
আপনি দেবকে নিয়ে ট্রল করবেন, তিনি আপনাকে দিয়ে নিজের সিনেমার প্রমোশন করাবেন- এরচেয়ে বড় প্রতিশোধ আর কি হতে পারে? অভিনেতা দেবকে দেখে শেখার হয়তো কিছুই নেই, তবে প্রযোজক দেব অন্য জিনিস, তাকে অনুসরণ করা যায়, তাকে ভালোবাসা যায়...
টালিগঞ্জের বানিজ্যিকধারার সিনেমায় শীর্ষ নায়ক থাকার সময়টাতেই যখন মমতা ব্যানার্জীর অনুরোধে দীপক অধিকারী ওরফে দেব সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি তৃণমূলের হয়ে সংসদ নির্বাচন করবেন, তখন প্রায় সবাই চোখ কপালে তুলেছিল। এমন নয় যে অভিনেতা বা তারকারা এর আগে রাজনীতিতে আসেননি৷ অনেকেই এসেছেন, সংখ্যাটা নিতান্তই কম নয়। কিন্ত ক্যারিয়ারের উড়ন্ত সময়ে তাদের কেউ রাজনীতিতে আসেননি, এসেছেন পড়ন্ত বেলায়, যখন রূপালি পর্দায় তাদের জৌলুস মোটামুটি ফুরিয়ে এসেছে, সেই সময়টায়। দেবের শুভাকাঙ্ক্ষীরা তখন শুনে বলেছিল, এ পথে পা বাড়াস না ভাই, ক্যারিয়ারটা মরে যাবে! আর যারা নিন্দুক, তারা বলেছিল, অভিনয়ের অ-টাও তো জানে না, সে আবার আসছে রাজনীতিতে!
মাঝে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে৷ এখন দেবের আরও কয়েকটা পরিচয় হয়েছে, তার মধ্যে 'প্রযোজক দেব'- টা অন্যতম। দেব এখন নিজেই সিনেমা প্রযোজনা করছেন, অভিনয় করছেন, ছবির লোকেশন থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিবিউশন, সবটাই ছুটে ছুটে দেখছেন তিনি। ঘাটালের সাংসদ তিনি এখনও, যতটা দরকার ততটা সময় দিতে পারেন না বলে নিজেই আক্ষেপ প্রকাশ করেন৷ শুটিঙের ব্যস্ততা না থাকলে রাজ্যসভায় হাজিরা দেন নিয়মিতই, সিনেমা মুক্তির সময় এগিয়ে এলে একটার পর একটা ইন্টারভিউ তো লেগেই থাকে। শুভাকাঙ্ক্ষী আর নিন্দুক, দুই পক্ষই এখন অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, এত কিছু সামলাস কি করে ভাই!
অভিনেতা দেব কখনোই আমার পছন্দের কেউ ছিলেন না, এখনও যে তার অভিনয় ভালো লাগে, তেমনটা নয় মোটেও। তবে ব্যক্তি দেবের আমি ভক্ত, তার কথা, তার চিন্তা-ভাবনা, তার স্বপ্ন- সবকিছুর গল্প শুনতেই ভালো লাগে৷ কলকাতার সিনেমাকে একটা স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যে সংগ্রামটা তিনি করছেন, সেটা অবশ্যই সম্মান জানানোর মতো। ফিল্মি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই এসেছেন, কিন্ত পরিবারে অভিনয়টা ছিল না৷ পরিবারের ক্যাটারিং সার্ভিসের ব্যাবসা ছিল বোম্বেতে, সিনেমার সেটে খাবার সাপ্লাই দিতেন দেবের বাবা। তখন অবশ্য তিনি দেব হয়ে ওঠেননি, স্কুলপড়ুয়া দীপক অধিকারী নামের ছেলেটা স্বপ্নের জাল বুনতো সিনেমাকে ঘিরে। চোখের সামনে বলিউডের ঘাঘু সব নায়ক-নায়িকাকে দেখে বেড়ে উঠছে যে ছেলে, সে তো নায়ক হবার স্বপ্ন দেখবেই!
শেকড় কলকাতায় হলেও, জন্ম-বেড়ে ওঠা সবকিছুই মুম্বাইতে, বাংলাটা তাই ভালো বলতে পারতেন না কখনও, এখনও পারেন না৷ সেটা নিয়ে দেব নিজেই মজা করেন৷ এমনকি তার সিনেমাতেও ডায়লগ থাকে, 'এত বছর কলকাতায় থেকে বাংলাটা ঠিকমতো বলতে শিখলাম না!' ক্যারিয়ারের শুরুতে দেব স্ট্রাগল করেছেন অনেক, সেটা সবাই করে। স্ট্রাগল ছাড়া কে কবে সাফল্য পেয়েছে? সেসব গল্প আজ স্কিপ করে যাওয়া যাক, আরেকদিন শোনাবো সেগুলো। আজ অন্য একটা স্ট্রাগলের গল্প বলি, যেটা দেব আজও করে চলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন হবার পরেও, হয়তো আরও অনেকদিন এই স্ট্রাগলটা করে যেতে হবে তাকে।
মুম্বাইয়ে বেড়ে ওঠা আনকোরা এক তরুণ দীপক অধিকারীর দেব হয়ে ওঠাটা শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মজের হাত ধরে। তাদের সিনেমায় অভিনয় করেই দেব সাফল্য পেয়েছেন, তারকাখ্যাতি পেয়েছেন, একটার পর একটা সুপারহিট সিনেমা দিয়েছেন। অভিনয়টা তার কোনকালেই জাতের ছিল না, নাচতে পারতেন ভালো, আর কমেডি করতে গিয়ে করে ফেলতেন ভাঁড়ামো৷ তবুও তার একটা বড়সড় ফ্যানবেজ তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে, লোকে তাকে ভালোবেসেছে, তার সিনেমা ব্যবসাসফল হয়েছে। রহস্যটা দেব নিজেও বুঝতে পারেন না ঠিকঠাক। সেই জনপ্রিয়তার রেশটাই তাকে সাংসদ বানিয়েছে, প্রযোজকও তিনি হয়েছেন এসবেরই ধারাবাহিকতায়।

নিজে প্রযোজক হবার পরে দেব নজর নিয়েছেন গল্পনির্ভর সিনেমা বানানোর ওপরে৷ ক্যারিয়ারে তামিল-তেলুগুর রিমেক অনেক করেছেন, কিন্ত প্রযোজক হয়ে সেই একই পথে আর হাঁটতে চাননি তিনি, সিনেমা বানানোর জন্যে বেছে নিয়েছেন মৌলিক গল্পকে। চ্যাম্প দিয়ে শুরু, তারপর ককপিট এসেছে, জঙ্গীবাদ নিয়ে নির্মাণ করেছেন 'কবির', সৌমিত্র-পাওলি দামের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে তিনি স্ক্রিন শেয়ার করেছেন 'সাঁঝবাতি' সিনেমায়, সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত গোলন্দাজ সিনেমায় অভিনয় করেছেন ফুটবলারের চরিত্রে। সৃজিতের সিনেমায় কাজ করবেন বলে জুলফিকার- এ বোবা চরিত্রেও হাজির হয়ে গেছেন।
প্রযোজক হিসেবে একটা স্বকীয়তা ধরে রাখতে চেয়েছেন দেব, চেষ্টা করছেন ভিন্ন রকম কিছু করার৷ সবজি বিক্রি করে গরীবের চিকিৎসার জন্যে হাসপাতাল বানানো সুহাসিনী দেবীর বায়োপিক নির্মাণে হাত দিয়েছেন তিনি, বানাচ্ছেন 'বিনয়-বাদল-দিনেশ' এর মতো থ্রিলার ঘরানার সিনেমাও। কিন্ত সুপারস্টার দেবের পথচলাটা যতটা মসৃণ ছিল, প্রযোজক দেব সেরকমটা চলতে পারছেন না, কিংবা বলা ভালো, তাকে চলতে দেয়া হচ্ছে না৷ পথে পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, চেষ্টা করা হচ্ছে দেবকে থামিয়ে দেয়ার। সেটা করছে দেবেরই বন্ধুরা, যাদের সঙ্গে একসময় তার গলায় গলায় ভাব ছিল।
শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মজের কথাই ধরুন, তাদের ব্যানারে দেব সর্বাধিক সিনেমা করেছেন, অথচ দেব প্রযোজক হবার পরে তারাই দেবকে নিজেদের এক নম্বর প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল কিছুদিন আগেও! পূজার সময় শো হাউজফুল যাবার পরেও ভেঙ্কটেশের চাপেই মুক্তির চতুর্থ দিনে দেবের ছবি নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন হল মালিকেরা, রেষারেষিটা কোন পর্যায়ে গেলে এমন হতে পারে, কল্পনা করুন একবার৷ শুধু তো তা-ই নয়। দেব তার সিনেমার জন্যে যে নায়িকাকে কাস্ট করেছেন, তাদেরও ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভেঙ্কটেশ, আরও ভালো কোন রোলের অফার দেবে বলে!
