পড়াশোনার সাথে চৌধুরীর যে দূরত্ব, সেই দূরত্ব থেকে যেভাবে উত্তরণ হয়, এই অংশটুকু দারুণ। শেষের ক্লাইম্যাক্সেও মন ভালো হবে নিশ্চিত। এবং যে বার্তাটা দিচ্ছে এই সিনেমা, অর্থাৎ শিক্ষাই মানুষকে 'মানুষ' বানায়, সেই বার্তার এক্সিকিউশনও এতটাই আড়ম্বরহীন, বেশ জটিলতাহীন এক তৃপ্তিই দেবে। 'দাসভি' সমস্যার খুব বেশি জটিলে যেতে চায়নি বলেই জটিলতার জটাজালে দমবন্ধ হবার নাভিশ্বাসও উঠবে না এই সিনেমায়...

সিনেমার মূল কাজ আসলে কী? বিনোদন? নাকি, জ্ঞান বিতরণ? মানুষভেদে এ প্রশ্নের উত্তর যদিও ভিন্ন, তবুও এটুকু দ্ব্যর্থকন্ঠেই বলা যায়, সিনেমার মূল কাজ প্রাথমিকভাবে অবশ্যই বিনোদন জোগানো। বিনোদনের মোড়কে যদি কিছু জীবনবোধ, টুকরোটাকরা উপলব্ধির মেলবন্ধন ঘটানো যায়- তাহলে তা উপরি পাওনা। এবার এই উপরিপাওনাকেই যদি সিনেমার মূলভাব বলে কেউ ধরতে চান, তাহলে তা একান্তই তার ব্যাপার। এবং সেজন্যে 'সিনেমা' নামক মাধ্যমটির মাথাব্যথা নেই মোটেও। আবার, 'সিনেমা' মানেই রূঢ় বাস্তবতা হতে হবে, রিয়েলিস্টিক পোর্ট্রেয়াল থাকতে হবে... এটাও সংকীর্ণ ভাবনা। 'সিনেমা' নিজেই যেহেতু শিল্প, সেহেতু তার আবহ-রকম-প্রকারভেদ কেমন হবে, সেই গণ্ডি টানার অধিকারও নেই কারো। 

'দাসভি' সিনেমাটা দেখার পরপরেই এই কথাগুলো এলো মাথায়। কারণ, তুষার জালোটার এই সিনেমা মুক্তির পরে প্রশংসা যেমন হচ্ছে, তেমনি সমালোচনাও হচ্ছে বিস্তর। যারা সমালোচনা করছেন, তাদের প্রধানতম যুক্তি- এ সিনেমায় বাস্তবের পোর্ট্রেয়াল সেভাবে হয়নি। এই যুক্তির পালটা প্রতিক্রিয়ায় প্রশ্ন ওঠে, এই সিনেমা কি মাথার দিব্যি নিয়ে এসেছিলো যে সে রিয়েলিস্টিক অ্যাপ্রোচে সিনেমা বানাবে? সমালোচকদের দ্বিতীয় যুক্তি- এ সিনেমা থেকে শেখার নেই কিছু। প্রশ্ন আসে সেখানেও- কেনই বা প্রত্যেক সিনেমাকে আস্তিনের আড়ালে 'সোশ্যাল মেসেজ' এর টুকরো চিরকুট নিয়ে আসতে হবে? কেনই বা 'সিনেমা'কে দাঁড়াতে হবে শিক্ষকের ভূমিকায়? 

'দাসভি'র গল্প মোটাদাগে এক রাজনীতিবিদের। যার নাম- গঙ্গারাম চৌধুরী। সুকুমার রায়ের 'সৎ পাত্র' কবিতায় যে গঙ্গারামের বর্ণনা আমরা পেয়েছি, যে গঙ্গারাম সতেরোবার মেট্রিক পরীক্ষা দিতে বসেও পাশ করতে পারেনি, এ গল্পের গঙ্গারামও সেরকম। সে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা? সেখানেই গলদ। টেনেটুনে অষ্টম শ্রেণী পাশ! সে কারণেই, রাজনীতির পড়াশোনায় যে মানুষটি 'পিএইচডি স্টুডেন্ট' হওয়ার যোগ্যতা রাখে, সে মানুষটি সামান্য স্বাক্ষর দিতেও ক্রমশ হয় অপারগ! যাই হোক, এই মূর্খ নেতা গঙ্গারাম দুর্নীতির অভিযোগে একবার এলেন জেলে। জেলে এসে দেখলেন এখানে কয়েদীদের কাজের প্রচুর চাপ। তাছাড়া, জেলারও বেশ কড়া। তিনি সেলিব্রেটি বলে যে রেহাই পাবেন, তাও হবে না। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে পেলেন এক বুদ্ধি। কয়েদীদের দৈনন্দিন কাজের হাত থেকে বাঁচার জন্যে শুরু করলেন পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে করতে নিলেন এক সিদ্ধান্তও- তিনি যদি মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারেন, তাহলেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরে এসে রাজনীতি করবেন। নাহয়, তিনি রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন চিরতরে! 

শুরু হলো জেলের ভেতরে আদাজল খেয়ে পড়াশোনা। জেলমেটরা পড়াতে লাগলো তাকে। শেখাতে লাগলো- বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইতিহাস। এদিকে হচ্ছে আবার আরেক অঘটন। গঙ্গারামের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী বিমলা দেবী বসেছিলেন মসনদে। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সেও আর নামতে চাইছেন না সেখান থেকে। স্বামী যেহেতু বলেছে- ফেল করলে আর রাজনীতিতে আসবে না, তাই অলক্ষ্যে থেকে সেও কলকাঠি নাড়াচ্ছে, কিভাবে স্বামীকে মাধ্যমিকে ফেল করানো যায়! কিভাবে সারাজীবন ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকা যায়! শুরু হলো অদ্ভুতুড়ে দ্বৈরথ! 

মোটাদাগে, নির্মাণের গল্প এটুকুই। মূলত গঙ্গারামের গল্পই এটি। এবং সে চরিত্রে অভিষেক বচ্চনের অভিনয়ও দারুণ। যদিও যে চরিত্রে তার অভিনয়, সে চরিত্রের বিকাশ অর্থাৎ যাকে 'ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট' বলা হয়, সেটা খুব যে দারুণভাবে হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না মোটেও। ক্যারেক্টার আর্কও সেভাবে ক্লিয়ার না। কিন্তু তা সত্বেও হরিয়ানা অ্যাক্সেন্ট আর মাথায় পাগড়ির 'চৌধুরী সাব'রূপী অভিষেক বচ্চনের অভিনয় বেশ দারুণ। 'জেলার' চরিত্রে ইয়ামি গৌতম খানিকটা হতাশ করলেন। তার চরিত্রে টাফনেস থাকবে, গল্পের ডিমান্ড ছিলো সেটি। তা বিবেচনায়, এই চরিত্রের টাফনেস খানিকটা কম লাগলো। যেটা থাকলে গল্প আরেকটু জমতো। তবে ইয়ামি গৌতম একটু আক্ষেপ রাখলেও 'চৌধুরী সাব' এর স্ত্রী 'বিমলা দেবী' চরিত্রে নিম্রাত কউর আবার দারুণ৷ ভালো স্ক্রিনটাইম পেয়েছেন। কমিক রিলিফও ছিলো কিছু। খারাপ করেননি। 'গরু-পরিচর্যা করা গোবেচারা স্ত্রী' থেকে 'রাজ্য চালানো চতুর মুখ্যমন্ত্রী' হিসেবে যে ট্রান্সফরমেশন তার, সেটাও ভালো। ছিমছাম। সাইড কিকগুলোও ভালো। অভিযোগের জায়গা নেই। 

অভিষেক বচ্চন দারুণ! 

তবে অভিযোগের জায়গা আছে অন্যত্র। এ সিনেমার যে সেলিং পয়েন্ট অর্থাৎ 'শিক্ষার গুরুত্ব' বোঝানো, সেটা আরেকটু দারুণভাবে করা যেতো বলেই বিশ্বাস। হয়তো মাস পিপলকে কানেক্ট করবে বলেই খুব বেশি গভীরে যায়নি এ সিনেমা। 'সারফেস লেভেল'ই থেকে গিয়েছে। কিন্তু গল্পের সুযোগ ছিলো আরো গভীরে যাওয়ার। সেটা হয়নি। এ গল্পের কিছু সিচুয়েশনে সিরিয়াসনেস থাকা উচিত ছিলো। গল্প যেখানে সাসপেন্স ডিমান্ড করে, সেখানে চুটকি দিয়ে বের হয়ে আসাটা খুব অপরিপক্ক কাজ মনে হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, চরিত্রগুলোর রসায়ন। চৌধুরী সাহেবের সাথে তার স্ত্রী'র সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব, মিলন- এগুলো খুব একটা স্পষ্ট না। যে জেলারের সাথে চৌধুরী সাবের ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাত, পূর্ণতা নেই সেখানেও। এমনকি, যে 'চৌধুরী সাব' দুর্নীতিপরায়ণ এক অশিক্ষিত মানুষ থেকে শিক্ষানুরাগীতে পরিণত হলেন, সেই রূপান্তরও ঠিক স্পষ্ট না। চরিত্রগুলোর বিন্যাস ও মধ্যবর্তী রসায়নে আরেকটু মনোযোগ অবশ্যই দরকার ছিলো। যেটা অনুপস্থিত ছিলো। 

তবে 'দাসভি'তে মন ভালো করার দৃশ্যও ছিলো বিস্তর। পড়াশোনার সাথে চৌধুরীর যে দ্বৈরথ, সে দ্বৈরথ থেকে যেভাবে উত্তরণ হয়, এ অংশটুকু বেশ দারুণ। শেষের ক্লাইম্যাক্সেও মন ভালো হবে নিশ্চিত। এবং যে বার্তাটা দিচ্ছে এ সিনেমা, অর্থাৎ শিক্ষাই মানুষকে 'মানুষ' বানায়, সে বার্তার এক্সিকিউশনও এতটাই আড়ম্বরহীন, বেশ জটিলতাহীন এক দ্যোতনাই দেবে। 'দাসভি' সমস্যার খুব বেশি জটিলে যেতে চায়নি বলেই জটিলতার জটাজালে দমবন্ধ হয়ে নাভিশ্বাস উঠবে না। বরং লাইট ন্যারেশনে বলা গল্প মুচমুচে তেলেভাজার সন্তুষ্টি দেবে। যেটা ইতিবাচক। এবং মূলত গল্পের ক্রিস্প বেশি হওয়ার কারণেই, নির্মাণের কিছু জায়গার প্রকট সমস্যাও নির্মাণকে খুব বেশি প্রভাবিত করবেনা৷ 

আরেকটু বেশি প্রত্যাশা ছিলো ইয়ামি গৌতমের কাছ থেকে! 

'দাসভি'র প্রধানতম সমস্যা, অনেকগুলো সাবপ্লটের বার্ডেন নেয়া। দরকার ছিলো না। একজন করাপ্টেড পলিটিশিয়ান জেলে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে তার বোধোদয় হচ্ছে সে পড়াশোনা করবে, এবং সে শুরু করছে পড়াশোনা; গল্প যদি এটুকু নিয়েও এগোতো, তাহলেও সমালোচনার কিছু থাকতো না। বরং তখন গল্প, চরিত্র কিংবা সিচুয়েশনের ডিটেইলিং নিয়ে আরো কাজ করা যেতে পারতো। গল্প কমপ্যাক্ট হতো। কিন্তু তা না করে, পলিটিক্স, কাস্ট, হিস্টোরি, পাওয়ার স্ট্রাগল, করাপশন...পাজলের এত এত টুকরো আনা খানিকটা বিশৃঙ্খলাই বাড়িয়েছে। তবে এটা নির্মাতা তুষার জালোটার জন্যে এক শিক্ষাও। গল্প যে তিনি বেশ ভালোভাবেই বলতে জানেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো নির্মেদ গল্প বলাতেই রয়ে গিয়েছে সামান্য দূর্বলতা। এবং গল্পের অতিরিক্ত অনুষঙ্গ ছেঁটে দিলে তার নির্মাণ যে আরো টানটান হবে, তা হলফ করেই বলা যায়। এবং সেজন্যেই প্রত্যাশা- পরবর্তী নির্মাণে ভুলত্রুটি শুধরে সতর্ক হবেন তিনি। সেই নির্মাণের জন্যেই তাই অপেক্ষা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা