চার সিজন পরেই বন্ধ: কেন ব্যর্থ হয়েছিল কোক স্টুডিও ইন্ডিয়া?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যে হিন্দি'কে বলা হয় 'মিউজিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ', যে দেশের বলিউডের গানে বুঁদ হয়ে থাকে পুরো উপমহাদেশ, সঙ্গীতের এরকম এক দক্ষযজ্ঞ তাদের দেশ থেকেই কেন ব্রাত্য হলো, কেন বেমালুম উবে গেলো, তা বিস্মিত করে বিস্তর। পাশাপাশি, মনে প্রশ্নও গজায় কিছু। যেসব প্রশ্নের অগ্রভাগে থাকে- কেন বন্ধ করতে হলো এ আয়োজন? যেখানে 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' প্রতি সিজনেই ছাপিয়ে যাচ্ছে বিগত অতীতকে, সেখানে ভারতের এরকম হোঁচট খাওয়ার কারণই বা কী?
'কোক স্টুডিও বাংলা' এই বদ্বীপে যাত্রা শুরু করেছে খুব বেশিদিন হয়নি। এরইমধ্যে তিনটি গান মুক্তি পেয়েছে তাদের। এবং প্রতিটি গানই কমবেশি হয়েছে আলোচনার বিষয়বস্তু। প্রশংসা, সমালোচনা, মুগ্ধতা, অবজ্ঞা... গানগুলো নিয়ে হচ্ছে বহু রকম পাগলামিও। এবং এতে আখেরে লাভ হচ্ছে 'কোক স্টুডিও বাংলা'রও। পাবলিসিটিও বাড়ছে হু হু করে। সর্বস্তরের মানুষজনের কাছে বেশ ভালোভাবেই পৌঁছাচ্ছে গানগুলো। মূল যে 'কোক স্টুডিও' অর্থাৎ 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান', তাদের সাপেক্ষে হয়তো বাংলার গানগুলো নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়ে যায়, কিন্তু, পাশাপাশি, প্রথমবারের মত যাত্রা শুরু করা একটা আয়োজন হিসেবে, 'কোক স্টুডিও বাংলা'র এই আয়োজন নিয়ে খানিকটা মুগ্ধতা প্রকাশ না করাও তাই হয়ে যায় অন্যায়।
যদিও 'কোক স্টুডিও বাংলা' কিংবা 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' আজকের উপজীব্য না। বরং আজকের প্রসঙ্গ- 'কোক স্টুডিও ইন্ডিয়া', যারা মাত্র চার সিজন চলার পরে হয়ে গিয়েছিলো বন্ধ। যে হিন্দি'কে বলা হয় 'মিউজিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ', যে দেশের বলিউডের গানে বুঁদ হয়ে থাকে পুরো উপমহাদেশ, সঙ্গীতের এরকম এক দক্ষযজ্ঞ তাদের দেশ থেকেই কেন ব্রাত্য হলো, কেন বেমালুম উবে গেলো, তা বিস্মিত করেছিলো বিস্তর। পাশাপাশি, মনে প্রশ্নও গজিয়েছিলো কিছু। যেসব প্রশ্নের অগ্রভাগে ছিলো- কেন বন্ধ করতে হলো এ আয়োজন? যেখানে 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' প্রতি সিজনেই ছাপিয়ে যাচ্ছে বিগত অতীতকে, সেখানে ভারতের এরকম হোঁচট খাওয়ার কারণই বা কি? ভারতের মিউজিশিয়ানরা কি পাকিস্তানের মিউজিশিয়ানদের তুলনায় কম দক্ষ? নাকি, ভারতের সঙ্গীত-ভাণ্ডার পাকিস্তানের মত এত সমৃদ্ধ না? মোটা দাগে মূলত এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজবো এ লেখায়।
ভারতে কেন 'কোক স্টুডিও' এর মত প্রচণ্ড এক্সপেরিমেন্টাল মিউজিক্যাল কোলাবোরেশান পাত্তা পেলোনা, এবং, পাকিস্তানে পেলো, এই দুই সমীকরণের মাঝখানে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দাঁড় হবে একটিমাত্র শব্দ-বলিউড। বলিউডের একচ্ছত্র আধিপত্য। বলিউডের মনোপলি। কিভাবে? একটু বুঝিয়ে বলি। সিনেমার মার্কেটিং এ বলিউডের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ আছে, সেটা সবাই জানলেও, অনেকেই যেটা জানিনা, তা হচ্ছে, গানের ক্ষেত্রেও বলিউডের সর্বগ্রাসী প্রভাব। ভারতে গান গেয়ে হিট করানো এবং টাকা ইনকাম করার জন্যে মিউজিশিয়ানদের সবচেয়ে জনপ্রিয় আউটলেট যেটি, সেটির নাম- বলিউড। বলিউডি গান নিয়ে খুব বেশি যে চিন্তাভাবনা করতে হয়, এমনও না। কিছু সহজ ফর্মুলা, কিছু চেনা শিল্পী, কিছু রাঘববোয়াল প্রোডাকশন হাউজ আর কিছু জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকার কোলাবোরেশান... এই সিম্পল টেকনিকেই বহুদিন ধরে চলছে বলিউডের রাজত্ব।
এবং ঠিক এই পর্যায়ে এসেই প্রশ্ন ওঠে, যেখানে শঙ্কর-এহসান-লয় কিংবা এ আর রহমান একটা বলিউডি সিনেমার 'মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট' করেই কামাচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ, সেখানে তারা কেন কম লাভজনক 'কোক স্টুডিও'তে এসে মিউজিকের ফিউশন করবেন? কেন সঙ্গীতের গভীরে যাওয়ার কষ্টটুকু তারা করবেন? প্রসঙ্গত জানাই, বলিউডের যে শিল্পীদের উদাহরণ এখানে আনা হয়েছে, তাদেরকে শুধু উদাহরণের জন্যেই আনা হয়েছে৷ মূলত, এই বক্তব্য প্রযোজ্য বলিউডের সব শিল্পীর ক্ষেত্রেই। বলিউডের 'ইয়াশ রাজ ফিল্মস' বলি কিংবা 'ধর্ম প্রোডাকশনস', তারা যেভাবে শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করে, যেভাবে শিল্পীদের অর্থের সম্মোহনে চুপ রাখা হয়, প্রশ্ন ওঠে- এসবকে হটিয়ে ভারতীয় শিল্পীরা কেনই বা 'কোক স্টুডিও'র এই এক্সপেরিমেন্টাল সঙ্গীত-যজ্ঞে সামিল হবেন?
তাছাড়া, বহুবছর ধরে যেভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্রে বলিউড ঢুকেছে, সেটাও ক্ষেত্রবিশেষে করেছে অসুবিধা। সিনেমা বলি, গান বলি, ফ্যাশন শো বলি, কিংবা বলি রাজনীতির মাঠ... সবখানেই পাওয়া যাবে বলিউডকে। অন্য সবক্ষেত্রে ব্যাপক বলিউডি অনুপ্রবেশের ফলে যেসব অসুবিধে হয়েছে, সেসব বাদই দিলাম, শুধুমাত্র যদি গানের কথাই বলি- 'হিট গান' এর কোনো একটা ফর্মুলা পেলে যেভাবে বলিউড সেটাকে বহু ব্যবহারে ছিবড়ে বানানোর জন্যে উঠেপড়ে লাগে, পুরোনো কোনো ভিন্টেজ গানের সাথে কিছু বিটস যোগ করে যেভাবে সেটাকে রি-মেক করা হয়, কিংবা রুদ্ধশ্বাস কথার সাথে দুয়েকটা সেক্সিস্ট বাক্য যোগ করে যেভাবে র্যাপ করে সেটাকে হিট করা হয়, গানের ভিডিও'তে স্বল্পবসনা নারীদের এনে যেভাবে সে গানকে বাজারে খাওয়ানো হয়... এসবের ভিড়ে ভারতের যে অথেন্টিক মিউজিক জঁরা- হোক তা সুফি মিউজিক, কিংবা ক্লাসিক্যাল, কিংবা ফোক... তা যে একেবারেই মিশেছে মাটির সাথে, সেটা স্বীকার না করলে হয়তো খানিকটা মানসিক শান্তি পেতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু, সত্যিটা এটাই, 'গান'কে 'বড়বাজারের আলু' বানিয়ে এভাবেই ধূলিসাৎ করা হয়েছে বহুবিধ সম্ভাবনা।
এবার, ঠিক এই পরিস্থিতিতে যদি পাকিস্তানের দিকে তাকাই। দেখবো বৈপরীত্য। শাপ হোক কিংবা বর, সত্যি এটাই- পাকিস্তানের মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রি 'পলিউড' কিংবা 'ললিউড' মোটেও বলিউডের মত এত জনপ্রিয় না। সেখানে অর্থের এত কারিকুরিও নেই। টাকার কুমিরদের চাপও নেই। ফলে পাকিস্তানের শিল্পীরা বেশ নির্বিঘ্নেই ও বেশ গভীরভাবেই অংশগ্রহণ করতে পারছে 'কোক স্টুডিও' এর এই আয়োজনে। 'ফোক গান' এমনিতেই পাকিস্তানি গানের খুব বিখ্যাত এক ধারা৷ সে ধারার পাশাপাশি গজল, কাওয়ালি, ক্লাসিক্যাল, সেমি-ক্লাসিক্যাল, র্যাপ, জ্যাজ, পপ এনে, সেসবের ফিউশন ঘটিয়ে যা করা হচ্ছে, যেভাবে গানকে দেওয়া হচ্ছে অন্য মাত্রা, সেটা সপ্রশংস, এবং বলারও বাইরে। এবং ঠিক এভাবেই পার্থক্য করেছে 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান।'
তাছাড়া প্রত্যেক বছর যেভাবে একের পর এক আন্ডাররেটেড ট্যালেন্টেড শিল্পীর প্রমোশন হয় 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' এর বরাতে, আশাব্যঞ্জক সেটিও। জেব অ্যান্ড হানিয়া, মোমিনা মুসতেহসান, নির্মল রায়, কাশিফ আকাই, সারা হায়াত, মোহসিন আব্বাস, শে গিলের মত অসাধারণ শিল্পীদের সবাই চিনেছে 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' এর মাধ্যমেই। এবং নিজেদের প্রথম 'গ্লোবাল এক্সপোজার' বলেই কি না জানা নেই, তারা নিজেদের সর্বোচ্চটাই দিয়েছেন 'কোক স্টুডিও'র বিভিন্ন পর্বে। যা আখেরে 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' এরই সুনাম বাড়িয়েছে। তাছাড়া 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' এখনও যেভাবে গানের সুরকেই দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য, একগাদা ইন্সট্রুমেন্টস আর একাধিক ব্যাক আর্টিস্ট আনলেও যেভাবে স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকছে মূল গানের, সেটাই মূলত এই আয়োজনকে করেছে স্বকীয়। সঙ্গীতের গভীরের যে জায়গায় গিয়ে সুরটা খুঁজে আনা দরকার, যেখানে এক সুরের সাথে আরেক সুরের যোগসূত্র স্থাপন করা দরকার, 'কোক স্টুডিও পাকিস্তান' মূলত করছে সেটিই।
ভারতের সঙ্গীত-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ, তাতে সন্দেহ নেই। ভারতে গুণী সঙ্গীত-শিল্পীরও অভাব নেই, সেটাও ধ্রুবসত্যি। কিন্তু ভারতে 'সঙ্গীত'' এর সংজ্ঞা আসলে কি, প্রশ্ন সেখানেই। যেভাবে 'হিট গান' এর পুরিয়া মুখে নিয়ে বলিউড নির্ধারণ করছে গানের ভবিষ্যৎ, সমস্যা মূলত সেখানেই৷ যেভাবে সস্তা গানের চটকদার মার্কেটিং করে মানুষকে তা গছানো হচ্ছে, সমস্যা সেখানেও। এবং এসব কারণেই ২০১১ সালে শুরু হওয়ার পরে ২০১৫ সালেই বন্ধ হয় 'কোক স্টুডিও ইন্ডিয়া' অথবা 'কোক স্টুডিও এমটিভি।' এই চার বছরের টাইমলাইনে 'কোক স্টুডিও' অনেক চেষ্টাই করেছে। দুর্দান্ত কিছু গানও এসেছে। ওপেন কনসার্টও হয়েছে ভারতে। কিন্তু যেহেতু এখানের মিউজিশিয়ানরা 'স্টার স্ট্যাটাস' পেয়ে গিয়েছেন, যেহেতু শিল্প নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে, সেহেতু, শেষে এসে তাই, এই আয়োজনটা আর দাঁড়ায়নি। ভারতীয় শিল্পীদের অনিচ্ছা এবং 'ব্যবসায়ী'সুলভ মানসিকতাই মূলত ডুবিয়েছে 'কোক স্টুডিও ইন্ডিয়া'র এই প্রজেক্টকে! এবং মোটাদাগে, ভারতে 'কোক স্টুডিও' বন্ধ হওয়ার এটাই প্রধানতম কারণ।