একই গল্পে মেল-ফিমেল শোভেনিজম, সেক্স, ট্যাবু, রিলেশনশিপের ভালনেরাবিলিটি, সোশ্যাল আনস্টেবিলিটি, গুরু কালচার, এলজিবিটিকিউ, সোশ্যাল মিডিয়ার প্যারাডক্স, ক্লাস কনসেপ্ট, আর্বান মেট্রোপলিস... স্পর্শ করা হলো সবকিছুকেই। ক'দিন আগে মুক্তি পাওয়া হলিউডি 'ডোন্ট লুক আপ' যেমন প্রবল চপেটাঘাত করেছে যাপিত নানা অসঙ্গতিকে, 'ডি-কাপলড' এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও যে সেরকম নগ্ন কটাক্ষ ও প্রহসন, তাও বেশ ভালোভাবেই করা যাচ্ছিলো আঁচ!  

বলা হয়ে থাকে- Sarcasm is the lowest form of wit. তবুও যতই 'নীচুজাত' বলে গালমন্দ করা হোক না কেন, এই সারকাজম করাটাই যে সবচেয়ে কঠিন কাজ, তা বোধকরি সবারই জানা। ঠিকঠাক রসবোধ না থাকলে এবং সে রসের যথাযথ প্রয়োগ না করলে পুরো বিষয়টিই যে হতে পারে বাড়াবাড়ি রকমের বিরক্তিকর, সেটিও অজানা না কারো।  হুমায়ূন আহমেদ স্যার যেমন বলতেন- মানুষকে হাসানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। সারকাজমের এই বিষয়টিও তেমনি। সূক্ষ্ম। স্পর্শকাতর। তাছাড়া, এই উপমহাদেশে সারকাস্টিক কন্টেন্ট বানানো বেশ ঝক্কিও। মানচিত্রের এ ভাগের মানুষজন যতটা না দুঃখপ্রিয়, তারচেয়েও বেশি অনুভূতিপ্রিয়। সারকাজম না বুঝে যাপিত নানা অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও এই অঞ্চলে নেহায়েত কম না। ঠিক সে কারণে প্রহসন, রম্য, রূপকের গল্প বলা এখানে খানিকটা অসুবিধের। ঝুঁকির। অস্বস্তির। 

সে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেটফ্লিক্সের ইন্ডিয়ান ওয়েব সিরিজ 'ডি-কাপলড' বেশ সাহসী সিদ্ধান্তই। একই গল্পে মেল-ফিমেল শোভেনিজম, সেক্স, ট্যাবু, রিলেশনশিপ ভালনেরাবিলিটি, সোশ্যাল আনস্টেবিলিটি, গুরু কালচার, এলজিবিটিকিউ, সোশ্যাল মিডিয়ার প্যারাডক্স, ক্লাস কনসেপ্ট, আর্বান মেট্রোপলিস... স্পর্শ করা হলো সবকিছুকেই। বেশ ক'দিন আগে মুক্তি পাওয়া হলিউডি 'ডোন্ট লুক আপ' যেমন প্রবল চপেটাঘাত করেছে যাপিত নানা অসঙ্গতিকে, 'ডি-কাপলড' এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও যে সেরকম নগ্ন কটাক্ষ ও প্রহসন, তা নির্মাণের ট্রেলার দেখেই অনুমিত ছিলো অনেকটা। 

গোটা সিরিজের উপজীব্য দু'জন মানুষ। আরিয়া ও শ্রুতি। যারা স্বামী স্ত্রী। যারা আর স্বামী-স্ত্রী থাকতে চাইছে না। ডিভোর্স খুব শীঘ্রই। বিচ্ছেদের ঠিক আগে আগে শেষ ক'দিনের যাপিত নানা বিষয় নিয়ে শুরু হওয়া গল্পের নামই শিরোনাম। ডি-কাপলড। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আরিয়া লেখক। বেস্টসেলার লেখক। প্রচুর ফ্যান- ফলোয়ার। ওদিকে শ্রুতি কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের চৌকষ কর্মী। তাদের সংসারে আছে এক কন্যাও। বেশ বাড়বাড়ন্ত এই পরিবারে কেন বিচ্ছেদের সুর, সেটাই প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে টিকে থাকে সিরিজের শুরু থেকে বহুক্ষণ। বিচ্ছেদের এই গল্পে ক্রমশ যুক্ত হয় বিস্তর সব অনুষঙ্গও। যাপিত নানা সঙ্গতি, অসঙ্গতি। গল্প ক্রমশ সমুখে গড়ায়, গড়ায় সঙ্গতি-অসঙ্গতির টানাপোড়েনও। 

আরিয়া-শ্রুতি: নির্মাণের দুই প্রোটাগনিস্ট! 

এই সিরিজ নিয়ে প্রথম আক্ষেপ গল্পে। সারকাজম'কে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা এই গল্পে প্রথমেই যে জিনিসের ঘাটতি দেখেছি, সেটির নামও- সারকাজম। একটা গল্পে কেন এত বার্নিং টপিক আনতে হবে এবং সেগুলোকে একত্রে ভজঘট পাকিয়ে কেন যাচ্ছেতাই কিছু একটা বানাতে হবে, তার কোনো মানে খুঁজে পাওয়া গেলো না৷ একদিকে 'মি টু মুভমেন্ট' নিয়ে কথা হচ্ছে, অন্যদিকে নারীশরীরের খাঁজ-ভাঁজ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, নারীকেন্দ্রিক অশ্লীল সব জোক বলে 'সিরিজ' এর মশলাকে ঝাঁঝালো করা হচ্ছে আবার সেই একই গল্পে ক্রমাগত 'উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট' এর সবকও দেয়া হচ্ছে... এবং এভাবেই গিরগিটি হয়ে 'রঙ' এবং দুমুখো সাপ হয়ে 'বয়ান' পাল্টাতে পাল্টাতে পুরো গল্প কিংবা যে উদ্দেশ্যে এ গল্প, সেটিই যেন ধীরে ধীরে শোচনীয়ভাবেই মুখ থুবড়ে পড়েছে এই নির্মাণে। 

দ্বিতীয় আক্ষেপ অভিনয়ে। প্রোটাগনিস্ট আর. মাধবন কিরকম অভিনেতা, তা বোধকরি সবারই জানা। সেই পুরোনো 'মাধবন' কে বারবার খুঁজলাম এই সিরিজে। পেলাম না। মেল শোভেনিস্ট এই প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টার আরো বর্ণময় কিংবা আরো কঠোর হতেই পারতো! হলোনা। অনেকটা ফ্ল্যাট পিচেই যেন গেলো অভিনয়। তবে ভালো করেছেন সুরভিন চাওলা। অন্তত, মন্দের ভালো। বাকিরা কেউই ভালো না। আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কেউই। কারো চরিত্রেরই যেন কোনো শেড নেই। গভীরতা নেই। কোনো চরিত্রের ব্যাকস্টোরি ডেভেলপ করা নেই। ছিঁটেফোঁটাও তাৎপর্য নেই। নচিকেতার গানের ভাষায়- নেই, নেই, কিছু নেই। 

গল্প হতে পারতো বিস্তর জমাটি! 

অথচ এরকমটা হওয়ার ছিলো না মোটেই। গল্পের থিম অর্থাৎ দু'জন প্রতিষ্ঠিত স্বাবলম্বী মানুষের আচমকা বিচ্ছেদ, সেটাকেই মেইনকোর্স রেখে ক্রমশ আনা যেতে পারতো নানা স্বাদের আইটেম। এত সমসাময়িক ইস্যু না এনে আনা যেতে পারতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রসঙ্গ। সে প্রসঙ্গকেই প্রসঙ্গান্তরে করা যেতে পারতো প্রতিষ্ঠিত। চরিত্রগুলোকে নিয়ে আরেকটু ভাবা যেতে পারতো। চরিত্রের কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও যুক্ত হতে পারতো। গল্পের প্রয়োজনে যৌনতা আনা যেতো।  যৌনতার প্রয়োজনে গল্পকে 'ঠুঁটো জগন্নাথ' না করলেও হতো। এরকম অজস্র 'যা হতে পারতো'জনিত বিস্তর আক্ষেপের ফলাফলেই তাই 'ডি-কাপলড' মনে রাখার মত কিছু হলোনা৷ হলো সময়ের অপচয়। গালভরা প্রমোশন আর চকচকে ক্যামেরার কাজ থাকলেই কোনো নির্মাণ উতরে যায়না, সেটিরও বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক নিদর্শন হয়ে রইলো বিশেষ এ নির্মাণ! বাড়ালো হতাশা। কিঞ্চিৎ  বিরক্তিও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা