বইয়ের মতো উত্তেজনা তুলতে তারা চেষ্টা করেননি, সেজন্যই আমি তাদের দশে সাত বা আট দিতে প্রস্তুত। কারণ, সে প্রচেষ্টা যদি তারা করতেন, এটা একটা তামিল ছায়াছবি কিংবা অনন্ত জলিলীয় অ্যাকশনে অনায়াসে পৌঁছে যেত।

“কন্ট্রাক্ট” নিয়ে আমার এক বক্তব্য রেখেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। একটি ভিডিও কন্টেন্টে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম কেন কন্ট্রাক্টকে আমি দশে সাত কিংবা আট দিতে প্রস্তুত। অনেকের ভ্রু তাতে কুঁচকেছে, তারা মনে করেন আমার রেটিং আরও কম দেয়া উচিত ছিল। ইন্টারনেটের কল্যাণে আজ আমাদের দেশের মানুষ দেশি-বিদেশি নানা ওয়েব সিরিজ দেখে অভ্যস্ত। কাজেই ওয়েব সিরিজ বা ফিল্ম মেকিং নিয়ে তাদের মধ্যে একটা ‘জেনারেল আইডিয়া’ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এটাও মেনে নিতে হবে, ভেতরের ছবিটা তাদের অনেকের কাছেই অজানা। কাজেই আমি কিছু আলোচনাধর্মী আলাপ করতে চাই। আজ যেমন কথা বলবো স্ক্রিনপ্লে রাইটিং নিয়ে।

স্ক্রিনপ্লে রাইটিংয়ের নানা ধাত ও ধাঁচ আছে। এমন নয় যে একটিমাত্র ফর্মূলা ছুঁড়ে দেয়া হবে এবং স্ক্রিনপ্লে লেখা সবার জন্য সহজ হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে আমি সিড ফিল্ডকে বেশ পছন্দ করি। তার লেখা বই “স্ক্রিনরাইটিং” থেকেই আমার স্ক্রিনরাইটিং শেখার হাতেখড়ি। উল্লেখ্য, জগদ্বিখ্যাত “থ্রি অ্যাক্ট স্ট্রাকচার” কিন্তু এই সিড ফিল্ড-ই আবিষ্কার করেছিলেন। পরে আমি অনলাইন কোর্স করেছি। Screenwriting & Storytelling Blueprint: Hero's Two Journeys কোর্সটি নিয়েছেন হলিউড স্ক্রিনরাইটার মাইকেল হজ এবং ক্রিস ভোগলার। একটা গল্পকে কীভাবে মুভি স্ক্রিনপ্লে-তে রূপান্তরিত করতে হয় তা তারা শিখিয়েছেন।

সিড ফিল্ডের বই পড়ার সময় আমাকে যে বিষয়টা প্রথম ধাক্কা দিয়েছিলো, তা হচ্ছে, স্ক্রিনপ্লে রাইটার যেভাবে ইচ্ছে মূল বইকে ইউজ বা অ্যাবিউজ করতে পারবেন। সে অধিকার তার আছে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি যদি এক লাইনও এদিক ওদিক না করে এমন এক স্ক্রিনপ্লে দাঁড় করান যেখানে ৯০% কাজ আদতে করেছেন মূল বই লেখক, তবুও কপিরাইট চলে আসবে স্ক্রিনরাইটারের, এমনকি গল্পটাই হয়ে যাবে তার নামে! অর্থাৎ ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অফ আজকাবান’ বইটার লেখিকা এই ছিলেন জে.কে. রোলিং, কিন্তু তারপর ওটাকে প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় কপি-পেস্ট করে স্ক্রিনপ্লে লিখলেন স্টিভ ক্লোভস। এখন মুভিতে যে গল্পটা দেখছেন এটা কার? আপনারা বলবেন এটা তো জেকে রোলিং-এর! আসলে তা নয়। এই গল্পটা পুরোপুরি স্টিভ ক্লোভসের। জেকে রোলিং-কে আর না চিনলেও চলবে।

তাহলে মুভিটা?

স্টিভ ক্লোভসের লেখা, স্টিভ ক্লোভসের গল্প।

এবার নিশ্চয় আমার মাথা ফাটাতে আসবেন কিছু মাগল (পাগল নয়, মাগল। পটারহেড মাত্রই বুঝবেন)। বলবেন, আমরা সবাই জানি গল্পটা লিখেছেন জেকে রোলিং। কিন্তু এখানটাতেই তো ভুল হচ্ছে আপনার। এটা তো জেকে রোলিংয়ের লেখা নয়। এটা স্টিভ ক্লোভসের লেখা। স্টিভ ক্লোভসের গল্প। জেকে রোলিংয়ের ভূমিকাটা কী তাহলে?

তাঁর ভূমিকা হচ্ছে, এই মুভিটা “বেজড অন  হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অফ আজকাবান” অথচ গল্পটা জেকে রোলিংয়ের নয়। ‘তার গল্পের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত মুভি’ আর ‘তার গল্প’ – এ দুয়ের মধ্যে আসমান জমিন ফারাক। যদিও চর্মচোখে আমরা দেখছি একই গল্প স্ক্রিনে বলা হচ্ছে, তবুও তা নয়। একই কারণে, গল্প বদলে যেতে পারে, চরিত্রের স্বভাব বদলে যেতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়।

এবার ধীরে ধীরে আমি আপনাদের বুঝাতে পারবো, কন্ট্রাক্ট যদিও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ভাইয়ের লেখা, বেগ ও বাস্টার্ড তার তৈরি চরিত্র, অথচ বাই রুল, কন্ট্রাক্ট ‘ওয়েব সিরিজ’টি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের কন্ট্রাক্ট নয়, এটা স্ক্রিনরাইটারের কন্ট্রাক্ট।

কন্ট্রাক্ট
কন্ট্রাক্ট সিরিজটি হয়ে উঠেছে টক অফ দ্য টাউন

কেন গল্প বদলে দিতে হয় স্ক্রিনপ্লে-তে?

হ্যাঁ, বইয়ের পাঠক সরাসরি বই থেকে গল্প স্ক্রিনে তুলে আনা দেখতে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। অথচ সব সময় তা কেন করা হয় না? বা, কন্ট্রাক্টে কেন তা করা হলো না? অনেক দর্শকের প্রত্যাশার থেকেও তা বাজে কাজ হয়েছে, অথচ আমি এতে ইম্প্রেসড হচ্ছি কোন দিক থেকে? এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার আগে মনে হয় আরো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা দরকার। 

স্ক্রিনপ্লে রাইটিং করতে গিয়ে আমরা একটা বই নিয়ে যদি বইয়ের আগা-মাথা সব বদলে দেই, তাহলে আর বইটা নেয়ার দরকার কী ছিল? এমন প্রশ্ন আমাদের মাঝে মাঝে শুনতে হয়। একজন স্ক্রিনরাইটার কেন গল্পে ইচ্ছেমত পরিবর্তন আনতে শুরু করেন? স্বভাবতই একটি বইয়ের লেখকের থেকে স্ক্রিনরাইটার সে গল্পটাকে বেটার লিখতে পারবেন না। কারণ, কাগজে কলমে যদিও গল্পটা স্ক্রিনরাইটারের, আমরা সবাই জানি গল্পের মূল আইডিয়া ছিলো বইয়ের লেখকের। আর যার মূল আইডিয়া তার থেকে ভালো গল্প বলা কি আরেকজনের পক্ষে ওভাবে সম্ভব? হওয়ার কথা নয়। কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। বর্ন সিরিজের বইগুলো থেকে মুভিগুলো বেটার হয়েছে এ নিয়ে অনেকেই একমত হবেন। আমার পয়েন্ট হচ্ছে, বইয়ের কাহিনী নিজের মতো করে কোন সময় বদলে দিতে পারেন একজন স্ক্রিনরাইটার? তিনি এই কাজটা খুশিতে-ঠেলায়-ঘোরতে করেন কি না? সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। 

১। টাইম-লিমিট

একজন স্ক্রিনরাইটারের মাথায় সবার আগে রাখতে হয় সময়ের ব্যাপারটা। প্রতিটা সেকেন্ড নিয়ে ভাবতে হবে তাকে। বই লেখার মতো সহজ নয় কাজটা। ধরা যাক একটা সিন আমি স্ক্রিনরাইটার হিসেবে রাখতে চাইছি, যেখানে ৪/৫টা ঘটনা ঘটছে। আমি যদি জানি এই পুরো ব্যাপারটার জন্য আমার হাতে আছে তিন মিনিট একুশ সেকেন্ড, এর বাইরে যাওয়া আমার জন্য উচিত হবে না। কারণ, আমি এখন একটা ১২০ মিনিটের মুভি লিখছি। প্রতিটা সিন টাইম লিমিটে আছে। কিংবা ত্রিশ মিনিটের একটি এপিসোড। অথচ উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমি ভাববো না কতখানি সময় পাঠকের যাবে। যতক্ষণ প্রয়োজন মনে করবো লিখে যাবো একই দৃশ্য।

২। জনরা এক্সপ্যান্শন

ধরেন ‘মোহাব্বতেইন’ মুভিটা। হিন্দীতে আমি কাঁচা, কাজেই উচ্চারণ অনুসারে বানান হলো কি না জানি না। ক্ষমা করবেন। ‘মোহাব্বতেইন’ মুভিটা আসলে বিখ্যাত ইংরেজি চলচ্চিত্র ডেড পোয়েট সোসাইটির অ্যাডাপ্টেশন। অথচ রবিন উইলিয়ামসের ডেড পোয়েট সোসাইটিতে দেখানো হয়েছে গভীর জীবনবোধ আর কবিতা, শিল্প। কিন্তু শাহরুখের মোহাব্বতেইনে পুরো বিষয়টাকে একরকম বলৎকার করা হয়েছে। কবিতা আর শিল্পকে রিপ্লেস করা হয়েছে প্রেম দিয়ে। কেন? এমন মারদাঙ্গা গল্প বদলানো কেন? কারণ ভারতের ডেমোগ্রাফি। কবিতা আর শিল্প গোণায় ধরে ১২০ কোটির মধ্যে বড়জোড় ২ কোটি। ডেড পোয়েট সোসাইটির মতো কবিতা বা সাহিত্যের গল্প রেখে শাহরুখ দিয়ে অভিনয় করিয়েও ফ্লপ খেতো। ছেলেমানুষী প্রেমের গল্প ঢুকিয়ে দেয়া মাত্র হিট! কবিতা যারা পড়ে না তারাও দেখলো এই চলচ্চিত্র। মানে অন্য জনরার লোককেও তা গ্রহণ করানো গেল।

৩। রিসোর্স লিমিট

ধরা যাক, বইয়ে দেখানো হয়েছে ট্যাংক এসে গোলা মারছে। পাঠক শিহরিত হয়েছেন। স্ক্রিনরাইটার যেহেতু মুভি মেকিং টিমের ক্রু, সে জানে তাকে কয় পয়সা নিয়ে নামানো হয়েছে। সে যদি জানে একটা ট্যাংক সিনে আনার মতো বাজেটই পুরো মুভির নয়, তাহলে সে কী করবে? গল্পটাই বদলে দেবে। ধরা যাক, সিনেমাটোগ্রাফার যারা আছেন তাদের মুরোদ নেই ক্লোজ অ্যাকশন ফাইট দেখাবার মতো। তাহলে স্ক্রিনরাইটার কী করবেন? বইতে যেখানে ধুমধাড়াক্কা মারপিট হয়েছে, সেখানে একটিমাত্র গুলিতে কাজ শেষ করে দেবেন। এটা খারাপ স্ক্রিনরাইটিং নয়, স্মার্ট স্ক্রিনরাইটিং।

৪। স্কিল বনাম পরিস্থিতি

এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আমি একজন গল্পকার, ঔপন্যাসিক। একই সাথে স্ক্রিনরাইটিং খুব বেশি না করলেও, আমার লেখা “আ টয় অপারেশন থিয়েটার” স্ক্রিনপ্লেটি যতগুলো প্রতিযোগিতায় গিয়েছে, জিতেছে “বেস্ট স্ক্রিপ্ট” অ্যাওয়ার্ড। সে জায়গা থেকে এই বিষয়টা বলে রাখি। অনেকের একটা ভুল ধারণা হচ্ছে, একটা ভালো বই থেকে ‘ডাল’ সিন লিখছেন মানে তিনি বাজে স্ক্রিনরাইটার। আসলে তা নয়। ২০১৫ সালে আমার ছোটগল্প দ্য বিজনেসম্যান থেকে একই নামে একটি টেলিফিল্ম নির্মিত হয় পরিচালক তামহিদ নাফী ভাইয়ের হাতে। ওটা আমার জীবনের প্রথম স্ক্রিনপ্লে।

মাত্র ৬০০০ শব্দের একটা গল্পকেও স্ক্রিনে তোলার জন্য আমাকে বার বার সিন বদলাতে হয়েছে। কেন? কারণ রিসোর্সে কুলাচ্ছে না। গল্প লেখার সময় আমি তো আর ভাবতে যাইনি বৃষ্টি নামলে সমস্যা কোথায়, তুমুল হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট হলে সমস্যা কোথায়, বরং সেসবই পাঠককে আনন্দ দিয়েছে। অথচ ফিল্মে তা রাখা যাবেই, এমন তো নয়। আর একটা পুরোদস্তুর উপন্যাসকে এদেশের স্বল্প বাজেটে স্ক্রিনে তুলতে গিয়ে কী হাল হবে, তা আমি কল্পনা না করার চেষ্টা করবো। এটা বেশি হয় অ্যাকশন গল্প বা বইতে। অ্যাকশন মুভি দেখতে খুব মজা, তবে সামান্য একটা অ্যাকশন সিনের বিহাইন্ড দ্য সিন দেখবেন। ইউটিউবে অনেক আছে। কত মিলিয়ন ডলারের ইকুয়েপমেন্ট সেখানে ব্যবহার করা হয় দেখে নেবেন। হয়তো পাঁচ সেকেন্ডের একটা সিন!

কন্ট্রাক্ট আরিফিন শুভ
কন্ট্রাক্ট এর একটি দৃশ্যে আরিফিন শুভ

এগুলো খুব সারফেসের আলোচনা। ভেতরে যদি ঢুকি, তবে ইকুয়েপমেন্টের অভাবের কারণে কেন স্ক্রিপ্ট বদলাতে হয়, অভিনেতার কারণে কেন বদলাতে হয়, লোকেশনের কারণে কেন বদলাতে হয়, স্থানীয় আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে কেন বদলাতে হয় এমন অসংখ্য কারণ নিয়ে দিন রাত কথা বলা যাবে। কাজেই ‘বাজেট কম থাকলে ভালো স্ক্রিপ্ট লেখা যাবে না? স্ক্রিপ্ট লিখতে কি পয়সা লাগে?’ ধরণের প্রশ্ন যারা করেন তাদের আসলে অ্যাকশন ফিল্ম নিয়ে বিশেষ ধারণা নেই।

দিনশেষে ফাইনাল আউটপুট সামর্থের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে কিনা, তা দেখাটাই ক্রিটিকের জন্য জরুরী। আর কন্ট্রাক্টের ক্ষেত্রে, স্ক্রিনপ্লে রাইটার ও ডিরেক্টর তাদের ক্রু ও বাজেটের সামর্থ্যের মধ্যে স্মার্ট অনেক মুভ নিয়েছেন। বইয়ের মতো উত্তেজনা তুলতে তারা চেষ্টা করেননি, সেজন্যই আমি তাদের দশে সাত বা আট দিতে প্রস্তুত। কারণ, সে প্রচেষ্টা যদি তারা করতেন, এটা একটা তামিল ছায়াছবি কিংবা অনন্ত জলিলীয় অ্যাকশনে অনায়াসে পৌঁছে যেত।

ভীষণ এক ডিজাস্টার না করেই যে তারা কাজটা শেষ করতে পেরেছেন, তাই তাদের প্রশংসা করতে হবে। আর কাজটার স্মার্টনেসের জন্যই আমি সিরিজটিকে দিচ্ছি সাত কিংবা আট।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা