
নায়ক-নায়িকা-ভিলেন যে'ই হোক, সব পরিচালকের কমন চাহিদার নাম দিলদার। সিনেমায় শুধু কমেডিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করে কেউ আজ পর্যন্ত এমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে জানা নেই কারো...
অনেক বছর আগের কথা, ১৯৪৫ সাল। সেবছর তার জন্ম। বাংলাদেশ তো দূরের কথা, ভারত-পাকিস্তানেরও জন্ম হয়নি তখন। পরিবারের কোথাও অভিনয়ের আবহ ছিল না, লুকিয়ে চুরিয়ে ফিল্ম দেখার অভ্যাসও ছিল না একদম ছোটবেলায়। শৈশব-কৈশরের স্মৃতি বলতে তার কাছে ডাকাতিয়া-মেঘনার মোহনায় দাঁড়িয়ে লঞ্চের আসা-যাওয়া দেখাটাই। ঢাকা তার কাছে দূর এক গ্রহের নাম, মতলব উপজেলাটা তার চোখে বাংলাদেশ, চাঁদপুর শহরটাই তার কাছে পৃথিবী।
হাসি-তামাশায় সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন, বন্ধুদের আড্ডায় পারতেন আসর জমিয়ে তুলতেও; কিন্ত সেই মানুষটা কোনদিন অভিনয়ে আসবেন, সিনেমায় কাজ করবেন, কিংবা মানুষকে হাসানোটা তার নিয়তি হয়ে যাবে, সেটা বোধহয় তিনি নিজেও ভাবেননি কখনও। কিন্ত মাথায় অভিনয়ের পোকা ঢুকলো একটা সময়ে। ঢাকায় এসে থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। মঞ্চে কাজ করতেন শুরুতে। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি।
১৯৭২ সাল, স্বাধীন বাংলাদেশে তখন সিনেমাশিল্পটা সবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, সেই মিছিলে ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য এক সৈনিক হিসেবে যোগ দিলেন তিনি। সিনেমার নাম 'কেন এমন হয়'। এরপরের গল্পটা জয় করার, দোর্দন্ড প্রতাপে নিজের রাজ্যপাটে শাসন করার, নিজের ক্ষেত্রে কিংবদন্তী হয়ে ওঠার। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা নায়ক কে, সেরা নায়িকা কে- এসব প্রশ্নে নানা জনের নানা মত, একেকটা মানুষের একেক রকম পছন্দ। কিন্ত প্রশ্ন যখন বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা কৌতুক অভিনেতাকে নিয়ে, তখন সবার ভোট একটাই ব্যালটবাক্সে, নাম তার দিলদার!
সিনেমায় শুধু কমেডিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করে কেউ আজ পর্যন্ত এমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে জানা নেই কারো। চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন বা রোয়ান অ্যাটকিনসনের মতো দুর্দান্ত অভিনেতারা মানুষকে হাসিয়েছেন পর্দায়, বছরের পর বছর ধরে। ওদের সঙ্গে দিলদারের তুলনা চলে না কোথাও। কিন্ত ওরা ছিলেন নিজেদের সিনেমাগুলোর মূখ্য চরিত্রে, সবটুকু আলো থাকতো ওদের ঘিরে। সেখানে অল্প কিছুক্ষণ স্ক্রীনটাইম নিয়েই পর্দা কাঁপাতেন দিলদার, সিনেমায় যতোক্ষণ তার উপস্থিতি থাকতো, পুরোপুরি মাতিয়ে রাখতেন দর্শককে। সামান্য একজন কমেডিয়ান হয়ে দর্শকের হৃদয়ে এমন ভালোবাসার আসন পাওয়াটা চাট্টেখানি কথা নয় মোটেও।

১৯৭২ সালে 'কেন এমন হয়' সিনেমা দিয়ে যে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল, সেই হাসি ঠাট্টার গাড়িটা চলেছে প্রায় তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে, অবিরাম। প্রায় পাঁচশো সিনেমায় অভিনয় করেছেন দিলদার, দর্শককে হাসিয়েছেন বিরতিহীনভাবে। সময়ের সব দুর্দান্ত অভিনেতার সাথে তিনি কাজ করেছেন, এটিএম শামসুজ্জামান থেকে হূমায়ুন ফরিদী, কিংবা নায়কদের মধ্যে জসিম-ইলিয়াস কাঞ্চন-রুবেল থেকে শুরু করে সালমান শাহ-ওমর সানী-রিয়াজ; কার সঙ্গে দেখা যায়নি দিলদারকে? কিন্ত কারো ছায়ায় ঢাকা পড়েননি তিনি, পার্শ্বচরিত্রে যতখানি প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব, সেটার সীমাকে ছাড়িয়ে নিজেকে তুলে এনেছেন বারবার, সিনেমা হল বা টিভি পর্দা- তাকে দেখে, তার মুখে হাস্যরসাত্নক ডায়লগ শুনে হাসিতে গড়িয়ে পড়েছে দর্শক।
বিটিভির সেই দিনগুলোতে শুক্রবার বিকেলে বাংলা সিনেমার জন্যে আমাদের নিরন্তর অপেক্ষার একটা বড়সড় কারণ ছিলেন দিলদার। সিনেমায় তাকে সবসময় ভালো মানুষ হিসেবেই দেখা গেছে, কখনওবা নায়কের সঙ্গী হয়ে চুরি-বাটপারী করেছেন। কিন্ত বাস্তবের দিলদার কতটা ভালো মানুষ ছিলেন, সেটা জানেন চলচ্চিত্রে তার সহকর্মীরা, বিশেষ করে সেই মানুষগুলো, সিনেমার কারণেই যারা দুবেলা খেয়েপরে বেঁচে আছে। এসব মানুষদের সাধ্যমতো সাহায্য করতেন দিলদার, একারণে ওদের মধ্যেও ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। এফডিসিতে 'দিলদার ভাই' বলতে অজ্ঞান ছিলেন এরকম অনেক মানুষ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র কৌতুকাভিনেতা, যিনি একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রে লীড রোলে অভিনয় করেছেন। 'আবদুল্লাহ' নামের সেই সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৮ সালে। সেই সিনেমাতেও দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি। কমেডিয়ান পরিচয়ের আড়ালে দিলদারের অভিনেতা বা শিল্পীস্বত্তাটা বিলীন হয়ে যেতো প্রায়ই, সেই কমেডিয়ানের খোলস ছেড়ে অভিনেতা দিলদার বেরিয়ে এসেছিলেন 'আবদুল্লাহ'-তে। লোক হাসানোর চরিত্র ছেড়ে তিনি ধারণ করেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য একটা রূপ। যে রূপে তাকে আগে কখনও দেখেনি দর্শকেরা!
আশি আর নব্বইয়ের দশকে বাংলা সিনেমা মানেই ছিল দিলদারের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। নায়ক-নায়িকা-ভিলেন যে'ই হোক, সব পরিচালকের কমন চাহিদার নাম দিলদার। যে দিলদার তার মজার কাণ্ডকীর্তি নিয়ে হাজির হলেই সিনেমা অর্ধেক হিট! বাস্তবেও তা'ই ঘটেছে অনেকবার। হয়তো সিনেমার গল্প শক্তিশালী ছিল না, কিংবা বাকীদের অভিনয়ের দুর্বলতা ছিল কোথাও, তাতে দর্শক গা করেছে কম। দিলদারের অভিনয় দেখেই হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে গেছে তারা।

পর্দায় মানুষকে হাসানোর ভারটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, শত শত সিনেমা করেছেন, কিন্ত পরিবারকে সময় দিতে ভোলেননি, তাদের ভালোমন্দ খেয়াল রাখার বেলাতেও ভুল হয়নি কখনও। মেয়েদের সাথে সময় কাটাতেন নিয়মিত, দিলদারের দুই মেয়ে সেসব স্মৃতি মনে করতে পারেন এখনও। ছোট মেয়ে জিনিয়া যখন মডেলিঙে আসতে চেয়েছিল, তখন দিলদারই না করেছিলেন তাকে। মিডিয়ার মানুষ হয়েও মেয়েকে মিডিয়ায় আসতে দিতে আপত্তি ছিল তার, হয়তো কোন কারণে একটা খারাপ লাগা কাজ করেছিল এই জগতটার প্রতি।
খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন, এর ওর পেছনে দেদার টাকা ঢালতেন, বন্ধুদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন খুব। ঘুরে বেড়িয়ে টাকা পয়সা ওড়াতে পছন্দ করতেন না, দামী মেকাপ বা শপিং, অথবা বিলাসবহুল জীবন- কোনটাই পছন্দ ছিল না তার। যে শিকড় থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন, তাকে ভুলে যাননি কখনও, সেকারণেই টাকাপয়সার মালিক হয়েও মধ্যবিত্ত জীবনটাকেই বেছে নিয়েছিলেন দিলদার। নাটক লেখা শুরু করেছিলেন একটা সময়ে, তার লেখা দুটো নাটক প্রচারও হয়েছিল। দিলদারের এই ব্যতিক্রমী প্রতিভার কথা খুব কম মানুষই জানেন। হয়তো জানতে পারতেন, যদি না হুট করে চিরবিদায় না নিতে হতো তাকে।
২০০৩ সালটা দিলদারের জন্যে খুব স্পেশাল ছিল, এবছরই ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেছিলেন তিনি, 'তুমি শুধু আমার' সিনেমায় অভিনয়ের জন্যে। কিন্ত সেবছরই ১৩ই জুলাই আচমকা লক্ষ-কোটি ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি!
ত্রিশ বছর তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছেন, পাঁচশো সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তবুও যেন মনে হয় কত দ্রুতই চলে গেলেন মানুষটা! আসলেই তো, ৫৮ বছর বয়স কি একজন শিল্পীর, একজন সৃজনশীল মানুষের চলে যাবার বয়স? আরও কত দুর্দান্ত অভিনয়ের স্মাক্ষর তার রাখার কথা ছিল, অভিনেতা দিলদারের সেরা অভিনয়টা দেখা বাকী ছিল দর্শকদের, সেই অপেক্ষাটা কোনদিন ফুরোবে না। একজন দিলদারকে বাংলাদেশের সিনেমাজগত আর কখনও পাবে না, দিলদারদের শূন্যতা কখনও পূরণ হয় না। সেই ১৯৭২ থেকেই ধরুন না, এখন ২০২০ সাল, ৪৭ বছরে দিলদার ছাড়া আরও অনেকেই অভিনয় করেছেন কমেডিয়ানের চরিত্রে। দর্শকদের মনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলার মতো কেউ কি এসেছিলেন? দিলদারের মৃত্যুর পরেও তো সতেরোটা বছর পার হয়ে গেছে, কেউ আসেনি তার মতো, আসবেও না।
প্রতিবছর ১৩ই জুলাইয়ের দিনটা নীরবেই চলে যায়, এই মানুষটা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন এই দিনে। দিলদার তো শাহরুখ-সালমান নন, তার মৃত্যুদিবস সবার মনেও থাকে না, থাকার কথাও নয়। তবে হ্যাঁ, দিলদার নিজের আসনটা পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন তার সময়কার দর্শকের মনে, প্রায় তিরিশটা বছর, দুটো প্রজন্মের কাছে বাংলা সিনেমা দেখার একটা বড় কারণ হয়ে ছিলেন দিলদার। এখনও লোকে নস্টালজিয়ায় ভোগে, দিলদারের কথা ভেবে। এখনও কেউ কেউ আনমনেই হেসে ওঠে, দিলদারের অভিনয়ের কথা মনে পড়লে।