কাছে আসার গল্প: আসছে ফাল্গুনে তারা দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরে আসুক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
তিন মিনিটের 'পেটিএম' এর বিজ্ঞাপন যদি গোটা উপমহাদেশ কাঁপিয়ে দিতে পারে, ইউটিউবের দশ-পনেরো মিনিটের শর্টফিল্মগুলো যদি ভাবনার পরিধিকে খোলনলচে পালটে দিতে পারে, তাহলে এই নির্মাণগুলোর ক্ষেত্রে তা কেন ক্লিক করছে না, সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা হোক। এবং ভাবনাচিন্তার সে প্রক্রিয়া এখনই শুরু হোক...
ভালোবাসা দিবসে 'ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প' সিরিজের নাটকগুলো বিগত বছরগুলোতে এমনই এক প্যারামিটার সেট করে ফেলেছে, প্রত্যেক বছরের বিশেষ এ দিনটিতে প্রিয় বহুকিছুর পাশাপাশি নজর থাকে এই সিরিজের দিকেও। যদিও প্রেম, প্রীতি কিংবা বিচ্ছেদ, সবই এখন বানিজ্যের বিষয়। এবং এই 'কাছে আসার গল্প'ও তার ব্যতিক্রম না মোটেও। তবুও বানিজ্যের আড়ালেও খানিকটা বিমূর্ত বিষয়ের মুখোমুখি করার জন্যেই বরাবর 'ক্লোজআপ' এর এই সিরিজ প্রিয় থেকেছে। এবং ঠিক সে কারণেই হয়তো, এবারের এই ভালোবাসা দিবসে তাদের 'দ্বিধাহীন কাছে আসার গল্প'র পর্বগুলো দেখে মনে হয়েছে, গল্পগুলো এবং পুরো কনসেপ্ট নিয়েই আবার প্রথম থেকে সিরিয়াসভাবে ভাবার সময় তৈরী হয়েছে তাদের। যদি এখনই ঢেলে না সাজানো হয় সব, তাহলে হয়তো প্রতিবছর এই সিরিজ নিয়মিতভাবে আসবে, কিন্তু দর্শককে ধরে রাখার বিষয়টিও ক্রমশই কঠিন হবে তাদের জন্যে।
কেন বলছি এ কথা, তার পেছনে বেশকিছু সম্যক কারণ আছে। এই ফ্রাঞ্চাইজির এবারের 'দ্বিধাহীন কাছে আসার গল্প'র পর্বগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথাবার্তায় একটু পরেই আসবো। এর আগে যদি পুরো সিরিজের সারমর্ম টানি, তাহলে বলতেই হবে- এবারের গল্পগুলো কিংবা এবারের নির্মাণের একটিও গুণগতমানে উতরাতে তো পারেইনি, বরং আগের সময়ের চর্বিত চর্বণ হিসেবেই মনে হয়েছে অনেকটা। এর পেছনে কারণ কী? যদি কারণ হয় 'গল্প', তাহলে গল্প নিয়ে এখনই বিস্তর ভাবার সময় এসেছে। যেখানে 'ভালোবাসা' কনসেপ্টকে নানা আঙ্গিকে, নানা মোড়কে, নানা রূপকে সারা পৃথিবী দেখাচ্ছে, সেখানে সেই একই গৎবাঁধা স্ট্রাকচার অর্থাৎ আচমকা দুই ছেলেমেয়ের দেখা, তাদের মধ্যে রসায়ন, কিছু সংকট আর শেষে এসে মিলনের এই টিপিক্যাল রোডম্যাপ কেন মানুষ পছন্দ করবে? বিগত কিছু বছরে মানুষের টেস্টবাড যেভাবে ডেভেলপ করেছে, যেখানে প্রতিযোগিতা আর নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় আটকে নেই মোটেও, সেখানে এই একই প্রেডিক্টেবল গল্প নিয়ে খুব কি বেশিদূর যাওয়া যাবে? আমি নিশ্চিত নই।
দ্বিতীয়ত, 'গল্প' কারণ না হয়ে যদি কারণ হয় নির্মাণের দৈর্ঘ্য, তাহলে দৈর্ঘ্য নিয়ে ভাবার সময়ও এসেছে৷ আঠাশ মিনিটের বদলে আটচল্লিশ মিনিট হোক দৈর্ঘ্য, যাদের নিয়ে গল্প, তাদের আরেকটু পরিচয় হোক দর্শকের সাথে। গল্প আরেকটু জিরোনোর সময় পাক। আবার, যদি দৈর্ঘ্য বাড়ানোর বদলে কমাতে হয়, সেটাও নাহয় ঠিকঠাকভাবে হোক। তিন মিনিটের 'পেটিএম' এর বিজ্ঞাপন যদি গোটা উপমহাদেশকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, ইউটিউবে দশ-পনেরো মিনিটের শর্টফিল্মগুলো যদি ভাবনার খোলনলচে পালটে দিতে পারে, তাহলে এই নির্মাণে সে বিষয়গুলো কেন ক্লিক করছে না, সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হোক।
তৃতীয়ত, যদি গল্প কিংবা দৈর্ঘ্য কোনোটাতেই সমস্যা না থাকে, তাহলে প্রোডাকশন স্ট্রাকচার নিয়ে নতুন করে চিন্তা হোক। দর্শকের কাছ থেকে কবে গল্প নেওয়া হবে, সে গল্প অনুযায়ী কবে নির্মাতা ও কুশীলব বাছাই হবে, কয়দিনে নামিয়ে ফেলা হবে নির্মাণ, সেসব নিয়ে ভাবনা হোক। সুন্দর কিছু 'বার্ডস আই' শট আর নায়ক-নায়িকার ঝলমলে পোশাকের পাশাপাশি এগুলোও থাকুক চিন্তার তালিকায়।
ফিরি গল্পে। এ বছরের 'ক্লোজআপ দ্বিধাহীন কাছে আসার গল্প'র প্রথমটির নাম- আর থেকোনা দূরে। টাইটেল যেমন নতুনত্বহীন, নির্মাণের মূল গল্পও অনেকটাই সেরকম। অথচ এ গল্পের সম্ভাবনা ছিলো ভালো কিছু হওয়ারই। যদিও শেষপর্যন্ত গিয়ে তা হয়নি মোটেও। যাই হোক, গল্পের দিকে তাকাই- কর্মসূত্রে দুইজন মানব-মানবীর মধ্যে আচমকা তৈরী হওয়া রসায়নে শুরু হয় গল্প। যে রসায়ন খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তৈরী হয় প্রগাঢ় সম্পর্কেও। কিন্তু হঠাৎ করেই ছন্দপতন। সম্পর্কের মধ্যে অলক্ষ্যে গজিয়ে ওঠে প্রাচীর। সে প্রাচীর শেষপর্যন্ত বজায় থাকবে নাকি প্রাচীর টুটিয়ে অমর হবে প্রেম, সে আপনিও জানেন, বাকিরাও জানেন। এবং এটাই প্রথম গল্প।
দ্বিতীয় গল্পের নাম- নাইস টু মিট ইউ। যদিও এ নির্মাণের শিরোনাম হওয়া ছিলো- স্টিকি নোট। কেন এ নাম প্রস্তাব করেছি, তা নির্মাণেই দ্রষ্টব্য। গল্পে ফিরি। লকডাউনের শহর। যোগাযোগ কিংবা যাতায়াত... সবই বায়বীয়। এরকম এক থমথমে সময়ে এক ভ্লগার এবং এক উদ্যোক্তার মধ্যে হয় সম্পর্ক। তাও ড্রোন, স্টিকি নোট এবং অন্তর্জালের সুবাদে। এবং যোগাযোগ থেকে প্রণয়, সেখান থেকে কাছে আসার আকুলতা। যদিও অবধারিতভাবে সেখানেও আছে কিছু সংকট। এবং সে সংকট ভেদ করে তারা কাছে আসবে নাকি আসবে না, সেটাও ধ্রুবসত্যির মতই সবার জানা। এবং দ্বিতীয় গল্প ঘুরিফিরে এটুকুই।
তৃতীয় গল্প- ফাগুন থেকে ফাগুনে। জহির রায়হানের কালজয়ী সেই লাইন 'আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো' থেকেই অনুপ্রাণিত এ শিরোনাম। যে শিরোনামের গল্পে এক সেলুন দেখি আমরা, যে সেলুনে নরসুন্দরের গড়পড়তা জিনিসপাতির পাশাপাশি আছে বই পড়ার ব্যবস্থাও। স্বকীয় ভাবনার সে সেলুনের মালিক এবং কিছুদিন পরেই বিদেশে চলে যাবে এমন একজন তরুণীর মধ্যে হয় মিথস্ক্রিয়া। এবং আচমকাই সে মিথস্ক্রিয়া রূপান্তরিত হয় প্রণয়ে। এবং সে প্রণয়ে থাকে কিছু শঙ্কাও। কী সেই শঙ্কা, সে নিয়েই গল্প। পুরো নির্মাণ।
এই তিনটি নির্মাণের যতটুকু সারাংশ উপরে লিখলাম, এটুকু পড়লেও বুঝতে পারার কথা, এই ত্রয়ী গল্পের নকশায় একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঠিক কতটা প্রকট। কতটা একঘেয়ে। এবং ঠিক এ প্রসঙ্গ বিবেচনায়, খুব সজ্ঞানেই, কুশীলবদের অভিনয়শৈলী কিংবা ক্যামেরার কাজের প্রসঙ্গ আনলাম না এখানে। যেখানে 'গল্প' অর্থাৎ নির্মাণের মূল কাঠামোই দূর্বল, সেখানে বাদবাকি মশলাপাতিতে আর যাই হোক, নির্মাণ 'গুণগতমাণ' এর চৌহদ্দি যে পেরোতে পারেনা মোটেও, তা তো ধ্রুবসত্যি। এবং ঠিক এ কারণেই হতাশ হতে বাধ্য হই 'ক্লোজআপ দ্বিধাহীন কাছে আসার গল্প'র এ বছরের আয়োজনে। এবং শেষমেশ এটাও প্রত্যাশা রাখি- আসছে ফাল্গুনে তারা নিশ্চিতভাবেই দ্বিগুণ শক্তিতে ফেরত আসবে। এই সিরিজের 'গুণগতমান' বিবেচনায় তাদের একটা দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনই এখন সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। সেজন্যে শুভকামনা। আগামী বছরের অপেক্ষা।