হলো রে হইচইয়ে যেমন মিমি আর প্রিয়াঙ্কার অভিনয় করার কথা ছিল, দুজনেই পরে সরে গেছেন এটা সেটা অজুহাত দেখিয়ে। একটা সময় তো এমন হয়েছিল, সিনেমার জন্যে নায়িকাই পাওয়া যাচ্ছিল না! দেব টালিউডের প্রায় সব নায়িকার কাছেই গেছেন অফার নিয়ে, কিন্ত সবারই কিছু না কিছু অজুহাত ছিল৷ পেছন থেকে কলকাঠিটা কে নাড়ছিল বুঝতে কষ্ট হয় না মোটেও। দেব কিন্ত দারুণ প্রফেশনাল, তিনি কারো দিকে আঙুল তুলতে চাইলেন না একবারও৷ শুধু বললেন, এগুলো ইন্ডাস্ট্রির জন্যে ভালো কিছু নয়।

দেবের কথা পরিস্কার, প্রযোজক দেব যদি ব্যর্থ হয়, দর্শক তখন অভিনেতা দেবকেও ভুলে যাবে, মুখ ফিরিয়ে নেবে। দেবের প্রযোজক স্বত্ত্বাটাকে থামিয়ে দিতে গিয়ে যাতে অভিনেতা দেবকে মেরে ফেলা না হয়, সেটাই তার অনুরোধ। দেব যখন তার প্রথম সিনেমাটা করছেন, তখনও কেউ নায়িকা হতে চায়নি, তখন অবশ্য আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ার ব্যাপার ছিল না। সবাই একবাক্যে দেবকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, এসব ছবি কলকাতায় চলবে না, লোকে খাবে না৷ পরে তো বিরক্ত হয়ে নিজের প্রেমিকাকেই নায়িকা হিসেবে নিয়েছিলেন সেই সিনেমায়। এখন সেই একই নায়িকারাই দেবকে অনুরোধ করেন, আরেকটা চ্যাম্প বা ককপিট কবে করবে? আমাকে কেন কবির- এ নিলে না? দিন বদলায়, বেশ ভালভাবেই বদলায়, দেব সেই দিনবদলের অপেক্ষাতেই আছেন।
অভিনেতা দেবকে ভাল না লাগলেও প্রযোজক দেব আমার ভীষণ পছন্দের। কলকাতায় তিনি আন্ধাধুনের মতো থ্রিলার বানাতে চান, স্বপ্ন দেখেন, কোন একদিন এই ইন্ডাস্ট্রিই ২.০ এর মতো সিনেমা বানাবে। দেব জানেন, এখন যে অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে তিনি আর কখনও পাগলু টাইপের সিনেমা করতে পারবেন না, করতে তিনি চানও না। দেব এখন কন্টেন্টকে ভালোবাসেন, স্টারডমের চেয়ে অনেক বেশি। গল্পের খোঁজে তিনি হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ান ভারতজুড়ে, সিনেমায় টাকা ঢেলেই নিজের কাজ শেষ ভাবেন না, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকেন আঠার মতো।
দেবের আরেকটা জিনিস আমার ভীষণ পছন্দের, সেটা হচ্ছে ওর প্রমোশনের স্ট্র্যাটেজিটা৷ বিমান ভাড়া করে সিনেমার ট্রেলার লঞ্চ করছেন, সিনেমা মুক্তির আগে দিনে তিন-চারঘন্টা ঘুমিয়ে সবার ইন্টারভিউ'র আবদার পূরণ করছেন৷ কলকাতায় কিরণ দত্ত নামের এক ইউটিউবার আছে, 'দ্য বং গাই' তার চ্যানেলের নাম৷ সেই ছেলে দেবকে প্রতিদিন ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ধোয়, দেবের নাম সে দিয়েছিল একালের মহানায়ক! দেব তার সিনেমার প্রমোশনের জন্যে সেই ছেলের ভিডিওতে হাজির হয়েছেন, সেখানে গিয়ে হইচইয়ের প্রমোশন করে এসেছেন! ভাবা যায়! তোর যতো খুশি আমাকে নিয়ে ট্রল কর, আমি তোর চ্যানেলে এসেই নিজের সিনেমা নিয়ে কথা বলে যাবো- এরচেয়ে বড় প্রতিশোধ আর কি হতে পারে?
অভিনেতা দেবকে দেখে শেখার হয়তো কিছুই নেই, বরং বিরক্ত হবার চান্স আছে। তবে প্রযোজক দেব অন্য জিনিস, তাকে অনুসরণ করা যায়, তাকে ভালোবাসা যায়। কলকাতার সিনেমা বদলে গেছে অনেকটা, আরও বদলাবে, অনেক দূর এগিয়ে যাবে তারা। কারণ ওখানে দেবের মতো মানুষেরা সিনেমা নিয়ে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করতে চায়। স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্যে হেঁটে চলে শত বাধা পায়ে মাড়িয়ে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যদি এটা সবাই বুঝতো, ঢালিউডও বদলে যেতে সময় লাগতো না খুব বেশি...