সূর্যবংশীর ক্ল্যাইম্যাক্সে যখন একসঙ্গে তিন হিরো হাজির হচ্ছেন পর্দায়, তখনকার অডিয়েন্স রিয়্যাকশনটা যদি কেউ দেখে থাকেন ইউটিউবে, তাহলে বুঝবেন এই দৃশ্যের আবেদন কতটুকু, কতখানি উন্মাদনা৷ অক্ষয়-অজয়-রনবীর যদি এক সিনেমায় হাজির হতে পারেন, শুভ-সিয়াম-সুমন বা আরও তারকারা কেন নয়?

সিংঘাম সিরিজের প্রথম সিনেমাটা বানানোর সময়ও রোহিত শেঠির মাথায় কপ ইউনিভার্সের পরিকল্পনা ছিল না। সেটা এলো সিংঘামের তুমুল সাফল্যের পর। তখনও অবশ্য সিংঘাম-২ সিনেমাটা নিয়েই রোহিতের সব ভাবনা। এরমধ্যেই 'টেম্পার' নামের একটা তেলুগু সিনেমা দেখে খুব পছন্দ হলো রোহিতের। এটাও পুলিশি অ্যাকশন সিনেমা, নিজের স্টাইলে সেটার হিন্দি রিমেক বানানোর অনুমতিও আদায় করে ফেললেন রোহিত। 

কিন্তু অজয় দেবগনকে নিয়ে তো এই সিনেমা বানানো যাবে না। রোহিত শরণাপন্ন হলেন রনবীর সিংয়ের। জন্ম হলো সংগ্রাম সিম্বা ভালেরাও চরিত্রটার। একই সিনেমায় একদম আনএক্সপেক্টেড সারপ্রাইজ হিসেবে রোহিত হাজির করলেন অক্ষয় কুমারকেও। 'সিম্বা' সিনেমার শেষ দৃশ্যে বীর সূর্যবংশী নামের এক পুলিশ অফিসার হিসেবে হাজির হয়ে অক্ষয় আভাস দিলেন, রোহিত শেঠির কপ ইউনিভার্সের চরিত্রগুলো সব প্রস্তুত। 

করোনার কারণে কয়েক দফায় তারিখ পেছানোর পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছে সূর্যবংশী। কোভিড রেস্ট্রিকশন, হাফ অকুপেন্সি, একেক রাজ্যের একেক রকমের নিয়ম, দর্শকের অনভ্যস্ততা, ওটিটির আগ্রাসন- সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রথম সপ্তাহেই বক্স অফিসে দেড়শো কোটির ব্যবসা করে ফেলেছে সূর্যবংশী৷ পাকিস্তানকে ডিফেইম করা সাদামাটা গল্পের পাওয়ারপ্যাক উপস্থাপন, টিপিক্যাল রোহিত শেঠি মুভি- তবু দর্শক আকৃষ্ট হয়েছে৷ কারন ম্যাস অডিয়েন্সের মনোরঞ্জনের সব উপাদানই সূর্যবংশীতে আছে। 

সূর্যবংশীর একটি দৃশ্যে অজয়-অক্ষয়-রনবীর

সুপারহিরো ক্যারেক্টারগুলোকে অ্যাভেঞ্জার্সের আবরণে মুড়িয়ে মার্ভেল তৈরি করেছিল অত্যাশ্চর্য এক সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স। সেই অনুপ্রেরণায় ভারতে রোহিত শেঠি বানালেন কপ ইউনিভার্স। ঘোষণা দিয়ে না হলেও, কপ ইউনিভার্স কিন্তু বাংলাদেশেও আছে৷ ঢাকা অ্যাটাকের পর একই প্রোডাকশন হাউজ থেকে মিশন এক্সট্রিম আসছে, যেটা কিনা আবার দুই ধাপে মুক্তি পাবে। ঢাকা অ্যাটাকে খুনের নেশায় মত্ত এক ভিলেনকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল পুলিশকে, এবারের লড়াইটা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে, নাশকতার বিরুদ্ধে। কনসেপ্ট যথেষ্ট সাহসী, সন্দেহ নেই। 

ঢাকা অ্যাটাক বা মিশন এক্সট্রিমের সঙ্গে রোহিত শেঠির কপ ইউনিভার্সের বেশকিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। সবগুলোই পাওয়ারপ্যাক অ্যাকশন ঘরানার সিনেমা, পুলিশ বাহিনীর বীরত্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেলুলয়েডে। দুই জায়গাতেই ম্যাস এন্টারটেইনমেন্টকে সন্তুষ্ট করার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন নির্মাতারা৷ সেজন্যেই সূর্যবংশীতে 'টিপ টিপ বারসা পানি' ঢুকে পড়েছে, মিশন এক্সট্রিমের পরিকল্পনায় শুরুতে না থাকলেও, দর্শক চাহিদার কথা মাথায় রেখে রিক্রিয়েট করা হচ্ছে 'টিকাটুলির মোড়' গানটা। উদ্দেশ্য একটাই- হলে দর্শক আনতে হবে, মৃতপ্রায় সিনেমার নাকে অক্সিজেনের নলটা গুঁজে দিতে হবে। 

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ব্যয়বহুল সিনেমা ছিল ঢাকা অ্যাটাক, অন্যতম ব্যবসাসফলও। সেই সিনেমার দারুণ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই নির্মাতারা মিশন এক্সট্রিমের কাজে হাত দিয়েছিলেন। পরিচালক বদলেছে, পাত্র-পাত্রীদের কেউ বাদ পড়েছেন, নতুন অনেকে যুক্ত হয়েছেন। আরিফিন শুভ তো বরাবরের মতোই দারুণ, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন সিনেমার জন্য। যারা বাদ পড়লেন, তাদের মধ্যে আশফাককে (এবিএম সুমন) মিস করব। ঢাকা অ্যাটাকে তার অ্যাপিয়ারেন্স ছিল দুর্দান্ত। 

সূর্যবংশীর রেফারেন্স বারবার টানছি, কারনটা শুধু সিনেমার ধরণে মিল আছে বলে নয়। করোনার ধাক্কা সামলে উত্তর ভারতের সিনেমা হলগুলোকে সুসময়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছে এই সিনেমা। বাংলাদেশের জন্য ঠিক এই কাজটাই মিশন এক্সট্রিম করতে পারে, হয়তো করবেও। সূর্যবংশীর ক্ল্যাইম্যাক্সে যখন একসঙ্গে তিন হিরো হাজির হচ্ছেন পর্দায়, তখনকার অডিয়েন্স রিয়্যাকশনটা যদি কেউ দেখে থাকেন ইউটিউবে, তাহলে বুঝবেন এই দৃশ্যের আবেদন কতটুকু, কতখানি উন্মাদনা৷ 

মিশন এক্সট্রিম মুক্তি পাবে ৩ ডিসেম্বর

এরকমই একটা দৃশ্যের অবতারণা ভবিষ্যতে কোনোদিন হয়তো মিশন এক্সট্রিমের পরবর্তী কোন পর্বেও দেখার আশা রাখি। এসিপি আবিদকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হয়তো অটোমেটিক রিভলবার বাগিয়ে ছুটে আসবেন আশফাক, গুজবাম্প দেয়া একটা সিকোয়েন্সের জন্ম হবে। কিংবা আলাদা একটা সিনেমা হয়তো আসবে আশফাককে নিয়ে, তার মিশনটা আলাদাই থাকবে। চাইলে পেছনের গল্পও দেখানো যায়, ডিজনি-হটস্টারের 'স্পেশাল ওপস' যেমন সিজন-২ না এনে সিজন-১.৫ এনেছে, মূল চরিত্র হিম্মত সিংয়ের (কে কে মেনন) অতীতটা দর্শককে জানানোর জন্য। তবে এরকম কিছু দেখার জন্য সময় লাগবে, অপেক্ষা করতে হবে, এটাও জানি। রোহিত শেঠি ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে দশ বছর বাদে তার কপ ইউনিভার্সকে পূর্ণতা দিতে পেরেছেন, ঢাকা অ্যাটাক বা মিশন এক্সট্রিম ফ্র‍্যাঞ্চাইজিরও সেই সময়টা দরকার। থিতু হবার জন্য, বড় কলেবরে কিছু আয়োজনের জন্যেও। 

মানসম্মত কপ থ্রিলার বলতে এতদিন শুধু ঢাকা অ্যাটাকই ছিল আমাদের সম্বল। এবার মিশন এক্সট্রিম আসছে দুই ধাপে, প্রথম পর্ব মুক্তি পাবে ডিসেম্বরের ৩ তারিখে। এরপর আসবে 'শান', সেটিও কপ থ্রিলার, সিয়াম সেখানে পুলিশ অফিসার। তাকেও কি এই মিছিলে শামিল করা যায়? একটা আল্টিমেট পুলিশ ইউনিভার্স নাহয় হলো, আগে-পরের সবাইকে নিয়ে। ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য; এতগুলো চরিত্রকে এক ছাতার নিচে আনাটা বেশ কঠিন ব্যাপার, তার ওপর প্রোডাকশন হাউজও আলাদা। কিন্তু অক্ষয়-অজয়-রনবীর যদি এক সিনেমায় হাজির হতে পারেন, শুভ-সিয়াম-সুমন বা আরও তারকারা কেন নয়? আপাতত এই চরিত্রগুলোর নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হোক, বাড়ুক ফ্যানবেজ। তাহলেই হয়তো নির্মাতা আর প্রযোজকেরা বড় আয়োজনের ঝুঁকিটা নেয়ার সাহস পাবেন, উন্মুক্ত হবে ভাবনার গতিপথও৷


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা