছিল যে চার্লি হলেন ইহুদী- কিন্তু হিটলার জানতেন- চার্লি কি পরিমাণ জনপ্রিয়। এই কারণে হিটলার চার্লির মত গোঁফ পর্যন্ত রাখা শুরু করেন এই আশায় যে মানুষ এই গোঁফের কারণে একটু হলেও তার কথা শুনবে, তাকে পছন্দ করবে- এই ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন।

এই সিনেমাতে একটি দৃশ্য ছিল- হিস্কেল একটি গ্লোব নিয়ে খেলা করছে, একবার হাত দিয়ে নাড়াচ্ছে, একবার পা দিয়ে নাড়াচ্ছে, একবার পা দিয়ে ঠেলছে, আবার বুকে জড়িয়ে ধরছে-মোটকথা পুরো পৃথিবীকে নিজের হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠেছে! এমন সময় গ্লোবটি বেলুনের মত ফেটে যায় আর হিস্কেল কান্না শুরু করে দেয়। ১৯৪৫ সালে হিটলারের ভাগ্যে যে পরিণতি অপেক্ষা করছিল, সেটা ১৯৪০ সালে চার্লি নিজের সিনেমার মাধ্যমেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। চার্লি শুধু হিটলার থেকে বয়সেই চারদিনের বড় ছিলেন না, দূরদর্শিতায়ও হিটলারের চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে ছিলেন, তার প্রমাণ দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর। ও হ্যাঁ, দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর জার্মানিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এটা আশা করি না বললেও বুঝতে খুব একটা কষ্ট হবার কথা না।

হিটলারের পতনের মাধ্যমেই সব শেষ হয়ে যায়নি। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে গিয়েছিল। যেদিকে তাকানো যেত সেদিকেই শুধু অভাব আর অভাব। এইসব নিয়ে ১৯৪৭ সালে চার্লি নির্মাণ করলেন তার মসিয়ে ভার্দু সিনেমাটি। এই সিনেমাতে দর্শক দেখল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চ্যাপলিন কে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিনয় এবং সিনেমার পরে চার্লি হয়ে উঠলেন অন্যতম বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। চ্যাপলিন নিজে এই সিনেমা নিয়ে বলেছেন- আমি বিশ্বাস করি মসিয়ে ভার্দু এখন পর্যন্ত নির্মিত সিনেমার মাঝে শ্রেষ্ঠতম, এই বিশ্বাস নিয়েই আমি বেঁচে আছি। এই সিনেমাতে সংসারের ভারে জর্জরিত এক ছাপোষা কেরানী টাকার জন্য অভিনব এক উপায় বের করে। বিভিন্ন ধনী পরিবারে মিথ্যা কথা বলে ধনী মেয়েদের সোনা গয়না ছিনিয়ে নিয়ে সে তাদের হত্যা করে। তার স্ত্রী আর সন্তান এসবের কিছুই জানেন না, তাদের কাছে সে নিতান্তই এক ভদ্র মানুষ, নিরীহ মানুষ, যিনি বাগানের ফুলের গাছের পোকাকেও মারতে ভয় পান, অথচ কেও জানে না, এই বাগানের নিচেই সেইসব তরুণীর লাশ দাফন করেছেন তাদের কথিত “নিরীহ” স্বামী। একসময় তিনি ধরা পড়েন ও তার ফাঁসি হয়। কিন্তু এই সিনেমার মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অনাচার চার্লি যেভাবে তুলে ধরেন, তাতে পুরো বুর্জোয়া শ্রেণী তার পিছনে উঠেপড়ে লেগে যায়। তাকে কমিউনিস্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়। অনেক জায়গায় এই সিনেমাটি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জোয়ান বাড়ি নামের এক মহিলার সাথে চার্লির সম্পর্ক ছিল, তার সন্তানকে সবাই চার্লির অবৈধ সন্তান বলত। কিন্তু রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেল, এটি চার্লির সন্তান নয়। কিন্তু তাদের নিয়ে নোংরা কথা শুরু হয়ে গেল সব জায়গায়। পত্রিকার সাংবাদিকেরা যা ইচ্ছে তাই লিখতে লাগলো চার্লির সম্পর্কে।

১২ এপ্রিল চার্লি এক প্রেস কনফারেন্স এর ডাক দিলেন যার বিষয় ছিল মসিয়ে ভার্দু। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন- আমাকে এই সিনেমা সম্পর্কে যা ইচ্ছে তাই প্রশ্ন করুন, আমি জবাব দিতে রাজি। স্বভাবসুলভ হেসে হেসে তিনি বললেন- আমাকে কসাই এর ছুরি দিয়ে জবাই করতে শুরু করে দিন। নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল সেদিন সাংবাদিকদের সাথে তার-

-আপনি কমিউনিস্ট?

-না। আমি কি সেটার জন্য আজকের কনফারেন্স না, সিনেমা সম্পর্কে প্রশ্ন করুন।

-আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি কেন?

-প্রয়োজনবোধ করিনি তাই, আমি বিশ্বাস করি আমি পুরো পৃথিবীর নাগরিক, কোন নির্দিষ্ট দেশের না।

-কিন্তু আপনি আমাদের দেশে কামাই করেন।

-বিনিময়ে কম দেই না! সারা দুনিয়াতে আমার সিনেমা বলে। বিদেশ থেকে আমার সিনেমার জন্য আয়ের অংশ আসে এই দেশে। তাছাড়া আমেরিকা নিয়মিত আমার কাছ থেকে ট্যাক্স নেয়।

-আপনি কি জানেন আপনার সুরকার বন্ধু হানস আইলার একজন একজন কমিউনিস্ট?

-জানার কোন প্রয়োজনবোধ করিনি। আমাদের বন্ধুত্ব রাজনীতির ঊর্ধ্বে।

-দেখা যাচ্ছে আপনি বেছে বেছে কমিউনিস্টদের সাথেই বন্ধুত্ব করেন!

-আমি কার সাথে কি করব সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার! আমি কারো কথায় নাচি না! এটা আমার সিনেমা সম্পর্কে সম্মেলন ছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে এটা একটি রাজনৈতিক কচাকচানিতে পরিণত হচ্ছে আস্তে আস্তে! আমার আর কিছু বলার নাই, আমি বিদায় নিচ্ছি সবার কাছ থেকে।

পরের দিনে বিভিন্ন কাগজে চ্যাপলিন সম্পর্কে যা যা হেডলাইন বের হল, সেগুলো নিম্নরূপ-

“চার্লি এই দেশের কেউ না”, “দুইদিনের জন্য বেড়াতে আসা চার্লিকে লাথি মেরে বের করে দাও এদেশ থেকে”, “চার্লি একজন নিমকহারাম”, “কমিউনিস্টদের দরদী চার্লিকে রাশিয়া পাঠিয়ে দেয়া হোক”! যেন এক মুহূর্তে সব মানুষ ভুলে গেল এত বছর ধরে এই মানুষটির অবদান! এতকিছুর পরেও নিউইয়র্কে টানা ছয় সপ্তাহ চলল মসিয়ে ভার্দু।

একটার পর একটা মিথ্যা অভিযোগের তীর চার্লির দিকে আসতেই থাকলো- আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন তিনি, পতিতাবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি, নাগরিক আইন ভঙ্গ করেছেন তিনি...। চার্লির জন্য তখন যেন নিঃশ্বাস নেয়াও পাপ!

এরকম সময়ে চার্লির সাথে পরিচয় হল উনা ও নীল নামের এক ১৭ বছরের তরুণীর। চার্লির বয়স তখন ৫২। কিন্তু বয়সের ব্যবধান তাদের ভালবাসায় কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ১৯৪৩ সালে লোকচক্ষুর অন্তরালে বিয়ে করেন তারা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চার্লি উনার সাথেই ছিলেন। উনা ছিলেন বিখ্যাত লেখক ইউজিন ও নীলের দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে। উনা সম্পর্কে চার্লি বলেছিলেন- এতদিনে আমি আমার মনের মত ঘরণী পেয়েছি। উনা হল প্রেরণাদায়ী।

চার্লি চ্যাপলিন

চার্লির জীবনের শেষ স্মরণীয় সিনেমার নাম লাইমলাইট। আমেরিকায় তার নির্মিত এটাই শেষ সিনেমা। এটি ছিল চার্লির নির্মিত সবচেয়ে বেশি ব্যপ্তির সিনেমা। ১৮ মাস লেগেছিল লাইমলাইট তৈরি করতে, তিন বছর লাগিয়েছিলেন শুধু চিত্রনাট্য লিখতেই। এর আগে এত দীর্ঘসময় ধরে তিনি কখনও স্ক্রিনপ্লে লিখেননি। সিনেমাতে ১২ মিনিটের একটি ব্যালে নাচের সুর আছে যার পুরোটা চার্লি নিজেই কম্পোজ করেছিলেন। এই সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন চার্লির প্রতিযোগী বলে খ্যাত বাস্টার কিটন। মজার ব্যাপার হল, তাদের দুইজনকে যখনই সাংবাদিকরা অপর পক্ষের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন, দুইজনেই সবসময় নীরব থেকেছেন। লাইমলাইট সিনেমাতে পুরো চার্লি পরিবার বলতে গেলে অভিনয় করেছিল, চার্লি নিজে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী, সন্তান, তার অর্ধভ্রাতা, উনা একটি প্রক্সি শটে।

১৯৫২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চার্লি হলিউড ত্যাগ করেন। এরপরে ইউরোপে এসে দুইটি সিনেমা বানান তিনি, এই দুটিই ছিল তার শেষ সিনেমা- একটির নাম এ কিং ইন নিউইয়র্ক যেটাতে তিনি নিজে অভিনয় করেছিলেন, পরেরটির নাম হল এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং, এটাতে তিনি পরিচালক ছিলেন, অভিনয় করেছিলেন মার্লান ব্র্যান্ডো আর সোফিয়া লরেন। ব্র্যান্ডো সবসময় চার্লির কাজ সম্পর্কে প্রশংসা করতেন এবং চার্লি সম্পর্কে বলতেন "probably the most talented man the [movie] medium has ever produced।" এই সিনেমার সময় যদিও তাদের মধ্যকার বোঝাপড়া খুব একটা ভাল যায়নি, নিজের আত্মজীবনীতে চার্লি সম্পর্কে ব্র্যান্ডো বলেছেন- "probably the most sadistic man I'd ever met." আর তার সম্পর্কে চার্লি বলেছেন- ব্র্যান্ডোর সাথে কাজ করা simply “impossible”!

একটু ব্যক্তি চার্লির দিকে আসা যাক। কেমন ছিলেন তিনি? ব্যক্তিগত জীবনে সব পেলেও, সুখ জিনিসটা খুব একটা পাওয়া হয়নি তার উনার সাথে পরিচয় হওয়ার আগ পর্যন্ত। তবে তিনি অনেক কাজপাগল মানুষ ছিলেন। মারা যাওয়ার আগের বছরে বলেছিলেন- কাজ করে যাওয়াই হল বেঁচে থাকা আর আমি বেঁচে থাকতে ভালোবাসি। চার্লির ছেলে বাবা সম্পর্কে বলেছেন- বাবা যেকোনো শিল্পীর ভেতর থেকে কীভাবে যেন তার বেষ্টটা সবসময় বের করে আনতে পারতেন। শুধু তাই না, বাবা একনজর দেখেই বুঝতে পারতেন কার দুর্বলতা কোনটা, কার কর্মক্ষমতা কতদূর। বাবা হলেন সেই ব্যক্তি যিনি সকালে সবার আগে স্টুডিওতে ঢুকতেন আর রাতে সবার শেষে স্টুডিও থেকে বের হতেন। কাজের ব্যাপারে অনেক বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন। The Sea Gull (1933) সিনেমার অরিজিনাল নেগেটিভ নষ্ট করে ফেলেছিলেন তার কারণ ছিল- প্রধান অভিনেত্রীর অভিনয় তার পছন্দ হচ্ছিল না এই সিনেমার।

চার্লি চ্যাপলিন পৃথিবীর প্রথম অভিনেতা ছিলেন যিনি টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে এসেছিলেন। শার্লোক হোমসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি, একটি এক অঙ্কের মঞ্চ নাটকে। ৫০০ এর মত গান কম্পোজ করেছিলেন তিনি।তার সবচেয়ে পছন্দের সিনেমা ছিল Battleship Potemkin (1925) । সাদাকালো সিনেমাতে অভিনয় করার জন্য অনেকেই হয়ত জানেন না, চার্লির চোখের মনির রঙ কিন্তু কালো বা বাদামী ছিল না, বরং সেগুলো ছিল নীল। তার শেষ স্ত্রী বলেছিলেন- আমি তার নীল চোখ দ্বারাই প্রথম আকৃষ্ট হই।

জীবনের শেষদিকে এসে চার্লি একটু কেমন জানি হয়ে গিয়েছিলেন, বার্ধক্য যেন হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। আমেরিকাতে প্রবেশাধিকার হারিয়েছিলেন, শেষের দিকে এসে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়, তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আমেরিকাতে, কিন্তু তিনি যাননি। সুইজারল্যান্ডে ডেভের উত্তরে করসিয়া গ্রামে ৩৭ একরের বিশাল বাগান বাড়িতে নিজের সমস্ত পরিবারের সদস্যদের সাথে বাস করতে লাগলেন। তবে কাজ থেকে দূরে ছিলেন না। পূর্ণ সিনেমার আবহসঙ্গীত তৈরি, নতুন করে সিনেমার সম্পাদনা, নিজের বায়োগ্রাফি “মাই লাইফ ইন পিকচারস” প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লেখা- এই ধরনের কাজের মাঝেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তার মেয়ে Geraldine Chaplin এর ভাষায়- জীবনর শেষ সময়ে এসে হঠাৎ তার কেন জানি মনে হয়েছিল, তার মৃত্যুর পরে তাকে আর কেও মনে রাখবে না। এই কারণে তার বিখ্যাত ভাঁড় ক্যারেক্টারটিকে তিনি ১৯৭০ এর সময়ের বিভিন্ন কমার্শিয়াল প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনে ব্যবহারের অনুমতি দেন।

১৯৭২ সালে আর একবার আমেরিকাতে এসেছিলেন তিনি। হলিউড তাকে বিশেষ অস্কারে ভূষিত করে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য। ১২ মিনিটের টানা standing ovation পান তিনি অতিথিদের কাছ থেকে – যেই রেকর্ড আজ পর্যন্ত কেও ভাংতে পারেনি। সেদিন চ্যাপলিন শুধু কাঁদছিলেন, শুধুই কাঁদছিলেন আর বলেছিলেন- পৃথিবীতে কোন শব্দ নেই আমার ধন্যবাদ দেয়ার। কোন শব্দ দিয়ে এই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা যাবেনা। সেদিন ছিল ১৬ এপ্রিল- জি হ্যাঁ, চ্যাপলিনের জন্মদিন। মজার ব্যাপার হল- এই ঘটনার ঠিক পরের বছর তিনি আরেকটি অস্কার জেতেন।

১৯৭৫ সালের ৪ মার্চ রানী এলিজাবেথ তাকে স্যার উপাধি দেন। এই ছেলেআশি বছর আগে লন্ডনের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া খাবার খেয়েছে, আজকে সে লন্ডনের শ্রেষ্ঠ নাগরিক। পরিশ্রম, সাধনা আর সংকল্পের এক অন্যতম উদাহরণ হলেন স্যার চার্লি চ্যাপলিন।

১৯৭৭ এর বড়দিন, ২৫ ডিসেম্বর।

বড়দিন উপলক্ষে চার্লির সুইজারল্যান্ডের বাড়িটাকে মোটামুটি সুন্দর করেই সাজানো হয়েছে। সবাই ছুটোছুটি আর কাজে ব্যস্ত। চার্লি সব দেখছেন আর ফেলে আসা জীবনের সব দুঃখ, বেদনা আর আনন্দের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এল, চার্লি ঘুমে ঢোলে পড়লেন বিছানায়। অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন তিনি- সান্তা ক্লোজ তার স্লেজ গাড়িতে করে চার্লির কাছে এসেছেন। ছোটবেলায় অনেক অসুস্থ থাকতেন চার্লি প্রায়ই, সারাক্ষণ বিছানার বাসিন্দা ছিলেন তিনি, তখন তার মা তাকে বাইরের দুনিয়ার গল্প শোনাতেন রাতে এসে। সেই গল্প শোনানোর দায়িত্ব নাকি এখন চার্লির কাঁধে পড়েছে, তার মা এবার গল্প শুনতে চান তার কাছে। তাকে নিয়ে যেতেই সান্তা এসেছেন। একটুও চিন্তা না করে চার্লি চেপে উঠলেন সান্তার স্লেজ গাড়িতে। দূর দিগন্তরেখায় সেই গাড়ি হারিয়ে গেল একসময়।

১৯৭৭ সালের বড়দিনে একজন অতি বড়মাপের শিল্পী আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অতি নীরবে। নির্বাক সিনেমার নীরব মানুষ, নীরবভাবেই যাবেন, এতে মনে হয় অবাক করার কিছু ছিলনা। ২৭ ডিসেম্বর সকাল এগারোটায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হল।

কি ভাবছেন এখানেই শেষ? মৃত্যু মানেই শেষ? ধুর মশাই! ইনি হচ্ছেন চ্যাপলিন, তার মৃত্যু নিয়েও তোলপাড় হবে না- তা কি হয়?

১৯৭৮ সালের ২ মার্চ চার্লিকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছিল, সেখানে এসে দেখা গেল কফিনসহ চার্লি অদৃশ্য! নেই মানে একদম হাওয়া যাকে বলে! কে নিল চার্লির লাশ? কোন উগ্র নাজিপন্থী যুবক যে কিবা দ্যা গ্রেট ডিক্টেটর দেখে ক্ষিপ্ত? নাকি কোন পুঁজিবাদী শ্রেণীর লোক, যাদের গোমড় চার্লি ফাঁস করে দিয়েছিলেন? নাহ, কোনটাই সত্য হল না। চোর দুইজন অতি সাধারণ বেকার শ্রমিক, তাদের দামী দুই লক্ষ সুইস ফ্রাঙ্ক, উদ্দেশ্য চার্লির স্ত্রী আর সন্তানদের ব্ল্যাকমেল করা। দুই মাস ১৫ দিন পরে চার্লিকে খুঁজে পাওয়া গেল দুই চোরসহ। চার্লি গেলেন আবার কবরের তোলায়, আর চোর দুজন বন্দীশালায়। তবে এবারের কবরে একটি পার্থক্য ছিল। সিমেন্ট দিয়ে এই কবরের চারপাশ ভাল করে সিলগালা করে দেয়া হল যাতে ভবিষ্যতে আর কোন দুর্ঘটনা না হয়। হয়ও নি আর।

বেঁচে থেকে তো দুনিয়ার সব শিল্পীই মনোরঞ্জন করতে পারে, উত্তেজনায় বুক কাঁপাতে পারে, কিন্তু মরে গিয়ে কয়জন শিল্পী পারে এরকম? এখানেই চার্লি চ্যাপলিন আলাদা এখানেই তিনি এক ও অনন্য!

তার নীরবতাই ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি। সারাজীবন নীরব থেকে তিনি যত কথা বলেছেন, যেই পরিমাণ প্রতিবাদ করেছেন। সারাজীবন কথা বলেও অনেক বড় বড় শিল্পী তার অর্ধেকও করতে পারেন না। এরপরেও যদি চার্লিকে শুধু বোবা ভাঁড় আর ভবঘুরে ভাবেন, তাহলে মনে হয় বেশ বড়সড় একটা ভুল হয়ে যাবে!

(চাইলে আরও লিখতে পারতাম, তবে সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় পাঠকসমাজ আমাকে “আস্ত” রাখিতেন না! এত জলদি দুনিয়া ত্যাগের কোন ইচ্ছা নেই!)

এই বিরাট লেখার জন্য যাদের কাছে ঋণী-

  • চলচ্চিত্র বিশ্বের সারথি- মনিস রফিক
  • চার্লি চ্যাপলিন ভাঁড় নয়, ভবঘুরে নয় – মমতাজউদ্দিন আহমদ
  • My life in pictures- চার্লি চ্যাপলিন
  • Charles Chaplin Jr.'s autobiography, "My Father, Charlie Chaplin"
  • The Tramp and the Dictator- BBC Documentary

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা