ভাষার মাস চলছে। এই ভাষার মাসে 'কোক স্টুডিও বাংলা' শুরু করেছে মহাযজ্ঞ, এবং এ যজ্ঞ শুরু হয়েছে এই ভূখণ্ডেরই তৃণমূল ও খুবই অপ্রচলিত এক ভাষার গানকে প্রমোট করে- এই বিষয়টা কতটা যে অর্থবহ এবং মেটাফোরিক্যালি ব্রিলিয়ান্ট, তা আলাদা করে না বললেও বোধহয় চলে।
'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' এর সাম্প্রতিক সিজন যেভাবে সঙ্গীতপ্রেমীদের আলোড়িত করেছে, পাশাপাশি একই সিজনেরই 'পাসুরি' এনং 'মেহরাম' যেভাবে বৈশ্বিকভাবে মুগ্ধ করেছে সবাইকে, তাতে 'কোক স্টুডিও বাংলা'র প্রথম সিজন নিয়ে বেশ প্রত্যাশাই তৈরী হয়েছিলো। সঙ্গীতের এরকম পরীক্ষিত এক আয়োজন, সেটাও এমন এক দেশের ভূখণ্ডে, যে দেশের মানুষের সাথে গানের সম্পর্ক ভীষণ নিবিড়... প্রত্যাশার ক্রমশ ঊর্ধ্বগতি তাই খুব একটা অমূলকও ছিল না হয়তো।
তবে, সিজনের প্রথম গানের শুরুটাই যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর 'হাজং' ভাষার গান দিয়ে হবে, এটা দূরতম কল্পনাতেও ছিলো না৷ অবশ্য এ গান দিয়ে 'কোক স্টুডিও বাংলা' তাদের যাত্রা শুরু করায় একটা বিতর্কেরও অবসান হয়েছে৷ এই আয়োজনের টাইটেলে 'বাংলা' দেখে খানিকটা রব উঠেছিলো, হয়তো শুধু বাংলা গানেরই ফিউশন করা হবে 'কোক স্টুডিও বাংলা'য়৷ হয়তো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গীতকে উপেক্ষাই করা হবে পুরোপুরি। এ নিয়ে অনেকের অসন্তোষও ছিলো। কিন্তু শুরুর গানের শুরুর অংশই সেই বিতর্কের বাড়াভাতে ছাই তো দিলোই, পাশাপাশি খুব সুন্দর এক বার্তাও দিলো। ভাষার মাস চলছে। এই ভাষার মাসে 'কোক স্টুডিও বাংলা' শুরু করেছে মহাযজ্ঞ, এবং এ যজ্ঞ শুরু হয়েছে এই ভূখণ্ডেরই তৃণমূল ও খুবই অপ্রচলিত এক ভাষার গানকে প্রমোট করে- এ বিষয়টা কতটা যে অর্থবহ এবং মেটাফোরিক্যালি ব্রিলিয়ান্ট, তা আলাদা করে না বললেও বোধহয় চলে।
'নাসেক নাসেক' শিরোনামের এই গান শিল্পী অনিমেষ রায় গাইলেনও তুমুল প্রাণশক্তিতে। নিজের মাতৃভাষার গান, আবেগও হলো বেশ খোলতাই। পাশাপাশি পান্থ কানাইয়ের ভরাট গলায় আবদুল লতিফের লেখা ও আবদুল আলিমের সুরের ফোক গান 'দোল দোল দুলুনি।' আহা! বাংলার বিস্তৃত সঙ্গীত-শেকড়ের একেবারে জনবিরল স্থান থেকেই যেন উঠিয়ে আনা হলো গান দুটিকে৷ জীবন্ত করা হলো। ব্যাকস্টেজ আর্টিস্ট ও মিউজিশিয়ানদেরও আনা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা স্থান থেকে। গানের সাথে তাদের সঙ্গতও হলো বেশ দারুণ। মন্দিরা, পারকাশন, ম্যান্ডোলিন, গিটার, স্যাক্সোফোন এর মিশেল- মিলেমিশে দুর্দান্ত।
তবে খানিকটা আক্ষেপও রইলো সে সাথে। প্রথমেই যা বললাম- 'কোক স্টুডিও বাংলা' নিয়ে প্রত্যাশা ছিলো বিস্তর। সেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মেলবন্ধন যেন খানিকটা হলেও খচখচানি দিলো। প্রথমত- গানের ব্যাপ্তি আরেকটু দীর্ঘ হওয়া উচিত ছিলো। সেট ডিজাইনেও খানিকটা স্বকীয়তা, খানিকটা বাংলার চিরাচরিত থিম আসতে পারতো। যদিও হ্যারিকেন ও দেশীয় নানা নকশাচিত্রের প্রসঙ্গ এসেছে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে, তবে তা আরেকটু বাড়তে পারতো। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টেও বোধহয় আরেকটু বৈচিত্র্য আনা সম্ভব ছিলো।
যদিও সবেমাত্রই শুরু হয়েছে যাত্রা। এখনই এত খুঁত ধরাটা যে সমীচীন নয় মোটেও, সেটাও মানছি। তবে, সে সাথে এও আশা করছি, যত সময় গড়াবে, আরো গবেষণা-নির্ভর ও আরো জমাটি হবে আয়োজন। পরানের গহীন ভেতরে যে সুর-লয়-টান, সেসবকে 'জহুরির রত্ন চেনা'র মত করেই নিয়ে আসা হবে সামনে, প্রত্যাশা সেটাও। সিজনের প্রথম গান যেভাবে জমকালোভাবে শুরু হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে পরবর্তী পর্বের জন্যে অপেক্ষা তো বাড়িয়েছেই, সে সাথে, সামনে নতুন কোন চমক নিয়ে আসে 'কোক স্টুডিও বাংলা', সে জন্যেও শুরু হয়েছে বিস্তর অপেক্ষা। অপেক্ষা চলুক। এবং ততদিন চলুক-
নাসেক নাসেক হাপাল গিলা...