দীপিকা- টোলপড়া এক বিষণ্ণ রাজকুমারীর গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

দীপিকার এই যুদ্ধ কোন রাজ্যজয়ের যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ তাকে করতে হয়েছে নিজের সাথে। বিষণ্ণ রাজকুমারীর গল্পটা তাই এখন হয়ে গেছে হাস্যোজ্জ্বল রানীর গল্প, যে রানী নিজের মনরাজ্য এখন নিজেই সামলাতে পারে।
দীপিকা আমাদের কারও কাছে প্রিয় নায়িকা হিসেবে, কারও কাছে পছন্দ তার করা চরিত্রের কারণে আর কারও কাছে নেশা কেবল তার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের কারণে। কিন্তু দীপিকার নায়িকা সত্তার সাথে তার ব্যক্তি সত্তার কথা জানলে তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। দীপিকাকে দেখে কখনো অস্পৃশ্য মনে হয় না, মনে হয় পাশের বাড়ির মেয়েটাও তো এমনই হাসে। আমার বোনটার গালেও হাসার সময় এমনই টোল পড়ে, আমার প্রিয়তমা তো এভাবেই আমাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে। তাই দীপিকাকে অনেক আপন মনে হয়।
এই কাছের অনুভূত হওয়ার জায়গাটা কিন্তু দীপিকা একদিনে নিতে পারেনি। সে নায়িকা হয়েছে প্রায় এক যুগ হয়ে গেল, তবুও তাকে প্রাসঙ্গিক লাগে বারবার। কেননা এই শতাব্দী পরবর্তী সময়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর মানসিক সুস্থতার দিকটা আমরা জোরালোভাবে অনুভব করতে পারছি এখন, আর দীপিকা এই অনুভূতির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। তার টোল পড়া হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে রাজ্যের বিষণ্ণতা, বাবা-মায়ের রাজকুমারী দীপিকা বারবার আঘাত পেয়ে দমে গেছে আবার পূর্ণোদ্যমে ফিরে এসে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। চলুন এই বিষণ্ণ রাজকুমারীর গল্প শোনা যাক।
দীপিকা পাডুকোন, যাকে প্রথম চোখে পড়ে শাহ্রুখের সাথে ‘ওম শান্তি ওম’ সিনেমায়। টোল পড়া হাসি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় তাকে। কাঁচা অভিনয়টুকু ক্ষমা করে দেয়া যাচ্ছিল তার আত্মবিশ্বাস দেখে। বলিউডের আর দশটা নায়িকা থেকে আলাদা মনে হচ্ছিল না তাকে তখনো। সবাই যেমন সিনেমায় অভিনয় করে তিনিও তার ব্যতিক্রম কিছু করছিলেন না, মাঝে মাঝে চেষ্টা করছিলেন ভালো কিছু কাজ করার আবার মাঝে মাঝে কমার্শিয়াল সিনেমা দিয়ে মাতাচ্ছিলেন।
কিন্তু দীপিকা প্রথমবারের মতো মিডিয়ায় আলোড়ন তুললেন রনবীর কাপুরের সাথে তার সম্পর্কের গুঞ্জন দিয়ে। বলিউডের সবচেয়ে এলিজেবল ব্যাচেলরের সাথে বলিউডের বিউটি কুইনের প্রেম, স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া অতিআগ্রহী ছিল। গুঞ্জন ডালপালা মেলছিল, রনবীর-দীপিকাকে একে অপরের বাহুডোরে আবিষ্কার করে যাচ্ছিল প্রায়ই।

তারপর হঠাৎ ছন্দপতন! বলিউডে এসব খুব সাধারণ ঘটনা, সম্পর্কের ভাঙা-গড়া তো ওখানে স্বাভাবিকই। এভাবেই নিয়েছিল সবাই। কিন্তু ভুল ভাঙলো তখন যখন দীপিকাকে আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই ভেঙে পড়তে দেখা যায়। বলিউডের চাকচিক্যে এমন তো দেখা যায় না। এমন করে কেউ ভেঙে পড়ে নাকি ওখানে? একজন গেলে আরেকজন আসবে।
কিন্তু দীপিকা সাধারণ পরিবার থেকে আসা মেয়েই। সে যখন ভালবেসেছে তখন তার সবটুকু দিয়েই ভালবেসেছে। প্রিয় মানুষের নাম নিজের চামড়ায় ট্যাটু পর্যন্ত করিয়েছে কিন্তু সে মানুষটাই যখন বারবার তাকে ধোঁকা দিলো তখন পৃথিবী স্বাভাবিকভাবেই অসহ্য হয়ে গিয়েছিল তার জন্য। বলিউডের টপ একট্রেস হবার দৌড়ে থাকা দীপিকা যেন খেই হারিয়ে ফেললো। গভীর ডিপ্রেশন তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। তার কন্টেম্পরারি অভিনেত্রীরা মাতাচ্ছিল সিনেমাজগত আর সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল তার ঘরে। কান্না আর ঘুম ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। সাইকিয়াট্রিস্ট, বন্ধু, বাবা-মা সবাই পাশে থাকার পরও একা লাগছিল নিজেকে। টোলপড়া রাজকুমারীর মুখে আর হাসি ছিল না। আত্মহননের চিন্তাও যে আসে নি এমনটাও না, কিন্তু দীপিকা হার মানেন নি।
নিজেকে ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ শুরু হল এরপর থেকেই। ডিপ্রেশনকে হারানোর প্রথম ও প্রাথমিক কাজ হল ডিপ্রেশনকে মেনে নেয়া। দীপিকা এই ডিপ্রেশনকে মেনে নিয়েছিলেন। কিছু হয়নি, সমস্যা নেই ঠিক হয়ে যাবে- এসব উপদেশ গায়ে মাখেন নি তিনি। কারণ তিনি জানতেন এই যে ভাঙা মনটা, এটা ভাঙাই থাকবে। হয়তো এখানে সময়ের প্রলেপ পড়বে, নতুন ভালোবাসায় ক্ষত জুড়িয়ে যাবে কিন্তু জোড়া আর লাগবে না। তাই এই ভাঙা মনকে সঙ্গী করেই দীপিকা তার নিজেকে ফিরে পাওয়ার যুদ্ধে নামলেন। একের পর এক কাজ হাতে নিলেন, বন্ধুদের সময় দেয়া শুরু করলেন, বাবা-মা আর বোনের সাথে বেশি বেশি সময় কাটালেন। কেউই তাকে বলেনি- দিপু, মন খারাপ করে থেকো না; বরং দীপিকাকে তার ভাগের একাকীত্বটুকু কাটাতে দিয়েছেন। এরই মাঝে সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘রামলীলা’ সিনেমায় অভিনয়ের অফার পান, সহশিল্পী রনভীর সিং। সেখানে যেন দীপিকা আবার নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করলেন।
একে তো নিজের অভিনয়কে আরও ঝালাই করে নেয়ার ভালো সুযোগ ছিল এই সিনেমার স্ক্রিপ্টে, অন্যদিকে রনভীরের বন্ধুত্ব যেন তাকে আরও প্রাণ দিচ্ছিল। রনভীর সবসময়ই ঝরো হাওয়ার মতো ছিল, কিন্তু দীপিকার কাছে আসলেই যেন সে ঝড় শান্ত হয়ে যেত। দীপিকাই কেবল পারতো রনভীরের লাগাম টেনে ধরতে। এই অধিকার, এই বোঝাপড়া আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো রামলীলার সেটে। রনভীরের উদ্ভট কার্যকলাপ দীপিকার টোলপড়া হাসি ফিরিয়ে আনছিল যেন। কিছু একটা ফিসফাস শোনা যাচ্ছিল বানসালীর সেট থেকে, যেমনটা শোনা গিয়েছিল বছর ১৪ আগে আরেক আইকনিক জুটি নিয়ে তার অন্য একটা সিনেমার সেট থেকে।

রনভীর আর দীপিকা নিজেদের আপন করে নিচ্ছিল খুব ধীরে ধীরে আর ওদিকে দীপিকা আমার আমিকে ফিরে পাচ্ছিল। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি নেই কিন্তু চাইলেই একটু ব্রেক নেয়া যায়- এই মটো ধরে আপাতত সামনে এগুচ্ছিল সে। সিদ্ধান্ত নিলো তার মতো আরও অনেকে যারা ডিপ্রেশনের সাথে যুদ্ধ করছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর। মানসিক সুস্থতা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী দীপিকাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে কেবল এটা বোঝাতে যে- ডিপ্রেশন আসলেই ভয়াবহ রূপ নিতে পারে যদি না সাহায্য করা হয়। তাই তিনি খুললেন- The Live Love Laugh Foundation, যেখানে মূলত কাজ করা হবে মফস্বল এরিয়াগুলোতে যেখানে ডিপ্রেশন যে আসলে ডিপ্রেশন সেটা বোঝানো এবং এটা থেকে বের হবার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে। দীপিকা অভিনয়ের পাশাপাশি এই ফাউন্ডেশনের কাজ এখনো নিয়মিত করে যাচ্ছেন, ছুটে যাচ্ছেন নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় যেখানে ডিপ্রেসড অনেকেই তার সাথে তাদের গল্পগুলো শেয়ার করছে। এই শেয়ারিং আর কেয়ারিং ডিপ্রেশন থেকে মানুষকে বের করে আনতে পারে, দীপিকা জানেন সেটা আর তাই তো তিনি দীপিকা।
রনভীরের সাথে অন্যদিকে দীপিকার সম্পর্ক যেন রূপকথার গল্পের মতোই সুন্দর মোড় নিচ্ছিল। দুজনের ক্যারিয়ারের সফলতা যেখানে আরও মধুর স্বাদ এনে দিচ্ছিল। বাজিরাও-মাস্তানি, পদ্মাবতের ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিয়ে দীপভির জুটি দর্শকের মনেও জায়গা করে নিয়েছিল। শুধু অপেক্ষা ছিল কবে আনুষ্ঠানিকভাবে দুজন একসাথে থাকার ঘোষণা দেবেন, বিয়ে করবেন। বাবা, মায়ের আদরের মেয়ে দীপিকা হয়তো একটু নার্ভাসই ছিলেন, ওদিকে রনভীর তো সবসময়ই সাপোর্টিভ ছিলেন দীপিকার পাশে। অবশেষে তারা বিয়ে করলেন। তাদের সেই বিয়ের ছবি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের ফিডজুড়ে।
দীপভির জুটির ছবি দেখতে গেলেই চোখ চলে যায় দীপিকার দিকে, তার চোখ ঠিকরে বের হওয়া হাসি আর টোলপড়া গাল মনে করিয়ে দেয় যে অনেক বড় কষ্টের পরও চাইলেই সুখী হওয়া যায়। হ্যাঁ, একটু সময় লাগে; কিছু মানুষ লাগে। কিন্তু একসময় ঠিকই সুখী হওয়া যায়, হয়তো আগের চেয়েও বেশি। এই খুশি ভাঙা মন জোড়া লাগার খুশি না, ভাঙা মন দিয়েই একজনকে ভালোবেসে ফেলার আর ভাঙা মনটাকে একজনের ভালোবেসে ফেলার খুশি। ডিপ্রেশনকে জয় করে নিজেকে সফল করা ও প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটানোর খুশি।
দীপিকার এই যুদ্ধ কোন রাজ্যজয়ের যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ তাকে করতে হয়েছে নিজের সাথে। বিষণ্ণ রাজকুমারীর গল্পটা তাই এখন হয়ে গেছে হাস্যোজ্জ্বল রানীর গল্প, যে রানী নিজের মনরাজ্য এখন নিজেই সামলাতে পারে। তাই নিজের চোখের পানি নিজেকেই মুছতে হবে, নিজের মুখে হাসি ফোটাতে হবে নিজেরই; কাছের মানুষ কেবল হাত ধরে পাশে চলতে পারবে। কিন্তু দিনশেষে জীবনের এই নৌকার হাল ধরতে হবে নিজেকেই।