যেহেতু আজকাল মানুষ বিনোদন-মাধ্যমেই আকৃষ্ট থাকে সবচেয়ে বেশি, তাই সোশ্যাল ট্যাবু ভাঙ্গার জন্যে কিংবা সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্যে এ মাধ্যমের বিকল্প যে মোটেও নেই, তা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এবং ঠিক সে কারণেই 'চণ্ডিগড় কারে আশিকী' যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এক নির্মাণ।

কমার্শিয়াল মালমশলার মোড়কে সামাজিক বার্তার সিনেমা বানানোর বলিউডি যে ট্রেন্ড গত কিছু বছর ধরে তৈরী হয়েছে, তা যে বেশ জনপ্রিয়ও হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। সামাজিক বার্তা, সাসপেন্স, রোমান্স, কমেডি, ক্লাইম্যাক্সে 'সব পেয়েছি'র তৃপ্তি, এসবের যাপিত মিশেলে সিনেমাগুলো বেশ উপভোগ্যও। এবং যেহেতু আজকাল মানুষ বিনোদন-মাধ্যমেই আকৃষ্ট থাকে সবচেয়ে বেশি, তাই সোশ্যাল ট্যাবু ভাঙ্গার জন্যে কিংবা সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্যে এ মাধ্যমের বিকল্প যে মোটেও নেই, তা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এবং ঠিক সে কারণেই 'চণ্ডিগড় কারে আশিকী' যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এক নির্মাণ।

চণ্ডিগড়ের ব্যায়ামবীর মানু মুঞ্জল কে দিয়ে শুরু হয় এই নির্মাণের যাত্রা। গল্পের প্রোটাগনিস্ট মানুর ধ্যানজ্ঞান ব্যায়াম এবং জিম নিয়ে।  দিনের অধিকাংশ সময়েই ফিটনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই পালোয়ান মানুর জিমে একদিন জুম্বা টিচার হিসেবে আসেন মানবী। প্রথম দেখাতেই প্রেম। সেখান থেকে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। দু'জনেই যখন প্রণয়কে পরিণয়ের দিকে নেবার চিন্তাভাবনা করছে, তখনই হঠাৎ জানা যায়- মানবী ট্রান্স গার্ল। মেডিকেল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে ছেলে থেকে সে মেয়ে হয়েছে। গল্পে আসে মোচড়। এই মোচড়ের পরবর্তীতে কী হয়, তা এখানে বলা ঠিক হবেনা মোটেও। বরং পরবর্তীতে মানু এবং মানবীর মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠন হবে, নাকি সমাজের নিয়ম মেনেই দূরে সরে যাবে তারা, তার জন্যে সিনেমা দেখাটাই হবে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত৷ 

যে কারণে এ সিনেমা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলো, তা এর বিষয়বস্তু৷ 'এলজিবিটি' কনসেপ্ট নিয়ে উপমহাদেশে সিনেমা বানানোর চিন্তা করা যে কতটুকু সাহসী পদক্ষেপ, তা সচেতনমাত্রেরই বুঝতে পারার কথা। এরকম সোশ্যাল ট্যাবু নিয়ে সিনেমা বানাতে গেলে ধর্মীয়, সামাজিক, নৈতিক অনুশাসন নিয়ে নানা চলকের মানুষ যেরকম জ্ঞান জাহির করতে আসেন, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সভ্যভব্য সীমার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বিতর্ক বাড়ে। নির্মাণের আপেক্ষিকতা হারিয়ে যায়।  সেরকম এক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই সিনেমার ভাবনা সাধুবাদ পাবে প্রথমে। কিন্তু এখানে কিছুটা আক্ষেপও আছে। এই গল্পের যে চাহিদা, সে অনুযায়ী গল্পটা হতে পারতো আরো গভীর। যেভাবে ফিমেল প্রোটাগনিস্টকে এখানে অবজেক্টিফাই করা হলো, যেভাবে লাউড কমেডিতে ফোকাস করা হলো, সেসব একটু কমিয়ে যদি একজন ট্রান্স গার্লের স্ট্রাগল আরেকটু দেখানো হতো, তাহলে আরো জমাট হতো গল্পটা। মানুষ আরো বেশি সংযুক্ত হতে পারতো গল্পের সাথে। 

মানছি, কমার্শিয়াল সিনেমায় বেশি সিরিয়াস বিষয় আনলে মাস-অডিয়েন্স কানেক্ট করতে পারবেনা। তবুও কিছু বিষয় আনতে হয়। গল্পের প্রয়োজনেই আনতে হয়। এ সিনেমায় সে বিষয়গুলো খানিকটা কম৷ হয়তো বিতর্ক এড়ানোর জন্যেই। ইমোশনাল আপ-ডাউনগুলোও খুব একটা ন্যাচারাল না। যেসব কমেডি হচ্ছে, সেগুলোতেও যে খুব একটা মন খুলে হাসা যাচ্ছে, তেমন না৷ গল্পে কী কোনো নতুনত্ব আছে? না, সেরকমও না। শুরু থেকে শেষ, পুরোটাই প্রত্যাশিত। অভিনবত্ব খুব একটা নেই কোথাও।

নির্মাণের দুই প্রোটাগনিস্ট! 

অভিনয়েও সেরকম দুর্দান্ত কিছু নেই৷ আয়ুষ্মান খুরানার অভিনয় বরাবরের মতই৷ ভালো৷ তবে অসাধারণ বলার জায়গা নেই। যতটুকু স্পেস পেয়েছেন, করেছেন। খানিকটা বিস্মিত হয়েছি বানী কাপুরের অভিনয়ে। বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমার একজন নায়িকার 'ট্রান্সজেন্ডার নারী'র চরিত্রে অভিনয় করার সম্মতিটাই সাহসী এক সিদ্ধান্ত৷ পাশাপাশি, যে অভিনয় তিনি করেছেন, তাও দুর্দান্ত৷ তিনি তার ক্যারিয়ারের বাদবাকি সিনেমাগুলোতে যেরকম চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তার থেকে অনেকটাই স্বকীয় এ অভিনয়কে বলা যেতে পারে তার 'ক্যারিয়ার বেস্ট পারফরম্যান্স'ও। পাশাপাশি, বাকিরাও ঠিকঠাক। যিনি যতটুকুই সুযোগ পেয়েছেন, প্রাসঙ্গিক অভিনয় করেছেন।

দারুণ অভিনয় করেছেন বানী কাপুর! 

তবে এই সিনেমার নির্মাতা অভিষেক কাপুরের কাছ থেকে প্রত্যাশা খানিকটা বেশিই ছিলো। 'রক অন' কিংবা 'কাই পো চে'তে তিনি যেভাবে খোলতাই গল্প বলেছেন, চাইলে এ নির্মাণেও সে কাজ তিনি করতে পারতেন। অনেকের জন্যে খুবই অস্বস্তিকর এ বিষয়কে তিনি আরেকটু গভীরভাবে দেখাতে পারতেন। সার্ফেস লেভেলের স্ক্রিনপ্লে, আর্টিফিশিয়াল গল্প-বয়ানে না গিয়ে তিনি এই গল্পেও এমন প্রসঙ্গ তুলে আনতে পারতেন, যা বোধের প্রাচীরে ধাক্কা দিতে পারতো। এমন কোনো দিক আনতে পারতেন, যার ফলশ্রুতিতে প্রশংসাবাক্য আরেকটু উদার হয়ে ব্যয় করা যেতো। যদিও তা হয়নি, তবুও এ সিনেমা একবার দেখার মতন৷ এবং দেখে উপলব্ধি করার মতন। তাহলেই হয়তো সার্থক হবে সিনেমা এবং সিনেমার মূলভাব। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা