
"আমার মনে হচ্ছিল, নিশ্চয়ই দর্শকরা মুভিটি পছন্দ করেননি। কিন্ত কেন যেন সেই সময়টাতে আমার বেশ ভাল লাগছিল। হঠাৎ করে দেখা গেল দর্শকরা জোর করতালির সাথে মেমেন্টোর প্রতি স্ট্যান্ডিং ওভেশন জানাচ্ছেন। এটা ছিল অতুলনীয় এক অভিজ্ঞতা..."
মেমেন্টো নির্মাণের আগ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে ফিল্মমেকিং দুনিয়ার সাথে আমার সেভাবে পরিচয় হয়নি। অনেকেই মনে করেন, শুরুর দিকে আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ধাপ ছিল ব্যাটমান বিগিনস। আসলে তা নয়। এটা ছিল মেমেন্টো।
আমার প্রথম মুভি ফলোয়িং তৈরির সময় আমার বন্ধুরা নিজেদের পোশাক পরেই শ্যুটিং করত আর আমার মা সবার জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিত। সেখান থেকে অন্য কারো দেয়া প্রায় চার মিলিয়ন ডলার খরচ করে পেশাদার ক্রু নিয়ে এমন একটা মুভি নির্মাণ যার কিনা নিজস্ব ট্রেইলার এবং সাউন্ড ট্র্যাক আছে- আমার ক্যারিয়ারের জন্য এটা ছিল বিশাল একটা লাফ দেয়ার মত। যদিও হলিউডের হিসাবে মুভিটার বাজেট বলতে গেলে তেমন কিছুই না।
মুভির কাজ শেষ হওয়ার পরবর্তী অভিজ্ঞতাগুলো বেশ ভয়ানক ছিল। বলা যায় মেমেন্টো নামের এই ভ্রমণ আমাদের জন্য ছিল বন্ধুর পথে যাত্রার মত বা রোলার কোস্টারে চড়ার মত। ব্যর্থতার অতল গহ্বরের হাতছানিও দেখতে হয়েছিল আবার সাফল্যের শিখরেও পৌঁছাতে পেরেছিলাম।
১৯৯৯ সালের অক্টোবরের ৮ তারিখ মেমেন্টোর শ্যুটিং শেষ হল এক ড্রাগ ডিলার কে লিওনার্ডের আক্রমণ করার দৃশ্যের মাধ্যমে। সাদা কালো দৃশ্যগুলোর সিকোয়েন্সের জন্য অভিনেতা গাই পিয়ার্স ভয়েস ওভার রেকর্ড করলেন।

পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শেষ হবার পর মুভির প্রযোজক জেনিফার ও সুজানে টড নির্বাহী প্রযোজক অ্যারন রাইডারের সাথে ২০০০ সালের মার্চ মাসে মুভির প্রথম স্ক্রিনিং এর আয়োজন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল সেই সময়ে স্পিরিট অ্যাওয়ার্ডের জন্য শহরে অবস্থান করা গুরুত্বপূর্ণ মুভি ডিস্ট্রিবিউটরদের মনোযোগ আকর্ষণ করা।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রত্যেকেই আমাদের ফিরিয়ে দিলেন। যতবারই আমরা স্ক্রিনিং এর আয়োজন করতাম, কেউ না কেউ মুভির কাহিনী বুঝতে পারতেন। আর আমি প্রযোজনা সংস্থা ফক্সের সাথে মিটিং এর আমন্ত্রণ পেতাম। "এটা অসাধারণ একটা স্ক্রিপ্ট"- তারা বলতেন। কিন্তু তারা আসলে অন্যান্য প্রোজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে চাইতেন।
সুতরাং, তরুণ পরিচালক হিসেবে ধীরে ধীরে আমার পরিচিতি এবং যোগাযোগ বেড়ে চলছিল। আমার ক্যারিয়ার আরো সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার সুযোগ হচ্ছিল। কিন্তু মুভিটা যেন এক রকম সিন্দুকে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রইল। পুরো একটা বিরক্তিকর বছর ধরে কোন ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিই মেমেন্টোর পরিবেশক হতে রাজি হচ্ছিল না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রযোজকদের জন্য এটা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা বিশ্বাস করেই এই মুভিতে চার মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। হতাশা আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল। ভাবছিলাম আদৌ কি মুভিটা আলোর মুখ দেখতে পারবে কি না। প্রযোজনা সংস্থা নিউমার্কেটের প্রতি আমার চির কৃতজ্ঞতা কখনোই তারা মুভিটা থেকে বিশ্বাস হারায়নি। কখনো মুভির একটা দৃশ্যও পরিবর্তন করতে বলেনি। বরং শেষ পর্যন্ত তারা ঝুঁকি নিয়ে নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি খুলে মুভিটি পরিবেশন করার উদ্যোগ নিয়েছিল।
পরের বছর আবার যখন আমরা স্পিরিট অ্যাওয়ার্ড এর আসরে ফিরে যাই তখন সেখানে আমাদের জয়জয়কার- সেরা ফিচার, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রগ্রহণ, সেরা চিত্রনাট্য এবং সেরা পার্শ্বঅভিনেত্রী ক্যারি অ্যানি মস। এটা ছিল রূপকথার গল্পের মতো।

ফলোয়িং এর মতই মেমেন্টোও ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো৷ ২০০০ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে লিডোর সবচেয়ে বড় ভেন্যু যার আসন সংখ্যা ছিল পনের শত, সেখানে মেমেন্টো প্রদর্শিত হল। এটাই প্রথম বার যখন মুভিটার দর্শক সংখ্যা ছিল বিশ জনের বেশি। এটা আমার কাছে বিশাল ব্যাপার ছিল। আগের দিন জানতে পেরেছিলাম কোন মুভি পছন্দ না হলে ভেনিসের দর্শকেরা মুভি শেষে দুর্বল করতালি বা দুয়োধ্বনির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানান।
আমার স্ত্রী এমা এবং আমি পরিচালকদের জন্য নির্ধারিত বক্সে বসলাম যার নাম ছিল "রয়্যাল বক্স"। সেখানে কোন রেলিং ছিল না। সামনে থাকা দর্শকদের জন্য পরিচালক আপাদমস্তক উন্মুক্ত। চুপিসারে দর্শক প্রতিক্রিয়া জানার কোন সুযোগ নেই।
মুভি শুরু হল। আমি বুঝতে পারছিলাম সাবটাইটেলের সাথে তাল মিলাতে ইতালিয়ান দর্শকদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। মুভিতে থাকা হিউমারগুলো অনুবাদে হারিয়ে যাওয়ায় দর্শকরা পারেননি। ভেন্যুর নীরবতা ছিল প্রায় কবরস্থানের সমতুল্য। আকস্মিকভাবে মুভিটি শেষ হল যেটা ছিল দর্শকদের জন্য একটা ধাক্কা (পরবর্তীতে আমার প্রায় সব মুভির শেষ দৃশ্যে এই ধারা অনুসরণ করা হয়)। মুভি শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য ভেন্যুতে পিনপতন নীরবতা নেমে আসল। এমনকি একটা কাশির শব্দও শোনা গেল না।
আমার মনে হচ্ছিল- নিশ্চয়ই দর্শকরা মুভিটি পছন্দ করেন নি। কিছু মুহূর্তের জন্য আমার আসলেই কোন ধারণা ছিল না কী হতে যাচ্ছে। কিন্ত কেন যেন সেই সময়টাতে আমার বেশ ভাল লেগেছিল। ওই মুহূর্তে আমি খুবই ভীত অনুভব করছিলাম। আবার একইসাথে খুবই গর্বিত অনুভব করছিলাম। তারপর হঠাৎ করে দেখা গেল দর্শকরা জোর করতালির সাথে মেমেন্টোর প্রতি "স্ট্যান্ডিং ওভেশন" জানাচ্ছেন। এটা ছিল অতুলনীয় এক অভিজ্ঞতা৷ আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
(টম শোন রচিত 'দ্যা নোলান ভ্যারিয়েশন' থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ)