এই সিনেমার 'বধির' চরিত্রে অভিনয় করা তিনজন মানুষ বাস্তব জীবনেও বধির। এবং হয়তো সে কারণেই তাদের অভিনয় আর সীমাবদ্ধ থাকেনি অভিনয়ে। জীবনেরই অংশ হয়েছে তা। এবং ক্যামেরা ভেদ করে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় যখনই তা বিদ্ধ করেছে দর্শককে, গল্প জমে গিয়েছে ঠিক তখনই। এবং গল্পের যে ন্যারেশন, সেখানে চাইলে দুঃখ বেটে ঘন কাসুন্দি বানানোই যেতো, কিন্তু নির্মাতা সিয়ান হেডার সে পথে তো হাঁটেনইনি, বরং হালকা চালের গল্পবয়ানে এগিয়ে ক্রমশই দেখিয়েছেন চমৎকারিত্ব!

সাধারণত অস্কারে আমরা যে ধরণের সিনেমাকে অ্যাওয়ার্ড পেতে দেখি, বা, যে ধরনের সিনেমার 'অস্কার' পাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি, সেগুলোকে টপকে এবারের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে 'শ্রেষ্ঠ সিনেমা'র শিরোপা 'CODA'র ঘরে উঠতে দেখায় হয়তো অনেকেই যারপরনাই বিস্মিত হবেন। অবশ্য হওয়াটা স্বাভাবিকও। যেখানে 'ডিউন', 'ওয়েস্ট সাইড স্টোরি', 'পাওয়ার অফ দ্য ডগ', 'কিং রিচার্ড' কিংবা 'ড্রাইভ মাই কার' এর মত সিনেমা থাকে নমিনেশন লিস্টে, সেখানে সবাইকে টপকে এই সিনেমা জিতবে শিরোপা, তা ভাবা খানিকটা দুরূহও বইকি! এবং CODA (Child of Deaf Adults)'র গল্প মোটাদাগে খুব যে অন্যরকম, এমনও না। সিনেমাটি শেষে এসে গভীর কোনো বার্তার সন্ধানও সেভাবে দেবেনা। 'লার্জার দ্যান লাইফ' সিনেমা বলতে যা বোঝায়, এ সিনেমা সেরকমও না। তবুও, নানাবিধ অনুষঙ্গ না থাকার পরেও এই সিনেমায় এমন কিছু বিষয় আছে, যা ভাবাবে যে কাউকেই। ভাবনার খোরাক যোগানোর এই প্রক্রিয়াতেই মূলত নিহিত 'কডা'র সৌকর্য। এবং হয়তো সে কারণেই এ চলচ্চিত্রের এমন অর্জন! 

'কডা'র গল্প শুরু হয় ম্যাচাচুসেটসের উপকূলীয় অঞ্চলের এক পরিবারকে কেন্দ্র করে। যে পরিবারের জীবিকা- মাছ ধরা। সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ, এ পরিবারের একজন বাদে বাকি তিনজনই শ্রবণশক্তিহীন! এবং ঠিক এ কারণেই, তাদের ঘরে বরাবরই ঝুলে থাকে নৈশব্দের চাদর। পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক যোগাযোগ, খুনসুটি কিংবা ঝগড়া... সবকিছুতেই তারা দ্বারস্থ হয় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের। আবার এখানে মাথায় রাখতে হবে, যদিও এ পরিবারের সদস্যরা বধির, কিন্তু তাই বলে তারা যে চরম দুঃখী, বা, তাদের পোর্ট্রেয়াল যে গ্লুমি, বিষয়টা এরকমও না৷ তারাও স্বাভাবিক মানুষজনের মত নোংরা কৌতুক বলে, যৌনকাতর হয়, পরিবারের নানা ঝড়-ঝাপটা একত্রে সামলায়, আবার মাঝেমধ্যে হাতাহাতিও করে। এবং পরিবারের যে একমাত্র শ্রবণক্ষম মানুষ, অর্থাৎ-রুবি, সে 'নির্বাক সিনেমার সাবটাইটেল' এর মতন এই পরিবারের সাথে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগও ঘটায় নিয়মিত৷ স্কুলে যায়। বাবা আর ভাইকে মাছ ধরায় সাহায্যও করে। সময় পেলে মায়ের সাথে হাতও মেলায় ঘরে।

হাসি-খুশি-খুনসুটির 'রোসি' পরিবার

এভাবেই দিন কাটে। গল্প এগোয়। ক্রমশ জানা যায়, শুনতে পারা ছাড়াও রুবির আছে আরেকটি বিশেষ গুণ। সে অসাধারণ সুন্দর গাইতে পারে! যদিও তার গানের গলা আসলেই সুন্দর কি না, তা নিয়ে তার নিজেরও বিশেষ কোনো ধারণা ছিলো না৷ কারণ, বাড়িতে যেখানে কথা বলারও সুযোগ নেই, সেখানে তার গান শুনে কেউ মন্তব্য জানাবে, তা তো আকাশকুসুম কল্পনা! আর স্কুলে গেলে সহপাঠীরা যেভাবে 'বধিরের মেয়ে' বলে কটাক্ষ করতে থাকে, তা শুনে ক্রমশ খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়া রুবির তাই জানা হয়ে ওঠেনা, ভেতরে ভেতরে সে কী  এক প্রতিভা নিয়েই এগোচ্ছে! তবে গুণ কিংবা দোষ যে চাপা থাকেনা, সেও আমাদের জানা। এবং ঠিক সেভাবেই, স্কুলের গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সময়ে এক শিক্ষকের বিশেষ নজরে পড়ে রুবি৷ সেই শিক্ষক তাকে গানের কোর্স করতে যেতে বলে বোস্টন। রুবিও যেতে চায় বোস্টনে। গান নিয়েই এগোতে চায়। কিন্তু ঠিক সে সময়েই রুবির বাড়িতে শুরু হয় বিশেষ এক সংকট। এরকম এক 'শাঁখের করাত' মুহুর্তে এসে প্রশ্ন দাঁড়ায়- রুবি কি তার স্বপ্নকে প্রাধান্য দেবে, নাকি, পরিবারকে? বাকিটা বলছিনা। সিনেমায় দ্রষ্টব্য।

সিনেমার সারসংক্ষেপ কিংবা 'প্রিভিউ' পড়ে বুঝে ফেলবার কথা, গল্প খুব অন্যরকম কিছু না৷ যদি গল্পের চরিত্রেরা বধির না হতেন, যদি তারা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা না বলতেন এবং যদি 'শ্রবণ অক্ষমতার ফলে যাপিত ঝক্কি' এই সিনেমার সেলিং পয়েন্ট না হতো, তাহলে 'কডা' নিয়ে কথা বলার খুব বেশি জায়গা থাকতো না বলেই বিশ্বাস। মেয়ে গান গাইতে চাইছে, এদিকে পরিবারের সংকটে গান গাইতেও পারছে না, ওদিকে মেয়ের এক শিক্ষক আছে, যে তাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে গান গাওয়ার জন্যে... পাজলের এই টুকরোগুলো আমাদের বরাবরই বেশ পরিচিত। এবং এই পাজলগুলো মেলালে অবয়বটা কী দাঁড়াবে, তাও আমাদের জানা। কিন্তু এই যে তিনজন মানুষ, যারা ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড, তাদের যাপিত জীবনের আড়ালে যে অবশ্যম্ভাবী সংকট, সেগুলো টুকরো টুকরো তুলোর মত যখন এসে আটকে যাচ্ছিলো গড়পড়তা এই গল্পে, ঠিক তখনই গল্পটি অর্থবহ এক দ্যোতনার মহাসড়কে এসে দাঁড়াচ্ছিলো। এবং সেটাই মূলত আগ্রহের জায়গা। 

কিছু বিশেষ দৃশ্যের কথা বললে বুঝতে সুবিধে হবে। রুবির সাথে তার মায়ের বিশেষ এক আলাপচারিতার চুম্বক অংশ ছিলো এরকম- রুবি যখন জন্মায়, এবং রুবির বাবা-মা যখন বুঝতে পারে, রুবি স্বাভাবিক, তখন তারা খানিকটা হতাশ হয়েই পড়েছিলেন। তাদের এও ধারণা ছিলো- হয়তো তারা তাদের মেয়ের সাথে কানেক্ট করতেও পারবে না কোনোদিন! এই যে মা-মেয়ের বিশেষ কথোপকথন, এটুকু নিশ্চিতভাবেই ভাবাবে যে কাউকে। সন্তান স্বাভাবিক হয়ে জন্মানোর পরেও মা-বাবা খুশি হতে পারছেন না, শুধুমাত্র সন্তানের সাথে দূরত্ব হওয়ার আশঙ্কায়, কিংবা তারা খুশি হতে পারছেন না, সন্তান তাদের মত হলোনা বলে... নগ্নসত্যের এরকম অকপট প্রকাশ বোধের প্রাচীরে খানিকটা যেন ধাক্কাই দেবে। আবার, রুবির বাবা যখন জানতে পারেন রুবি গান গাইতে পারে, তখন তিনি মেয়েকে গান গাইতে বলেন, এবং হাত দিয়ে স্পর্শ করেন মেয়ের গলা, যাতে ভোকাল কর্ডের কম্পন শুনে গানের তালের ওঠানামা খানিকটা হলেও বুঝতে পারেন তিনি! মেয়ের গান শোনার জন্যে শ্রবণশক্তিহীন বাবার যে আপ্রাণ আকুতি, সেটা এত ছিমছামভাবেই উঠে আসে এই দৃশ্যে, যারা এই দৃশ্যটি দেখেছেন অথবা যারা পরবর্তীতে দেখবেন, মুগ্ধ হবেন অবধারিতভাবে।আরেক দৃশ্য, যেখানে রুবির গানের অডিশন হচ্ছে, আর রুবির পুরো পরিবার চলে যাচ্ছে সে অডিশন দেখতে। তারা শব্দ শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু খুব কৌতূহলী হয়ে বসে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গান বোঝার চেষ্টা করছে... এ দৃশ্যও বেশ অর্থবহ। গভীর। প্রশান্তিরও।

অস্কারের মঞ্চে টিম 'কডা' 

প্রশান্তি কিংবা মুগ্ধতা আরেকটু বাড়বে, যখন জানা যাবে- এই সিনেমার 'বধির' চরিত্রে অভিনয় করা তিনজন মানুষ বাস্তব জীবনেও বধির। এবং হয়তো সে কারণেই তাদের অভিনয় আর সীমাবদ্ধ থাকেনি অভিনয়ে। জীবনেরই অংশ হয়েছে তা। এবং ক্যামেরা ভেদ করে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় যখনই তা বিদ্ধ করেছে দর্শককে, গল্প জমে গিয়েছে ঠিক তখনই। এবং গল্পের যে ন্যারেশন, সেখানে চাইলে দুঃখ বেটে ঘন কাসুন্দি বানানোই যেতো, কিন্তু নির্মাতা সিয়ান হেডার সে পথে না হেঁটেই বরং দেখিয়েছেন চমৎকারিত্ব। গল্পবয়ানে রেখেছেন চটুল আবহ, হালকা চাল, হাস্যরস। এটাও এ সিনেমার প্লাস পয়েন্ট। পাশাপাশি, তিনি এই গল্পের মোড়কে বলতে চেয়েছেন বহুকিছু। পারিবারিক সাম্যাবস্থা, সুখ-দুঃখ-বিষাদ, সংঘাত... এ সিনেমায় অজস্র লেয়ার এসেছে, এবং প্রতিটি লেয়ারই স্বকীয়ভাবে হয়েছে উপস্থিত। কেউ কাউকে ঢেকে দেয়নি, বা, ঢেকে দেয়ার চেষ্টাও করেনি। ফলশ্রুতিতে, সবগুলো উপাদানের পরিমিত মিশ্রণে যা তৈরী হয়েছে, তা দারুণভাবে হয়েছে উপাদেয়। সুতরাং, এটা হয়তো বলাই যায়, এ সিনেমার 'অস্কার'প্রাপ্তি ঠিক নাকি ভুল, সে বিতর্ক অবান্তর। বরং এ সিনেমার নানা টুকরো টুকরো মন্তাজ যে ভাবিয়েছে বিস্তর, সেটাই সন্তুষ্টি। এবং ঠিক সেজন্যেই, নানাবিধ বিতর্কে জল ঢেলে ভাবনার এসব জায়গা নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত বিস্তর। সেটাই প্রত্যাশিত। প্রাসঙ্গিক। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা